মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫ ১০ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫
ঢাকা-ক্যানবেরা সম্পর্কের নতুন গতি
কামাল উদ্দিন মজুমদার
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪, ১১:৫১ AM
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং শনিবার (২১ মে) থেকে ঢাকায় দুই দিনের সফরে আসছেন। এই সফরে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন, রোহিঙ্গা সংকট, সামুদ্রিক নিরাপত্তা, প্রযুক্তি হস্তান্তর, ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুসহ বিস্তৃত বিষয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।

আশা করা যাচ্ছে এই সফরে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার পাশাপাশি নতুন সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করবে, যা আঞ্চলিক শান্তি, সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারে।  

অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল থেকে শুরু হয়, যখন অস্ট্রেলিয়া তার মিশন চালু করে এবং বাংলাদেশি সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। অস্ট্রেলিয়াই প্রথম পশ্চিমা দেশ যারা বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, গফ হুইটলাম ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ক্ষেত্রে একটি কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা সফর করেছিলেন, যা আজ দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এরপর বিগত ৫০ বছরে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, জনগণের মধ্যে সংযোগ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে সম্পর্কটি বিকাশ লাভ করেছে। 

শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবেনিজ লিখেছেন, ‘আমরা আগামী বছরগুলোতে অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য উন্মুখ। এই বিবৃতি আগামীদিনে বাংলাদেশের সাথে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার জন্য অস্ট্রেলিয়ার দৃঢ় আকাক্সক্ষাকে প্রকাশ করে।  

সাম্প্রতিক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলে ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ভারতের পরে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই অর্থনৈতিক দক্ষতা অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের দেশগুলির যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ।  

বাণিজ্য ও অর্থনীতি : তুলনামূলকভাবে নতুন বাণিজ্য অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের দশম রপ্তানি বাজার। বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ায় বছরে প্রায়। ১.৫ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে, যা দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় ৯৩ শতাংশ। বাংলাদেশ এখন এই বিশেষ খাতে অস্ট্রেলিয়ার বাজারের প্রায় ১২ শতাংশ দখল করেছ। অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিমুখী বাণিজ্য বর্তমানে ৪ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে, যা এক দশক আগে ছিলো ৩০০ মিলিয়ন থেকে কম।  

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। উভয় দেশ ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ফ্রেমওয়ার্ক অ্যারেঞ্জমেন্ট (টিফা) স্বাক্ষর করে, এটি একটি বড় মাইলফলক যা অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের শক্তি এবং গভীরতাকে প্রকাশ করে। টিফা’র অধীনে, উভয় দেশই বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা বাড়াতে এবং বৈচিত্র্য আনতে সহযোগিতা করছে। আরেকটি ইতিবাচক বিষয় হলো এলডিসি-পরবর্তী সময়েও অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত সুবিধা দিতে সম্মত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সংযোগগুলো বৃদ্ধি পেলেও উভয় দেশ এখনও তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর উভয় দেশকে অংশীদারিত্ব জোরদার এবং গুরুত্বপূর্ণ খাতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাণিজ্য সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেবে।   

ভূ-কৌশলগত সহযোগিতা : বঙ্গোপসাগর ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট রুট হিসাবে কাজ করে, যা অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্য ও সংযোগের জন্য অপরিহার্য। তাই স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ার উল্লেখযোগ্য স্বার্থ রয়েছে। ২০২৩ সালের প্রতিরক্ষা কৌশলগত পর্যালোচনা অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ার মূল সামরিক স্বার্থ হল উত্তর ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর এবং সামুদ্রিক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। অস্ট্রেলিয়ান সরকার এখন ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরের এই অঞ্চলে তার অবস্থান দৃঢ় করার জন্য বাংলাদেশ এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য উপকূলীয় দেশগুলোর সঙ্গে তার রাজনৈতিক, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার স্তর বৃদ্ধি করছে।  

অস্ট্রেলিয়া প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করতে বাংলাদেশে একটি প্রতিরক্ষা অফিস প্রতিষ্ঠা করেছে। একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল গঠনে একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ক্রমাগত উন্নয়ন কৌশলের অংশ হিসাবে বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর এলাকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা টেকসই করার জন্য জোর দিচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটে, ভারত মহাসাগর অঞ্চলের একটি প্রভাবশালী দেশ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের দৃঢ় সহযোগিতা আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করবে। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময়, চলমান ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে উভয় দেশ ভারত মহাসাগরে চলমান উদ্বেগ মোকাবেলায় তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করবে বলে আশা করা হচ্ছে।  

রোহিঙ্গা সংকট : বাংলাদেশ বর্তমানে ১.৩ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বোঝা সহ্য করছে। অস্ট্রেলিয়ান সরকার এটি উপলব্ধি করেছে এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মিয়ানমারকে মানবিক সহায়তা দেওয়ার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সফরকালে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে সেখানকার পরিস্থিতি দেখতে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছ। রোহিঙ্গা ইস্যুও সমাধানে বাংলাদেশের অস্ট্রেলিয়ার সমর্থন প্রয়োজন। যার চূড়ান্ত লক্ষ্য বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের মানুষদের প্রত্যাবাসন। কয়েক দশক ধরে নৃশংসতা ও অবিচারের শিকার রোহিঙ্গাদের জন্য জবাবদিহিতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য ক্যানবেরার সঙ্গে একটি ফলপ্রসূ সম্পর্ক আশা করে ঢাকা। 

ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা : অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে যা বহু বছরের অভিবাসন এবং খেলাধুলা ও শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। ২০২৩ সালে অস্ট্রেলিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ১১ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে। প্রায় ১ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসী অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করে এবং সেদেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে। উভয় দেশই তাদের সম্পর্ক জোরদার করতে পারে যৌথ গবেষণা, ভিসা সহজীকরণ, দক্ষ শ্রম অভিবাসন এবং বিমান যোগাযোগের উপর দৃষ্টি দিতে পারে ।

যেহেতু অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশ জাতিসংঘ, ডব্লিউটিও, কমনওয়েলথ এবং ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওআরএ)-এর মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় সদস্য, তাই ঢাকা ক্যানবেরা পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতার পরিবেশ তৈরির জন্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে। এই বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ফোরামগুলির মাধ্যমে, উভয় দেশেরই তাদের অভিন্ন স্বার্থকে এগিয়ে নিতে তাদের কূটনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, জনস্বাস্থ্য, টেকসই উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সামুদ্রিক ও পরিবেশগত নিরাপত্তা জোরদার করা। 

বাংলাদেশ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ২৭তম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। টিফা’র সুবিধার মাধ্যমে, ঢাকা আগামী দশকে শীর্ষ ২০-এর মধ্যে থাকতে আগ্রহী। অস্ট্রেলিয়ান মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা অন্বেষণের দ্বার উন্মুক্ত করবে, বিশেষ করে অবকাঠামো, আইটি এবং অন্যান্য শিল্পে। অস্ট্রেলিয়ান বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে একটি পছন্দসই স্থান খুঁজে পেতে পারে।  

দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে প্রবেশদ্বার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার কৌশলে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনীতি, বিশাল বাজার এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ঢাকার সাথে ক্যানবেরার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তৃত করা হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। একইভাবে, অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক শক্তির সাথে একটি শক্তিশালী জোট এলডিসি-পরবর্তী যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশে সহায়তা করতে পারে।

অবশেষে, বাংলাদেশ আশা করছে মিস ওং-এর সফর উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত সম্পর্কের ইতিমধ্যেই মজবুত ভিত্তিকে আরও মজবুত করবে। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান উষ্ণ, বহুমুখী এবং পারস্পরিকভাবে কল্যাণকর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন জোর দেবে বলেও ঢাকা আশা করে।

 লেখক : গবেষক ও কৌশলগত নিরাপত্তা বিশ্লেষক

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত