ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ জুন দুই দিনের এক ঝটিকা সফর শেষ করে ২২ তারিখ দেশে ফিরে আসেন। দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এটি দ্বিতীয়বারের মতো দিল্লি সফর।
৯ তারিখ তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আরো বেশ কয়েকটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে দিল্লি সফর করেছিলেন। এবারের সফরটি ছিল দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফর। এই সফরটি দিনে নয়, হিসাব হয়েছে ঘণ্টায়, যা শেখ হাসিনার বেলায় অতীতে তেমন একটা ঘটেনি।
শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর থেকেই হিসাব চলছে তাঁর এই সফরে বাংলাদেশ কী পেল আর কী দিয়ে এলো। বিএনপি ও তার মিত্ররা তাদের অতীত ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়ে এসেছে বলে হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দিয়েছে। দলটি ক্ষমতায় ছিল একাধিকবার, তার পরও তারা বুঝতে চায় না ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ বিক্রির জন্য কোনো পণ্য নয়।
আর একটি দেশ কোনো আলু-পটোল নয় যে চাইলেই বিক্রি করা যায়। দেশের মধ্যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক মীমাংসিত ও অমীমাংসিত বিষয় থাকে। এর একটির মীমাংসা হলে আরেকটির উদ্ভব হওয়াটা বিচিত্র নয়। আর বাংলাদেশ ও ভারত যখন দুটি প্রতিবেশী দেশ, এ ক্ষেত্রে এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা আরো বেশি।
তার ওপর আছে এই দুই দেশের অভিন্ন ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও কৃষ্টির একটি মেলবন্ধন। সবার ওপরে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই দেশের মানুষের মধ্যে রক্তের যে বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে, তার অবিচ্ছেদ্য সংযোগ। এটি স্বাভাবিক যেহেতু বর্তমান ভারত শুধু এই অঞ্চলেই নয়, বিশ্বে একটি উদীয়মান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। ভারতের কৌশলগত অবস্থানও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কারণেই বিশ্বের যেসব পরাশাক্তি ভারত মহাসাগরসহ এই অঞ্চলে তাদের অবস্থান দৃঢ় করতে চায়।
তারা উপলব্ধি করে, তা করতে হলে ভারতের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। ভারতও উপলব্ধি করে, তাদের বর্তমান অবস্থানকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এদিক দিয়ে ভারতের অবস্থান তেমন একটি সুবিধার নয়। পাকিস্তানের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশ ছাড়া অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক তেমন একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ নয়। বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন বাংলাদেশের সঙ্গেও এই সম্পর্কের অবনতি হয় মূলত ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাজনিত কারণে। এই প্রেক্ষাপটে যখনই দুই দেশের সরকারপ্রধানরা একে অন্য দেশ সফর করেন, তখনই এই সফরকে ঘিরে দুই দেশের মানুষের মধ্যে নানা প্রত্যাশা ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
দিল্লির প্রতি শেখ হাসিনার একটি বাড়তি আগ্রহ রয়েছে। কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর যখন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরে আসা অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন, তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে আশ্রয় দিয়ে দিল্লিতে থাকার জায়গা করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার সুবিধা হচ্ছে ভারতে যে সরকারই থাকুক, তারা শুধু তাদের স্বার্থে বাংলাদেশের গুরুত্বই বোঝে না, তারা এও বোঝে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকলে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব অনেক গতিশীল হয়।
যদিও শেখ হাসিনার সফরটি ছিল দুই দিনের, তথাপি ভারতের নতুন সরকারের একেবারেই শুরুর দিকের এই সফরটি বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে বলা যেতে পারে। আর যেহেতু এই সফরটি শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের ঠিক আগে আগে হয়েছে, সেহেতু সফরটি অন্য আর দশটি সফরের থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন ছিল। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতৈক্যে উপনীত হওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘোষণার মধ্যে ছিল দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার। নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ভারতের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার এবং আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিই।’
