শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫ ১৩ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন
শেখ হাসিনার পতনের জন্য আওয়ামী লীগের যে চারজন দায়ী
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০২৪, ৭:২০ PM আপডেট: ২২.০৮.২০২৪ ৮:৩০ PM
‘আমি আত্মগোপনে আছি, বড়জোর আপনার সাথে ফোনে কথা বলতে পারি’; ‘নিরাপদ কোনো স্থানে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করব’; ‘আপনার গতিবিধি নজরদারি করা হবে, তাই আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারব কি না, জানি না’; ‘আমি আপাতত আপনার সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে পারছি না’।

শেখ হাসিনাসহ তাঁর দল আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী ও সাবেক সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সদস্যদের পাঠানো কিছু বার্তা এগুলো; যা দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পেয়েছে।

গত এক সপ্তাহে এই ব্যক্তিদের কারও কারও সঙ্গে অজ্ঞাত স্থানে দেখা করতে এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রতিশোধের শিকার হওয়ার শঙ্কায় আত্মগোপনে থাকা কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হয়েছে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
 
গণবিক্ষোভের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য হন শেখ হাসিনা

গণবিক্ষোভের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য হন শেখ হাসিনা

দলটির এক নেতা বলেন, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নির্যাতনের কারণে জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। বিএনপিকে সর্বশেষ নির্বাচনে আনতে পারলে সেই ক্ষোভ হয়তো থামানো যেত। তাতে হয়তো আমরাই আবার জিততে পারতাম এবং দল ক্ষমতায় থাকত।

গত ৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ তাঁদের অনেকেই আগে থেকে আঁচ করতে পারেননি। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তটি... তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য, এমনকি ঘনিষ্ঠ সহযোগীদেরও ‘পুরোপুরি বিস্মিত’ করেছে। এক নেতা বলেন, ‘আমরা টেলিভিশনের খবর থেকে এটা জানতে পারি।’

তাদের কয়েকজনের দাবি, পুরোপুরি আকস্মিকভাবে শেখ হাসিনার চলে যাওয়ার ঘটনা আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের জীবন বিপদের মধ্যে ফেলেছে। ‘বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী এবং সুযোগসন্ধানীরা’ আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দলীয় কার্যালয়গুলো নিশানা বানায়। চালানো হয় অগ্নিসংযোগ, লুট, হত্যা।

আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর আমরা নিজেদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য খুব সামান্যই সময় পাই।’

গ্যাং অব ফোর
আত্মগোপনে থাকা এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, নিজেদের ভেতরে থাকা চারজনের একটি দল তাঁর (শেখ হাসিনা) পতনে নেতৃত্ব দিয়েছে। এই ব্যক্তিদের ওপর তাঁর ছিল অন্ধবিশ্বাস। শেখ হাসিনার যে সহজাত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল, তা তিনি এদের কারণে হারিয়ে ছিলেন।

সরকার পতনের জন্য দলের অভ্যন্তরীণ একটি স্বার্থগোষ্ঠীকে দায়ী করে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের একজন বলেছেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) আমাদের কথা শোনেননি।’ 

এই গোষ্ঠীকে ‘গ্যাং অব ফোর’ বলে আখ্যায়িত করেন নেতাদের একজন। তিনি বলেন, চারজনের এই গোষ্ঠীটি শেখ হাসিনাকে বর্তমান ও বাস্তব অবস্থা বুঝতে দেয়নি।

এই চারজন হলেন- শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বেসরকারি শিল্প বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

সাবেক সরকারের এক নেতা বলেন, ‘চারজনের এই দল তাঁর (শেখ হাসিনা) পতনে একরকম পরোক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছে। এই ব্যক্তিদের ওপর তাঁর ছিল অন্ধবিশ্বাস। তাঁর যে সহজাত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল, তা তিনি তাঁদের কারণে হারিয়েছেন।’

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বিগত কয়েকদিনে এই নেতাদের কারও কারও সঙ্গে অজ্ঞান স্থানে দেখা করতে এবং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রতিশোধের শিকার হওয়ার শঙ্কায় আত্মগোপনে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হয়েছে। 

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিএনপিকে না আনা শেখ হাসিনার একটি ‘বড় ভুল’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। সূত্রগুলো বলেছে, আওয়ামী লীগের কিছু নেতা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে লন্ডনে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মুহুর্ত

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মুহুর্ত

সূত্রের ভাষ্যমতে, ‘আড়ালে থাকা একটি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রস্তাবও দেওয়া হয় (বিএনপিকে নির্বাচনে আনার)। আমাদের ধারণা, তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় চ্যানেলটি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের এক বছর আগেই ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়... কিন্তু শেখ হাসিনা ওই প্রস্তাবে সবুজসংকেত দেননি।’

আওয়ামী লীগের একজন নেতার বক্তব্য- বিএনপি চেয়ারপারসনের ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার বিষয়টি শেখ হাসিনার প্রত্যাখ্যান করা ছিল ‘সাংঘাতিক ভুল’। কেননা, একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিএনপিকে নির্বাচনে আনা গেলে বিরোধীদের রাগ–ক্ষোভ হয়তো মিটে যেত।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্তও একপ্রকার শান্তিপূর্ণই ছিল এই আন্দোলন

জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্তও একপ্রকার শান্তিপূর্ণই ছিল এই আন্দোলন

তিনি আরও বলেন, ‘দলে থাকা সুযোগসন্ধানীদের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নির্যাতনে জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা বুঝেছিলাম। বিএনপিকে নির্বাচনী তরিতে ওঠানো গেলে সেই ক্ষোভ হয়তো থামানোও যেত। তাতে আমরাই আবার জিততে পারতাম এবং দলও ক্ষমতায় থাকতে পারতো।’

দলটির নেতা–কর্মীরা মনে করেন, বিশেষ করে গত জানুয়ারির নির্বাচনে জেতার পর শেখ হাসিনা আরও একগুঁয়ে হয়ে ওঠেন এবং সেসময় তিনি কারো কোনো পরামর্শ শোনেননি। এ প্রসঙ্গে ওই নেতা বলেন, ‘টানা চতুর্থবার জিতে তিনি (শেখ হাসিনা) অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং কোটা সংস্কার নিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে সৃষ্ট ক্ষোভের মাত্রা উপলব্ধি করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হন।’

আত্মগোপনে থাকা কয়েকজনের দাবি, কৌশলে কিছু নেতা শেখ হাসিনাকে জুলাইয়ের শুরুতে ছাত্র বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহবান জানান। তবে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। সাবেক সরকারের কফিনে শেষ পেরেকটি বসে তখন, যখন একই মাসে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা নিরাপত্তা হেফাজতের নামে সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে যায় এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন প্রত্যাহারে জোরপূর্বক প্রতিশ্রুতি আদায় করে ছেড়ে্দেয়। এই কৌশল হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। 
ডিবি কার্যালয়ে ৬ সমন্বয়ক

ডিবি কার্যালয়ে ৬ সমন্বয়ক

আন্দোলন প্রত্যাহারে কীভাবে জোরপূর্বক প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয়েছে, ছাত্রনেতারা সেই বিষয়টি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেন। এই ঘটনাটি পরপর আরও কিছু ঘটনার সূত্রপাত ঘটায় এবং ঢাকামুখী ছাত্রজনতার লংমার্চকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে একপর্যায়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

সরকারের পটপরিবর্তনের পর জীবনের শঙ্কায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা–কর্মী ও বুদ্ধিজীবী দেশজুড়ে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেন। আশ্রয় নেওয়া এই ৬২৬ জনের মধ্যে ছিলেন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা, ৫ জন বিচারক, বেসামরিক প্রশাসনের ১৯ কর্মকর্তা, ২৮ পুলিশ কর্মকর্তা, বিভিন্ন পদের ৪৮৭ জন পুলিশ সদস্য, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ নানা পেশার ১২ জন ও ৫১টি পরিবার।
পুড়িয়ে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ বাসভবন

পুড়িয়ে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ধানমন্ডি ৩২ বাসভবন

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা আত্মগোপন করেছেন, কেউবা গ্রেপ্তার হয়েছেন। নেতারা বলছেন, ৭৫ বছরের পুরোনো যে দল টানা ১৫ বছরের বেশী রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনা করেছে, তারাই এখন অস্তিত্ব সংকটে।

পুনর্গঠন ও দল গোছানোর ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের একজন বলেন, ‘দলকে পুনর্গঠনে তাঁকে (শেখ হাসিনা) তৃণমূল পর্যায়ের লোকজন বাছাই করতে হবে, তাঁদের মধ্যে থাকবেন কিছু তরুণ আওয়ামী নেতা; মাঠপর্যায়ে যাদের ব্যাপারে মানুষের আস্থা আছে, লোকজনের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ আছে এবং অবশ্যই পরিবারের (শেখ হাসিনা) প্রতি অনুগত... সম্ভবত এ যাত্রা দীর্ঘ হবে।’
সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ-সহিংসতা

সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ-সহিংসতা

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শক্ত ঘাঁটি ও কর্মী বাহিনী রয়েছে। অনেকে বিপথগামী হয়েছেন, যেমনটা ঘটেছে সুবিধাবাদীদের ক্ষেত্রে। সমর্থকদের মধ্যেও এমনটা থাকবে। কিন্তু আমাদের অন্তত এমন কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী থাকা দরকার; যারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং নির্বাচন যখনই হোক, তাতে অংশ নেবে। এখন এটাই প্রয়োজন।’

আওয়ামী লীগের নেতাদের একজন বলেন, ‘আন্দোলন দমাতে পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের কারণে দেশের মানুষ এখনও ক্ষেপে আছেন। আমাদের পক্ষ থেকে তাদের সময় দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার বা বিএনপি কিংবা জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সরকার যে–ই কয়েকটা বছর ক্ষমতায় থাকুক, আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা আছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের আবার সংগঠিত হওয়ার কথা ভাবতে হবে।’

বর্তমানে দেশে এখনও শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাব বিরাজ করায়, শেখ হাসিনার পরিবার ও এর উত্তরসূরি সজীব ওয়াজেদ জয়ের এই সময়টায় খুব কম বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত