ঠিক একমাস আগে গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫ই অগাস্টের ওই ঘটনার তিনদিন পর শপথ গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার।
কর্মবিরতি ও হামলার ভয় কাটিয়ে আবারও মাঠে ফিরেছে পুলিশ। পোশাক ও লোগো পরিবর্তনসহ নানান সংস্কারের মাধ্যমে বাহিনীকে জনবান্ধব করে গড়ে তোলার কথা বলছে নতুন সরকার। এদিকে, হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ আমলের এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে হচ্ছে একের পর এক মামলা হতে দেখা যাচ্ছে, গ্রেফতারও হয়েছেন অনেকে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার একাধিক মামলার সাজা বাতিল করা হয়েছে। মুক্তি দেওয়া হয়েছে কারাগারে বন্দী বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের। সেইসঙ্গে জামিন দেওয়া হয়েছে জঙ্গি কার্যক্রমসহ গুরুতর মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে, যা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।
প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল
গত এক মাসে প্রশাসনিক বিভিন্ন পদে ব্যাপক রদবদল হতে দেখা গেছে, বিশেষতঃ অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর। স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নতুন করে বদলি, পদায়ন ও নিয়োগ করা হয়েছে কয়েকশ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে।
অনেকেই হয়েছেন বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও (ওএসডি)। বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে।
আওয়ামী লীগ আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে ইতোমধ্যেই বাদ পড়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের দায়িত্বে থাকা তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করা মাসুদ বিন মোমেন।
একইভাবে, চাকরি হারিয়েছেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।
তার জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আবদুর রহমান খান।
এর আগে, গত ছয়ই অগাস্ট চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের চুক্তি বাতিল করে নতুন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) করা হয় অতিরিক্ত আইজিপি’র দায়িত্বে থাকা মো. ময়নুল ইসলামকে।
বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মনিরুজ্জামানসহ আরও অনেক কর্মকর্তাকে।
অন্যদিকে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীসহ আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।
প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে যাদেরকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারা ‘শেখ হাসিনার সরকারের অনুগত’ ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের জায়গায় আগের কোণঠাসা বা বঞ্চনার শিকার কর্মকর্তারা প্রাধান্য পাচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে।
সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষার সবধাপে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও গত দেড় যুগে নিয়োগ না পাওয়া আড়াইশ’র বেশি ব্যক্তিকেও সম্প্রতি নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, কাজে গতি আনতেই প্রশাসনে রদবদল আনা হচ্ছে।
“দায়িত্বে থেকে এখন যারা সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না, সে সব জাতীয় জায়গায় দ্রুত পরিবর্তন আনা হচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সংযুক্ত উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।
তিনি এটাও জানিয়েছেন যে, প্রশাসনের আগের চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ পর্যায়ক্রমে বাতিল করা হবে।
পুলিশের থানায় ফেরা
গত পাঁচই অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন এলাকার বহু থানায় নজিরবিহীন হামলার ঘটনা ঘটে। ওই সময় সারা দেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে অন্তত ৪৫০টি ‘আক্রান্ত’ হয়েছিল বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন।
ভাঙচুর করে থানা জ্বালিয়ে দেওয়া, অস্ত্র ও মালামাল লুট, এমনকী পুলিশ হত্যার ঘটনাও তখন ঘটতে দেখা গেছে। সরকার পতনের আগে-পরে সহিংসতায় সারা দেশে পুলিশের কমপক্ষে ৪৪ জন সদস্য নিহত হন বলে জানান কর্মকর্তারা।
এমন পরিস্থিতিতে কর্মস্থলে নিরাপত্তা, পুলিশ হত্যার বিচার, ক্ষতিপূরণসহ বেশকিছু দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করেন পুলিশ সদস্যরা। এতে চুরি-ডাকাতির ঘটনা বেড়ে যাওয়াসহ দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতে ব্যাপক অবনতি ঘটে।
একপর্যায়ে, স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বেচ্ছাসেবীরা রাত জেগে পাড়া-মহল্লায় পাহারা দেওয়া শুরু করেন।
ফলে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সারা দেশে ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেন।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বেশ কয়েক দফা বৈঠকের পর পুলিশের দাবি পূরণের আশ্বাস দেন।
সেইসঙ্গে, কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলেন, ১৫ই অগাস্টের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে তিনি চাকরি করতে ইচ্ছুক নন বলে ধরে নেয়া হবে।
এ অবস্থায় ১১ই অগাস্ট কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে থানায় ফেরেন পুলিশ সদস্যরা। যদিও ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এদিকে, মনোবল বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশকে জনবান্ধব করে গড়ে তুলতে বাহিনীর পোশাক ও লোগো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
যদিও পোশাক ও লোগো পরিবর্তনের ফলে পুলিশের কাজে কতটুকু পরিবর্তন আসবে, সেটি নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছেন, প্রশ্ন আছে বিপুল ব্যয় নিয়েও।
তারপরও সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে পোশাক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করছেন বাহিনীর প্রধান।
“এই পোশাক পরে সাম্প্রতিক আন্দোলনে অনেক ঘটনা ঘটেছে...পোশাক একটি মাইন্ডসেট তৈরি করে। সে কারণে এটি পরিবর্তন করা প্রয়োজন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নতুন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম।
“পুলিশ যেন বাড়াবাড়ি না করে, মানুষ যেন কমিউনিটি ট্রাস্টটা পায়, সেই চেষ্টাই আমরা করবো,” বলেন মি. ইসলাম।
বিচার বিভাগে বড় পরিবর্তন
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যূতির পর বিচার বিভাগেও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে দেখা গেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে গত ১০ই অগাস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরাও তার সঙ্গে পদত্যাগ করেন।
এ ঘটনার পর নতুন বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন আপিল বিভাগের বিচারক সৈয়দ রেফাত আহমেদ। একইভাবে, আপিল বিভাগে নতুন আরও চার বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এদিকে, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের স্থলাভিষিক্ত হন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামান।
মি. আসাদুজ্জামান বিএনপির কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ফলে দলীয় বিবেচনায় তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কী-না, সে প্রশ্নও উঠতে দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে, আগের নিয়োগ বাতিল করে সম্প্রতি সারা দেশে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ২২৭ জন আইনজীবীকে নতুন নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের ৬৬ আইনজীবীকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ১৬১ আইনজীবীকে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
পদত্যাগের হিড়িক
শেখ হাসিনার পতনের পর সরকারি, আধা-সরকারি, এমনকী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছাড়ছেন, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ, অপমান-অপদস্তসহ নানান চাপের মুখে কর্তা ব্যক্তিরা পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে গত চার সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিগগিরই নতুন উপাচার্য নিয়োগ হবে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
সেইসঙ্গে, কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে গত নয়ই অগাস্ট পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তার আগের দুইদিনে ডেপুটি গভর্নরসহ অন্তত চারজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সাদা কাগজে লিখিত দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করানো হয়।
পরবর্তীতে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) সদ্য সাবেক নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরকে নতুন গভর্নর করা হয়।
একইভাবে, গত কয়েক সপ্তাহে ঢাকা ওয়াসা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিরা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
এদিকে, বৃহস্পতিবার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন পদত্যাগের ঘোষণা দিতে পারে বলে জানা যাচ্ছে।
অন্যদিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকসহ অন্তত আটটি ব্যাংকের আগের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এছাড়া প্রেসক্লাবের মতো প্রতিষ্ঠানেও শীর্ষপদে পরিবর্তন আসতে দেখা গেছে। একই ঘটনা ঘটেছে, সময় ও একাত্তর টেলিভিশনে।
ড. ইউনূস ও খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল
সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিচার বিভাগে পরিবর্তন এসেছে। সেইসঙ্গে, পাল্টে গেছে অনেক মামলার রায়।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরজাহান বেগমকে।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার আগের দিন তাদের দু’জনেরই সাজা বাতিল করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
একইভাবে, তারা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা অর্থ আত্মসাতের মামলা থেকেও সম্প্রতি খালাস পেয়েছেন। যদিও শুরু থেকেই অধ্যাপক ইউনূস বলে আসছিলেন যে, ‘হয়রানি’ করার জন্যই ভিত্তিহীন মামলায় তাদের ফাঁসানো হয়।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনার আমলে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের জেল দেওয়া হয়েছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। কিন্তু সরকার পতনের একদিন পরেই রাষ্ট্রপতি তার সাজা মওকুফ করে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এছাড়া মানহানির অভিযোগে দায়ের করা পাঁচটি মামলা থেকেও খালাস পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। মামলাগুলো ‘মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ ছিল বলে অভিযোগ করে আসছিল বিএনপি।
এর বাইরে, মুক্তি দেওয়া হয়েছে কোটা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চলাকালে গ্রেফতার শিক্ষার্থীদের।
কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন গত দেড় দশকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার ও কারাবন্দী বিএনপি, জামায়াতে ও তাদের সমমনা দলগুলোর শীর্ষ নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য নেতা-কর্মী, যাদের মধ্যে ২০০৭ সালে যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন গিয়াস উদ্দিন আল মামুনও রয়েছেন।
এছাড়া জামিনে মুক্তি পেয়েছেন জঙ্গিবাদের অভিযোগে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দীন রাহমানী এবং হত্যা মামলার আলোচিত আসামি শেখ আসলাম, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হতে দেখা যাচ্ছে।
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সক্রিয় জামায়াত
ক্ষমতা হারানোর চারদিন আগে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ নম্বর ধারায় ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ ও তাদের ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’কে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় বসার তৃতীয় সপ্তাহে এসে সিদ্ধান্ত বদলে গেছে। বাতিল করা হয়েছে আগের প্রজ্ঞাপন। ফলে দলটির নেতাকর্মীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। সারা দেশের পাড়া-মহল্লায় তাদেরকে জনসংযোগ করতে দেখা যাচ্ছে।
এদিকে, ক্ষমতা ছাড়ার পর উল্টো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আদালতে রিট আবেদন করে ‘সারডা সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠন। যদিও হাইকোর্ট সেই রিট আবেদেন খারিজ করে দিয়েছে।
১৫ই অগাস্টের ছুটি বাতিল
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নেওয়ার পর গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুদিন ১৫ই অগাস্টে সারা দেশে ব্যাপক আয়োজনে শোকদিবস পালিত হতে দেখা গেছে।
জাতীয় দিবস হিসেবে ওইদিন সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেটিও বদলে গেছে।
শপথ নেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ১৫ই অগাস্টের সরকারি ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় করে অন্তর্বর্তী সরকার।
এ ঘটনার পর গত ১৫ই অগাস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে দাঁড়াতে দেয়নি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কর্মী-সমর্থকরা।
নানান দাবিতে বিক্ষোভ-ঘেরাও
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরবর্তী প্রায় তিন সপ্তাহজুড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নানান দাবিতে একের পর এক বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের বিক্ষোভ।
‘রেস্ট প্রথা’ বাতিল করে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে গত ২৫শে অগাস্ট সারাদিন সচিবালয় অবরোধ করে রেখেছিলেন এই আধা-সামরিক বাহিনীর প্রায় দশ হাজার সদস্য।
আলোচনার মাধ্যমে বিকেলে সরকারের পক্ষ থেকে ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিল ঘোষণা করা হলেও আন্দোলন থামাননি তারা।
পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের জড়িয়ে পড়েন আনসার সদস্যরা, যাতে উভয়পক্ষের অর্ধ-শতাধিক মানুষ আহত হয়।
অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার সাড়ে তিনশ’র বেশি আনসার সদস্যকে গ্রেফতার দেখিয়ে পরবর্তীতে কারাগারে পাঠানো হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক সরকারি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান ও ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও সচিবালয় আশপাশে সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে পুলিশ।
সেইসঙ্গে প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন, বিচারপতি ভবন, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ ও মৎস্যভবন সংলগ্ন এলাকাতেও সভা-সমাবেশ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনাসহ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা
দুর্নীতি, হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানান অভিযোগ থাকার পরও গত দেড় দশকে যাদের বিরুদ্ধে সেভাবে আইনি ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি, আগের সরকারের সেইসব ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখন মামলা হতে দেখা যাচ্ছে।
এর মধ্যে ইতোমধ্যেই শতাধিক মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, যেগুলোর বেশিরভাগই হত্যা মামলা।
একইভাবে আসামি হয়েছেন সজীব ওয়াজেদ, সায়মা ওয়াজেদ, শেখ রেহানাসহ আওয়ামী লীগ সভাপতির পরিবার ও নিকট আত্মীয়দের অনেকে।
সেইসঙ্গে, সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতার বিরুদ্ধে মামলা হতে দেখা গেছে।
বিভিন্ন মামলায় ইতোমধ্যেই আনিসুল হক, টিপু মুনশি, দীপু মণি, সালমান এফ রহমান, জুনাইদ আহমদ পলকসহ অনেকে গ্রেফতার হয়েছেন। আদালতে নেওয়ার সময় তাদের অনেকের উপর হামলাও হয়েছে।
বাতিল করা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ আগের সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট।
এছাড়াও গ্রেফতার হয়েছেন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলসহ অনেকে।
তবে কিছুক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই ধালাওভাবে বিভিন্ন মামলায় আসামি করার অভিযোগ রয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের কোনো শাস্তি হবে কী-না, সেটি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।