রবিবার ২০ জুলাই ২০২৫ ৫ শ্রাবণ ১৪৩২
রবিবার ২০ জুলাই ২০২৫
দুই দল দুই দিকে, জনগণ মাঝখানে
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৩, ৪:৪৩ PM
ক্ষমতা ও শক্তি এ দুটি এক নয়, চরিত্রগতভাবেই আলাদা। ক্ষমতা আমরা অন্যের ওপর প্রয়োগ করতে পছন্দ করে থাকি, কিন্তু শক্তি থাকে ভেতরে। শক্তি থাকলে ক্ষমতা পাওয়া সহজ হয়, কিন্তু ক্ষমতা থাকলেই যে শক্তি থাকবে কিংবা যত ক্ষমতা তত শক্তি এমন অবস্থা ঘটবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের জীবনে ক্ষমতার অভাবের ব্যাপারটা বেশ স্পষ্ট। এই অভাবের তালিকা তৈরির আবশ্যকতা দেখি না; কিন্তু তার জীবনে শক্তি কিছুটা রয়েছে বইকি, যেজন্য টিকে রয়েছে, যদিও কতটা যে বেঁচে আছে সে নিয়ে জিজ্ঞাসাদি প্রায়ই করা হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষের জন্য শক্তির জায়গাটা কোথায়? সেটা হলো প্রধানত তার ইহজাগতিকতায়। বলাই বাহুল্য, এ ইহজাগতিকতার একটা বড় উপাদান হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। এ প্রসঙ্গে আবার আসব। তার আগে স্মরণ করা যাক, জনগণের শক্তি খর্বের চেষ্টা বহুভাবে বহুবার করা হয়েছে, এখনও যে করা হচ্ছে না তা নয়। খুবই করা হচ্ছে। কিন্তু করছে কে?

করছে কায়েমি স্বার্থ। এ কায়েমি স্বার্থের ব্যাপারটা খুব শোনা যায়। আমরা বলিও, কিন্তু এ বিষয়টা কী, তা সব সময় বোঝা যায় না। ছাত্রজীবনে এক বুদ্ধিমান বন্ধু বলেছিল আমাকে, ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলো। কায়েমি স্বার্থ কথাটা আমিই বলেছিলাম তাই আমারই দায়িত্ব তাকে বুঝিয়ে দেওয়ার, ঘটনাটা দাঁড়িয়েছিল এ রকমের। কী কী বলেছিলাম মনে নেই, তবে ব্যাখ্যা শুনে সে বলেছিল বুঝেছে। বুঝেছে যে ওই বিষয়টা অন্য কিছু নয়, বিদ্যমান ব্যবস্থা বটে। তা সে ভুল বুঝেছিল তা বলা যাবে না। বিষয়টা ওই রকমেরই। বিদ্যমান ব্যবস্থাটা হচ্ছে ক্ষমতাবানদের রক্ষীবাহিনী। এ ব্যবস্থা যারা ক্ষমতাধর তাদের স্বার্থেই তৈরি হয়েছে এবং ওই স্বার্থই রক্ষা করতে সর্বদা সতর্ক ও ব্যস্ত থাকে। বলা যায়, ওই কায়েমি স্বার্থই বাঙালির শক্তি খর্ব করার চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। যে ব্যবস্থার ভেতরে আমাদের বসবাস সেটা প্রধানত অর্থনৈতিক, তার পরে সামাজিক। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য আছে। তবে সেটা পরিমাণগত, গুণগত নয়। কেননা সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়েই বিস্তর ক্ষমতা রাখে। আমরা সমাজে বসবাস করি, কিন্তু সেখান রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বিদ্যমান এবং রাষ্ট্র নিজেকে তো বটেই, সমাজকেও রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে।