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয়ে রয়ে গেছে, যার সমাধান ভারতের হাতে। এই বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিস্তার পানিবণ্টন, সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধ করা আর দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ২০২৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির নবায়ন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ভয়াবহ সব মানবিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়া ছাড়াও একটি বড় সমস্যা ছিল দুই দেশের ভেতর দিয়ে প্রবহমান অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন বিষয়টি। তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যে পানিবণ্টন জনিত সমস্যা ছিল, তা পাকিস্তান সৃষ্টির দুই বছরের মধ্য পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পানিবণ্টন সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার শুরুতেই ভারতের সঙ্গে যে কয়টি অমীমাংসিত বিষয় মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহণ করে তার অন্যতম ছিল ন্যায্যতার ভিত্তিতে গঙ্গার পানিবণ্টন, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ আর ছিটমহল বিনিময়। ১৯৭২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ১৯ মার্চ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু ঢাকায় একটি বহুমাত্রিক বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী পানিসম্পদ বণ্টন, সেচ, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়গুলোর জন্য একটি যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত গঙ্গায় পানি অনেক গড়িয়েছে।
নদী কমিশন অনেকটা তার কার্যকারিতা হারিয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর পরবর্তী সরকারগুলো সেদিকে তেমন একটা নজর দেয়নি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত এই সব সমস্যা আরো জটিল হয়েছে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে ৩৫ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন করেছেন। পরবর্তীকালে সীমানা চিহ্নিতকরণ চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে সমুদ্র সীমানা সমস্যারও সমাধান করেছেন।
৩৫ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানিচুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হবে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যার বিষয়টি, যা বহু বছর আলোচনায় আছে, কিন্তু সমাধান হচ্ছে না। গঙ্গার পানিবণ্টন সমস্যার শুরু ১৯৬১ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু হওয়ার পর থেকে। এই বাঁধ নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ।
ফারাক্কা বাঁধ তার লক্ষ্য পূরণে তেমন একটা সফল হয়নি, বরং উজানে সিকিমে বাঁধ দেওয়ার কারণে নতুন করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে নতুন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ নদীভাঙন সমস্যা। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। কলকাতা বন্দরের তেমন একটা উন্নতি হয়নি। শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফরের সময় গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। একই সঙ্গে আলোচনায় এসেছে তিস্তার পানিবণ্টন বিষয়টি।
উজানের পানি ছেড়ে দিলে ভাটি অঞ্চলে তার ব্যবহার যদি বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবমুখী উপায়ে ব্যবস্থাপনা করা না যায়, তাহলে সেই পানি গড়িয়ে সমুদ্রে যাবে। এতে কারো কোনো লাভ নেই। বাংলাদেশে এই বিষয়টি উপলব্ধি করে এখন তিস্তার প্রাপ্য পানিকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করছে। এর জন্য একটি প্রকল্প তৈরির আলোচনা হচ্ছে, যাতে চীন আগ্রহ দেখিয়েছে।
চীনের আগ্রহের কথা জেনে ভারতও শেখ হাসিনার সফরের সময় তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। বলেছে, সমস্যার সমাধান খোঁজার জন্য তারা বাংলাদেশে একটি কারিগরি টিম পাঠাবে। বাংলাদেশ এই বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। নিজেদের স্বার্থে যেকোনো দেশ তাদের আগ্রহের কথা জানাতেই পারে। শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা নির্ভর করবে বাংলাদেশের নিজস্ব স্বার্থের ওপর।
শেখ হাসিনা দিল্লি থেকে ফিরে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, যাদের সহায়তা নিলে বাংলাদেশের লাভ হবে, বাংলাদেশ তাদেরই সহায়তা নেবে। এর চেয়ে যৌক্তিক বক্তব্য কোনো সরকারপ্রধানের দেওয়া সম্ভব নয়। এই পানিবণ্টন ইস্যু নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নরেন্দ্র মোদিকে তিন পৃষ্ঠার এক দীর্ঘ চিঠি লিখে তাঁকে না জানিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির গঙ্গা ও তিস্তার পানিবণ্টন বিষয় নিয়ে আলোচনা করায় তার প্রতিবাদ করেছেন। এও বলেছেন, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির সময় বলা হয়েছিল, গঙ্গা নদীতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য নদী ড্রেজিংয়ের জন্য কেন্দ্রের যে অর্থ বরাদ্দ করার কথা, তা তারা করেনি।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এ কথা বলার অধিকার তাঁর আছে। তবে তিস্তার ভাটিতে বাংলাদেশের সীমানায় নিজেদের স্বার্থে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করলে অন্য কোনো মহল যদি তার প্রতিবাদ করে, বাংলাদেশকে কেন তা শুনতে হবে তারও ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আর মনে রাখা দরকার, গঙ্গা ও তিস্তা দুটিই আন্তর্জাতিক নদী আর এমন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কিছু আন্তার্জাতিক আইন আছে, যা সংশ্লিষ্ট সবাইকে পালন করতে হয়।
আরো একাধিক বিষয় নিয়ে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সমঝোতা হয়েছে, যার অন্যতম হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করা। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান রেলব্যবস্থা আরো সম্প্রসারিত করা। এই ব্যবস্থার অধীনে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে রেলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার বিকল্প পথ সৃষ্টি করার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।
বর্তমানে এই রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনে ভারত বাংলাদেশের বন্দর, সড়কপথ ব্যবহার করে। ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ পূর্ববর্তী সময়ে সব ব্যবস্থাই চালু ছিল। পূর্ব বাংলায় ব্রিটিশরা যে রেলব্যবস্থা চালু করেছিল, তার নামই ছিল ‘আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে’। সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রামে। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারতের যুদ্ধের (৫ আগস্ট-২৩ সেপ্টেম্বর) পর এসব ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন তার বেশ কয়েকটি আবার চালু হয়েছে। শুরু হয়েছিল দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যাত্রীবাহী বাস চলাচলের মাধ্যমে শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময়।
১৯৯৯ সালের ১৯ জুন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে এই বাস সার্ভিস চালু করেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সেদিন সন্ধ্যায় তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ডেকে বলেন, শেখ হাসিনা শুধু ভারতের কাছে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বই বিক্রি করে দেননি, তিনি বাংলাদেশের পরিবহনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেলপথে পণ্য পরিবহনের বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা হলে পুরনো কায়দায় বিএনপি ও তার মিত্র ওয়ানম্যান পার্টির নেতারা একই কায়দায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন।
শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় একটি সমঝোতা স্মারক ছিল দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণ। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিনিট ট্রেন যাতায়াত করে। ঢাকা-কলকাতা, খুলনা-কলকাতা এবং একটি ঢাকা-নিউ জলপাইগুড়ি। এই তিনটি ছাড়া দ্রুততম সময়ে রাজশাহী-কলকাতা রুটেও নতুন ট্রেন সার্ভিস চালুর কথা রয়েছে। তবে যে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তা হচ্ছে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করতে পারার সমঝোতা। কেউ কেউ মনে করছে, ভারতকে এই সুবিধা দিলে তারা তা ব্যবহার করে পণ্য হিসেবে সামরিক সরঞ্জামও পরিবহন করতে পারে, যা বাংলাদেশের অপর বন্ধু রাষ্ট্র চীনকে নাখোশ করবে।
কারণ উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে চীনের সঙ্গে ভারতের সর্বক্ষণ একটি উত্তেজনা বিরাজ করে। এই বিষয়টি চুক্তি স্বাক্ষরের সময় স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ থাকতে হবে। এই ব্যবস্থায় ভারত কী কী পণ্য পরিবহন করতে পারবে এবং পরিবহনকালে প্রয়োজনে তা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও শুল্ক বিভাগের পরিদর্শনের এখতিয়ার থাকবে। এক দেশ থেকে অন্য দেশের ওপর দিয়ে কোনো পণ্য পরিবহনের সময় অবকাঠামো ব্যবহার বাবদ ন্যায্য ও যৌক্তিক শুল্ক বা ফি নেওয়া বা দেওয়ার নিয়ম আছে। ন্যায্যতার ভিত্তিতে তারও সুরাহা করতে হবে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিরাজমান এমন সব চুক্তির আলোকেই সম্ভাব্য চুক্তিগুলো করতে হবে। এমন চুক্তি করতে হবে, যাতে সব পক্ষই সমান লাভবান হয়। ১৯৭৬ ও ১৯৮৪ সালে নেপাল ও ভুটান বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি করেছিল। কিন্তু ভারতের অনুমোদন না পাওয়ায় তাদের ভুখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল বা ভুটান এই সুবিধা নিতে পারেনি। আশা করা যায়, এবার এই সমস্যার সমাধান হবে। এই ব্যবস্থাটি সবার স্বার্থ রক্ষা করে সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য একটি নতুন দ্বার উন্মুক্ত হবে।
দুই দেশের সরকার পারস্পরিক সমতা, ন্যায্যতা আর সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখিয়ে যেকোনো সমস্যারই সমাধান সম্ভব, এমনকি সীমান্তে মানুষ হত্যারও। এর সব থেকে বড় প্রমাণ ছিটমহল, সীমান্ত চিহ্নিতকরণ, আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের মাধ্যমে সমুদ্র সীমানার মতো সমস্যাগুলো যদি সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমাধান হতে পারে, একই চিন্তাধারায় যেকোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক