সোমবার ৩০ জুন ২০২৫ ১৬ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ৩০ জুন ২০২৫
দুর্বল জাতির ভাষা ক্ষমতাহীন
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৩:৫৫ PM
সাহিত্যের ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য অনেক কিছুকেই প্রতিফলিত করে; ভাষা ব্যবহারে উৎকর্ষকে তো অবশ্যই। সাহিত্যের মাধ্যমেই ভাষার সর্বোৎকৃষ্ট বিকাশ ঘটে থাকে। দেশে এখন প্রচুর বই। প্রতিবছর বইমেলাতে বই উপচে পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ বইয়েরই অন্তর্গত বস্তু অকিঞ্চিৎকর। প্রচুর সংখ্যায় বিক্রি হয় উপন্যাস ও উপন্যাসসদৃশ রচনা। জনপ্রিয় এই ধারা পাঠকদের জন্য এক ধরনের আমোদ সরবরাহ করে। অল্প সময়ের জন্য হলেও বাস্তব জগৎকে ভুলিয়ে দেয়। ফলে পাঠকদের একটা রুচি তৈরি হয়। যে রুচি গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ সাহিত্যের স্বাদ গ্রহণের জন্য মোটেই অনুকূল নয়, বরং প্রতিকূল বটে।

মাদকাসক্তির মতো অতটা ক্ষতিকর না হলেও কথিত জনপ্রিয় সাহিত্যও এক ধরনের আসক্তি বটে। এ নেশায় যাকে পেয়েছে তার পক্ষে গভীর কোনো বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা সম্ভব না হওয়াই স্বাভাবিক। এই সঙ্গে এ ঘটনাও তাৎপর্যহীন নয় যে, মেধাবী লেখক কেউ কেউ এখন ইংরেজিতে লিখছেন। তারা ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষিত; সেই সঙ্গে ইংরেজি বইয়ের বাজারও তুলনামূলক উন্নত; তাড়াটা দু’দিক থেকেই আসছে। সেই সঙ্গে বাস্তবতা এটাও যে, মধ্যবিত্ত পাঠকরা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। যারা ওপরের দিকে উঠেছে তারা ইংরেজি বইয়ের দিকেই ঝুঁকবে এবং বাংলা বইকে অবজ্ঞা করতে শিখবে। এটাই প্রবণতা। 

এটাও অবধারিত যে, জনমাধ্যমের গুরুত্ব আরও বাড়বে। অনেক বেড়েছে; থামবে না। জনমাধ্যম কিন্তু ভাষার উন্নতিতে সহায়ক হচ্ছে না। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা তো হয়ই না; ভাষা বিকৃতি ঘটে বিজ্ঞাপন এবং নাটকে। সরকার নিয়ন্ত্রিত মাধ্যমগুলো সরকারের মহিমা প্রচার করতে ব্যস্ত থাকে, তাতে মানুষের বিরক্তি উৎপাদিত হয় এবং প্রচারের ভাষাও হয় নিম্নমানের। এফএম রেডিও তরুণদের যে ভাষা শেখাচ্ছে, তা ভাষাচর্চার জন্য মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। 

বিশ্বে এখন বাংলাভাষীর সংখ্যা প্রচুর, ২৫ কোটিরও বেশি হবে; সংখ্যাবিচারে বাংলাভাষী মানুষের স্থান পঞ্চম। কিন্তু বাংলা ভাষার মর্যাদা খুবই কম। কারণ কী? কারণ হচ্ছে, আমরা সংখ্যায় অনেক ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতায় সামান্য। অনেকটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মতোই; শিক্ষিতের সংখ্যা অনেক কিন্তু গুণগত মান নিম্নগামী। 

ক্ষমতাহীনতার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রধান ও প্রাথমিক কারণটা হলো জ্ঞানচর্চার অপ্রতুলতা। জ্ঞানচর্চা ঠিকমতো হচ্ছে না। তার কারণ হলো, চর্চা যেটুকু যা হচ্ছে, তা বাংলা ভাষার মাধ্যমে ঘটছে না। জ্ঞানই যে শক্তি– এ সত্যে কোনো ভেজাল নেই। জ্ঞানের চর্চায় আমরা উঁচুতে উঠতে পারছি না; মেধা ও মনন অবিকশিত রয়ে যাচ্ছে। ফলে ক্ষমতা বাড়ছে না। আমরা তরল হচ্ছি, ঘন হতে ব্যর্থ হয়ে। বিশ্বে তাই বাঙালির কোনো সম্মান নেই। ওদিকে সব বাঙালি বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। কেননা, বাংলাদেশই হচ্ছে বাংলা ভাষা চর্চার কেন্দ্রভূমি এবং ভরসাস্থল। এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে; এর রাষ্ট্রভাষা বাংলা; এখানে যদি ভরসা না থাকে, তবে থাকবে কোথায়? থাকছেও না।

বাঙালি তার ভাষা নিয়ে গৌরব করে থাকে। গৌরবের কারণ আছে। একটি কারণ বাংলা ভাষায় উচ্চারণের সঙ্গে লিখিত রূপের নৈকট্য। আমরা যেভাবে উচ্চারণ করি, সেভাবেই লিখে থাকি। কিন্তু অধুনা দেখা যাচ্ছে, কেবল উচ্চারণে নয়; লিখিত রূপের ওপরেও নিদারুণ হস্তক্ষেপ ঘটছে। প্রমিতকরণের নাম করে ‘ঈ’-কারগুলোকে যাবজ্জীবন নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। সর্বাধিক অগ্রহণযোগ্য হলো ‘শ্রেণী’ বানানে ‘ই’-কারের প্রয়োগ। শাসকশ্রেণি মনে হয় শাসিতশ্রেণিকে অন্যদিক থেকে তো বটেই, বানানের ক্ষেত্রেও হ্রস্ব করে ছাড়বে; কোনো ক্ষেত্রেই রেহাই দেবে না। হায় দরিদ্রশ্রেণির মানুষ! তোমরা পালাবে কোথায়? হরফ বিতাড়নের উদ্যোগটা পাকিস্তানি শাসকরাও নিয়েছিল, সফল হয়নি। কেননা, শিক্ষিত বাঙালি সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিল। এখন শিক্ষিত বাঙালির বিত্তবান অংশ শাসকশ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে বিতাড়নের কাজটি নিজেরাই সিদ্ধ করছে। বাঙালির দুর্দশা ও বাংলার দুর্দশা যে এক ও অভিন্ন– তাতে সন্দেহ কী?

দুর্দশাটা এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারির উদযাপনের ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান। আয়োজনের অভাব নেই, কিন্তু একুশের উদযাপনে মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। সেটা হলো মধ্যরাতে উদযাপনের সূচনাকরণ। বাঙালির উৎসব শুরু হয় সকালে; ইউরোপীয়দের মধ্যরাতে। ওদের মধ্যরাত আক্রমণ করেছে আমাদের সকালবেলাকে। যা ছিল স্বাভাবিক, তাকে কৃত্রিম করে দেওয়ার আয়োজন বৈকি! সাংস্কৃতিকভাবে মধ্যরাত থার্টিফার্স্ট নাইটের ব্যাপার; পহেলা বৈশাখের নয়। থার্টিফার্স্ট নাইট আর পহেলা বৈশাখ এখন আলাদা হয়ে গেছে। ইংরেজি নববর্ষ হুমকি দিচ্ছে বাংলা নববর্ষকে। হুমকির লক্ষণ একুশের উদযাপনেও দেখা দিয়েছে। হুমকি এসেছে আরও একটি। সেটি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এটি আমাদের নয়; ইউরোপের। এর সঙ্গে যোগ রয়েছে বাণিজ্যের।

দখলদারিত্বের ভেতর দিয়ে বিশ্ববাজার এখন কোণঠাসা করতে চায় দেশীয় উৎপাদনকে; ভালোবাসা দিবস প্রকাশ্যে উদ্দীপনা তৈরির মধ্য দিয়ে গোপনে শত্রুতা করছে শহীদ দিবসের সঙ্গে। যে তরুণদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, তারা প্রদর্শনী ঘটাচ্ছে একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দু’জনে দু’জনে মিলবার অভিপ্রায়ের। জনবিচ্ছিন্নতা আর কাকে বলে? মর্মার্থে এ বিচ্ছিন্নতা শাসকশ্রেণির ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতারই সংক্রমণ ও প্রতিচ্ছবি। আবার এটাও তো দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্য দিয়ে হিন্দি ভাষা হানা দিয়েছে গৃহের অন্তঃপুরে। অতীতে আমরা উর্দুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম; বর্তমানে হিন্দির জন্য আমাদের দরজা-জানালা উন্মুক্ত। রাষ্ট্র গা করে না; রাষ্ট্রের চোখে এসব কাজ জরুরি নয়।

আবারও ওই শাসকশ্রেণির জনশত্রুতার বিষয়টির কাছেই যেতে হয়। রাষ্ট্র অনেক কিছুই করতে পারেনি; রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বাংলা ভাষার চর্চার ক্ষেত্রেই ঘটেছে। ওই ব্যর্থতা অনেক ব্যর্থতার প্রতিপালক। ব্যর্থতার কারণ হলো রাষ্ট্র ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু বদলায়নি। ভেতরে সে আগের মতোই রয়ে গেছে। বদলাবার কথা ছিল। কেননা, এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ফলে। মুক্তির ওই সংগ্রামেরই অংশ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। তারই পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিল বাংলা ভাষাচর্চার স্বাধীনতা। সেটা সম্ভব হতো রাষ্ট্রের চরিত্রে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের ভেতরে শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি মৌলিক পরিবর্তন ঘটত, তবেই। সেটা ঘটেনি। শাসক বদল হয়েছে; শাসক-শাসিতের সম্পর্কে বদল হয়নি। মুক্তির সংগ্রামে চালিকাশক্তি ছিল সাধারণ মানুষ। সেই সাধারণ মানুষের মুক্তি আসেনি। তাই তাদের মাতৃভাষাও মুক্তি পায়নি; আগের মতোই শাসকদের অবহেলা ও উৎপীড়নের শিকার হচ্ছে। 

কিন্তু হতাশ হবার কারণ নেই। জনগণ আছে এবং তাদের ভাষাও থাকবে। কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে যে বাঙালিরা রয়েছে, তাদের ভাষা অবশ্যই নিজের জন্য মর্যাদার স্থান খুঁজে নেবে। কিন্তু দায়িত্বটা বাংলাদেশের মানুষেরই। নেতৃত্ব তাদেরই দিতে হবে। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ ও প্রয়োগ বৃদ্ধির জন্য আমরা বিভিন্ন কাজের সুপারিশ করতে পারি। যেমন পাঠাগার গড়ে তোলা; সংস্কৃতিচর্চার গুণ ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি। বলতে পারি ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণের আবশ্যকতার কথা। সাহিত্যচর্চার অপরিহার্যতার বিষয় তুলে ধরতে পারি।

উচ্চ আদালতের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের অনুরোধ জানাতে পারি বাংলা ব্যবহারের। কিন্তু মূল ব্যাধিটাকে যেন না ভুলি। সেটা হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র। ওই চরিত্রে বদল ঘটিয়ে রাষ্ট্রকে জনগণের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। সেটা ঘটলে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের সর্বত্র জনগণের ভাষা অব্যাহতরূপে ব্যবহৃত হবে। তার উন্নতির পথে অন্তরায় থাকবে না। এর জন্য যে সামাজিক বিপ্লব দরকার, তার পথে অন্তরায় হচ্ছে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ মানুষ ও প্রকৃতির মূল শত্রু; পুঁজিবাদ বাংলা ভাষা, বাঙালিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র এবং বাঙালির দুর্দশার জন্য দায়ী।

ভরসা এখানে যে, পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রাম বিশ্বজুড়েই শক্তিশালী হচ্ছে, সেই সংগ্রাম বাংলাদেশেও চলছে। সারাবিশ্বে মানুষের মুক্তি যেমন বৃদ্ধ পুঁজিবাদের যুবকসুলভ দুরন্তপনায় মোকাবিলা না করলে ঘটবে না, আমাদের মুক্তিও তেমনি আসবে না পুঁজিবাদের দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে ব্যর্থ হলে। এটা যেন কখনোই না ভুলি যে, ভাষার শত্রু ও মানুষের শত্রু অভিন্ন এবং ওই শত্রুটির নাম পুঁজিবাদ। সমস্যাটা রাজনৈতিক। অরাজনৈতিক পথে এর সমাধান নেই। বাংলা ভাষার প্রয়োজনে আমরা রাষ্ট্র ভেঙেছি, ওই একই প্রয়োজনে শাসক-শাসিতের সম্পর্কের ভেতর পরিবর্তন আনা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত