২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়। কিছুদিন পর থেকেই দেশের অর্থনীতিবিদরা ক্রমাগত মতপ্রকাশ করেছেন যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি করে চলছে। উন্নতির লক্ষণ হিসেবে পদ্মা সেতু, ঢাকায় মেট্রো রেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে সুরঙ্গপথ নির্মাণ ইত্যাদির কথা তাঁরা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। কিন্তু বছর দশেক যেতে না যেতেই অর্থনীতিবিদরা ওই ধারায় আর বিশেষ কিছু লেখেন না।
সাংবাদিকদের থেকে কেউ কেউ তখন তথ্য-বিবরণ দিয়ে লিখতে থাকেন যে দেশ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে আর্থিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিপর্যয়ের ধারায় পড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে করোনাভাইরাস, ডেঙ্গু, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ও যুদ্ধ, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক আক্রমণ, গণহত্যা, যুদ্ধ ইত্যাদির ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক দুর্গতি দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থানও এই দুর্গতির মধ্যে রয়েছে। তার ওপর রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি ও বিদেশে ব্যাপক অর্থপাচার।
সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়েও বাংলাদেশ দুর্গতিতে রয়েছে। এর মধ্যে হত্যা ও আত্মহত্যার সংখ্যা দেশে অনেক বেড়েছে। নারী নির্যাতন অনেক বেড়েছে। সমাজের স্তরে স্তরে দেখা যায় সংঘাত-সংঘর্ষ ও হত্যাযজ্ঞ।
প্রকৃতি ও মানবপ্রজাতি বিকাশশীল। এর মধ্যে সংস্কৃতিও বিকাশশীল। রাজনীতিতে সংস্কৃতির ধারণাটি যুক্ত হয়েছে লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা এবং মাও জেদংয়ের নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা। মার্ক্সবাদের সঙ্গে সংস্কৃতির মার্ক্সীয় ধারণাও ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে—সব জাতির মধ্যে। মার্ক্স-এঙ্গেলস ইউরোপের ঐতিহ্য অবলম্বন করেই সংস্কৃতির ধারণা উদ্ভাবন করেছিলেন এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী রূপ দিয়ে তার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। তখন সাম্রাজ্যবাদী মহল সংস্কৃতির ধারণাকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
বাংলা ভাষার দেশেও মার্ক্সবাদীরাই কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করতে গিয়ে সংস্কৃতির ধারণাটিকে রাজনীতিতে কার্যকর করতে চেয়েছেন। ক্রমে তার প্রভাব রাজনীতির অন্যান্য ধারায়ও বিস্তার লাভ করেছে। এখন সব দলই রাজনীতিতে সংস্কৃতির প্রয়োজনের কথা বলে থাকে। তবে বিভিন্ন দলের সংস্কৃতির ধারণায় বিভিন্নতা আছে। আর প্রগতির সঙ্গে দুর্গতির ধারণাও সামনে এসেছে।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুশীলন অপরিহার্যকমিউনিস্ট ভাবধারা অনুযায়ী সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো অভীষ্ট লক্ষ্যে জনগণের চিন্তাধারা পরিবর্তনের আন্দোলন। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁদের আদর্শগত ধারায় পুস্তক-পুস্তিকা রচনা ও প্রচার, উদ্দেশ্যনিষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টি ও প্রচার, সংগীত, নাটক ও চিত্রশিল্প সৃষ্টি ও প্রচার ইত্যাদিতে। এ উদ্দেশ্যে তাঁরা লেখক ও শিল্পীদের সংগঠনও গড়ে তুলেছেন। তাঁদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মর্মে থাকে মার্ক্সীয় ভাবধারা। দলীয় আত্মগঠনের ও জনজীবনের পর্যায়ক্রমিক মুক্তির চিন্তাও তাতে থাকে। প্রগতির ধারাকে সফল করতে না পারলে দেখা দেয় দুর্গতি। বিভিন্ন দেশে মার্ক্সবাদী রাজনীতির যে অবস্থা, সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও সেই অবস্থা।
গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুশীলন অপরিহার্য। আমি সর্বজনীন গণতন্ত্রের কথা বলছি, কথিত নব্য উদারবাদী গণতন্ত্রের কথা বলছি না। বাংলাদেশে বেশ কিছু সংগঠন আছে, যেগুলো উন্নত সংস্কৃতির কথা প্রচার করছে। অনেকগুলোই এনজিও। তাদের কার্যক্রম দ্বারা কি আমাদের জনজীবনের বিশেষ কোনো কল্যাণ হচ্ছে?
বাংলা ভাষার দেশে সুধী ব্যক্তিরা ইংরেজি কালচারের ধারণা আত্মস্থ করে এবং নিজেদের জীবনধারা ও ঐতিহ্য বিবেচনা করে সংস্কৃতির ধারণাটি সৃষ্টি করেছেন। প্রায় দেড় শ বছর ধরে বাংলা ভাষার চিন্তক ও কর্মীরা সংস্কৃতির ধারণাটিকে নানা ধারায় বিকশিত করে চলছেন। বিভিন্ন ধারার সংস্কৃতি-চিন্তায় বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রী অরবিন্দ, গোপাল হালদার, নীহাররঞ্জন রায়, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ প্রমুখের নাম সবার আগে সামনে আসে। মনে হয়, সব ধারার আন্তরিক ও স্বচ্ছ চিন্তাই মূল্যবান, গুরুত্বপূর্ণ।
প্রচারমাধ্যম সংস্কৃতির ধারণাকে বিনোদনের ধারণায় সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার ‘সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি’ করতে গিয়ে সংস্কৃতিকে ‘বিনোদন’ অর্থেই ব্যবহার করে থাকে। আমরা যদি পূর্বোক্ত মনীষীদের চিন্তাগুলোকে সমন্বিত করে বুঝতে চাই তাহলে বলতে পারি : সংস্কৃতি একান্তই মানবীয় ব্যাপার। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীরই সংস্কৃতি নেই। সংস্কৃতি হলো মানুষের চিন্তা ও কাজের উৎকর্ষমান, সৌন্দর্যমান, উত্তরণশীল, প্রগতিশীল পূর্ণতাপ্রয়াসী সক্রিয়তা। জীবনযাত্রার ও শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষের নিজেকে ও পরিবেশকে সুন্দর, সমৃদ্ধ ও উন্নত করার যে প্রবণতা, চিন্তা ও চেষ্টা—তারই মধ্যে নিহিত থাকে তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপার, তেমনি সমষ্টিগত জীবনেরও ব্যাপার। এটাও বলা যায় যে মানুষ তার ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি ও শ্রমশক্তি ব্যবহার করে যা কিছু করে, সেসবের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয় তার সংস্কৃতি। প্রগতিশীল জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের সাধনা ও সংগ্রামের, সেই সঙ্গে দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সাহিত্য, সংগীত, নাটক ও শিল্পকলা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মানুষ তার সাংস্কৃতিক সামর্থ্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। সংস্কৃতি ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক—সব পর্যায়েরই ব্যাপার।
সংস্কৃতি ও উন্নতি সহজসাধ্য ব্যাপার নয়, কঠোর সাধনা ও সংগ্রামের ব্যাপার। ভোগবাদী ও সুবিধাবাদীদের নেতৃত্বে রাষ্ট্র, জাতি ও জনজীবনের কল্যাণ সামান্যই হয়। বাংলা ভাষার দেশে এবং আরো কোনো কোনো দেশে কোনো কোনো মনীষী লিখেছেন, পৃথিবীকে স্বর্গে উন্নীত করাই সংস্কৃতি-সাধকদের মূল লক্ষ্য। এই ধারণার প্রচার দরকার। যারা দরিদ্র ও পশ্চাদ্বর্তী, তাদেরও সংস্কৃতি আছে। জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে তারাও উন্নতি করতে চায়, তাদের মধ্যেও ন্যায়-অন্যায়বোধ, সৌন্দর্যবোধ ও সর্বজনীন কল্যাণবোধ আছে। অগ্রসর সংস্কৃতির প্রভাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা সংস্কৃতিমান থাকে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের নেতৃত্ব সৃষ্টি করে তারা শক্তিশালী হয় এবং নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।
সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি ও রাজনীতি নিয়ে আমাদের গভীর চিন্তা-ভাবনা দরকার। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি ও সংস্কৃতি নিয়ে সুষ্ঠু চিন্তাধারা ও তার পরিপূরক কর্মধারা দরকার। বিশ্বায়নের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য যুদ্ধ চায়, নানা কৌশলে যুদ্ধ লাগায়, যুদ্ধের জন্য অস্ত্র উৎপাদন ও বিক্রি করে, যুদ্ধজোট গঠন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবতাকে মূল্য দেয় না, স্বাধীন চিন্তাশীলতা চায় না, নিজেদের কর্তৃত্বের ও আর্থিক সুবিধার জন্য যুদ্ধ চায়।
দুনিয়াব্যাপী জনগণের জাগরণ দরকার। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। ফিলিস্তিনিদের শেষ করে দেওয়ার জন্য ইসরায়েল যে যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে ইসরায়েলকে সমর্থন ও সহায়তা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অপকর্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররা তাঁদের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ কোনো না কোনোভাবে হয়। ‘জোর যার মুল্লুক তার’—এটা কোনো ব্যাপারেই শেষকথা নয়। দুর্বলরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী হতে পারে। সদিচ্ছা ও সততা দরকার।
দুনিয়াটা যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তাতে জনগণ বঞ্চিত ও প্রতারিত হচ্ছে। রাষ্ট্রব্যবস্থার ও বিশ্বব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে পৃথিবীতে মানুষের জীবনকে অনেক উন্নত ও সুন্দর করে তোলা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে চিন্তা ও কাজ করতে হবে। নৈতিক জাগরণ ও উন্নতি দরকার। বাস্তব পৃথিবীকে স্বর্গে উন্নীত করার লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে মানুষের কর্তব্য নির্ধারণ করে কাজ করতে হবে। কাজের জন্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দল দরকার। বাংলাদেশে অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দল আছে। এগুলো দ্বারা জনজীবন, জাতি ও রাষ্ট্র উন্নতিশীল হচ্ছে না। এ অবস্থায় নতুন সংস্কৃতি, নতুন রাজনীতি, নতুন সংগঠন ও নতুন দল দরকার।
লেখক : বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়