সমাজ ও রাষ্ট্র কেউই সাধারণের মিত্র নয়। আগে ছিল না, এখনও হয়নি। অথচ এই মৈত্রীর জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি, দুবার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনও হয়েছি। সমাজেও ধাক্কা লেগেছে, সে নড়বড়ে হয়েছে কিছুটা; কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন না এসেছে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায়, না সামাজিক বিন্যাসে। তারা উভয়েই কায়েমি স্বার্থের তাঁবেদারি করছে, যে স্বার্থ মানুষের শক্তি খর্ব করার কাজে নিযুক্ত। মানুষের অধিকার কেড়ে নেয় ক্ষমতা, আবার তা ফিরিয়েও দিতে পারে ক্ষমতাই। ক্ষমতা প্রয়োগের নানাবিধ দৃষ্টান্ত রয়েছে। বাঙালী যে বাঙালি তা কোন কারণে? প্রধান কারণ এই যে, সে বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। হিসাব নিলে দেখা যাবে, এ ভাষার ওপর বহুবিধ আক্রমণ হয়েছে, সামাজিক আক্রমণ ও রাষ্ট্রীয় আক্রমণ। তার আগে বংলা অভিজাতদের ভাষাও ছিল না, রাষ্ট্রভাষাও ছিল না। ক্ষমতাবানদের ভাষা ছিল সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি; বাংলা ছিল সাধারণ মানুষের ভাষা। এ ভাষা কেউ চেষ্টা করেছেন সংস্কৃতবহুল করতে, কারও উদ্যোগ ছিল আরবি-ফারসি দিয়ে ভারাক্রান্ত করবার। অনেক সংগ্রামের পর বাংলা ভাষা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে; কিন্তু পুরোপুরি যে হয়েছে তা নয়। উচ্চশিক্ষা এবং উচ্চ আদালতে সে বেশ কোণঠাসা, ধনীগৃহে খুব যে পাঙ্ক্তেয় তাও নয়। বিশ্বায়ন আজ তাকে জব্দ করছে আগে যেমন ওই কাজটি করত ঔপনিবেশিকরা।

এ হচ্ছে বাইরের হস্তক্ষেপ। হস্তক্ষেপ ভেতর থেকেও ঘটেছে বইকি! শব্দ বাদ দাও, হরফ বদলাও, বর্ণ বিসর্জন দাও, বানান সোজা করো এসব নির্দেশ থেকে থেকে এসেছে। এসব উৎপাত পাকিস্তানি আমলে বেশ দেখা যেত। স্বাধীন বাংলাদেশেও যে তেমনটা ঘটবে এ ছিল নিতান্ত অপ্রত্যাশিত, বলা চলে অকল্পনীয়। কিন্তু সেটাই তো ঘটে গেছে। এখন বাঙালিকে আপনি আর বাঙালী হিসেবে ডাকতে পারছেন? ‘দীর্ঘ ঈ’-কারের জায়গায় ‘হ্রস্র ই’-কার এসেছে গেছে। আজব ব্যাপার, কিন্তু এ দেশে তো আজব ব্যাপার হামেশাই ঘটে। কী জন্য দরকার হলো? আমরা জানি না। শুনলাম হস্তক্ষেপ ঘটিয়েছেন কয়েকজন অভিধানপ্রণেতা, তারা ক্ষমতা পেয়েছিলেন একটি তথাকথিত প্রমিত বানানের অভিধান তৈরির। ব্যস, ক্ষমতাবুভুক্ষুদের এ দেশে যা ঘটে এরাও তা-ই ঘটিয়েছেন, অযথা ও অন্যায়ভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। ‘চীন’ কে তারা নাকি ‘চিন’ করতে চান! প্রথম প্রশ্ন, কেন দরকার পড়ল? জানি যথার্থ জবাব পাব না। হয়তো বলবেন প্রমিতকরণ ঘটিয়েছেন। তা প্রমিতকরণটা কেন আবশ্যক হলো? প্রমিত বানানই চালু রয়েছে। তাহলে? জবাব আছে : সেটা হলো ক্ষমতা। ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ বর্জনের তাণ্ডবে হস্ত যোগ করে কেউ কেউ আবার বলছেন, ‘ণ’-এর আবার দরকার কী, ‘ন’ই তো আছে।

কারা করল এ কাজ? এ চাপিয়ে দেওয়ার অপপ্রয়াস কেন? করলেন প্রমিত বানানের অভিধানপ্রণেতারা। এ ক্ষেত্রে তারা ক্ষমতাধর। কিন্তু ক্ষমতার উৎস কী, পেলেন কোথায়? পেয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। একটি প্রতিষ্ঠান তাদের অভিধান প্রণয়নের কর্তৃত্ব দিয়েছে, আর যায় কোথায়? অমনি তারা নিজেদের ক্ষমতা দেখিয়ে দিয়েছেন, সামরিক শাসকদের মতো, ছেঁটে ফেলেছেন বাঙালীর দীর্ঘত্ব। ভাষা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, জনগণের সম্পত্তি; কেবল আজকের জনগণের নয়, অতীত এবং ভবিষ্যতেরও। ক্ষমতা পেয়ে সেটা ভুলে গেছেন। তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ যে বাঙালীকে দুর্বল করবে তা নিয়ে ভাবেননি।

দুর্বল তো করবেই। স্মৃতি, অভ্যাস, উচ্চারণ, দৃশ্য সব দিক দিয়েই অনাবশ্যক শক্তিক্ষয় ঘটবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা নিজেদের শিক্ষা ভুলতে গলদঘর্ম হবেন। হয়তো বিতর্ক বাধবে এবং ‘কী’পন্থি ও ‘কি’পন্থিরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে প্রবল বিতণ্ডায়, কে জানে যুদ্ধেই লিপ্ত হয়ে যাবে কি না। কাজের কাজ নেই অকাজের পান্ডা হওয়ার মতো সময় আর যাদেরই থাকুক, আমাদের নেই, এটা যদি না বুঝি তাহলে আমাদের অব্যাহত নিম্নগামিতা সামনে থামবে এমনটা আশা করা শক্ত।

ভাষার ওপর হস্তক্ষেপের ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিতেই হবে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ধারপ্রবাহেই যে আমাদের নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সে সত্যটি তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে এও সত্য, ওই আক্রমণ আরও বহুবিধ হস্তক্ষেপেরই একাধারে দৃষ্টান্ত ও স্মারকচিত্র। ব্রিটিশ শাসনের কালে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন বাংলাতেই ছিল সবচেয়ে প্রবল, কিন্তু সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও পরিণামে বাংলার বিভাজনের অন্ধকারে যে প্রবেশ করেছিল তার কারণ হিন্দু ও মুসলিম মধ্যবিত্তের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে যুদ্ধ। প্ররোচনাটা ইংরেজরা দিয়েছে সেটা ঠিক, তারা উপভোগও করেছে; কিন্তু দ্বন্দ্বটা ভেতরে ছিল বইকি, নইলে ঘটনা অমনটা ঘটত না। ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি বাংলাদেশেও চলছে। দুই বড় দলের রাজনীতি নিয়ে বৈরীতার কারণে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এ ক্ষমতার কাড়াকাড়ি ভিন্ন কিছু নয়। এতে শক্তিক্ষয় হচ্ছে দেশবাসীর, কেননা ওই দুই পক্ষ একদিকে তাদের নিজেদের ভেতরকার গৃহদাহ সমগ্র জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে দেশবাসীকে বিভক্ত করে ফেলতে চাইছে, অন্যদিকে মানুষ ওই দুই পক্ষকে নিজেদের বিধিলিপি মনে করে অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে এ দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, কেননা এ যাবে তো ও আসবে এবং জনগণের দুর্দশা বাড়তেই থাকবে।

যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দেশে ক্রমাগত বিস্তার লাভ করেছে সেটি বড় নির্মম। এ দেশে পুঁজিবাদীরা উৎপাদন না করেই মুনাফা খোঁজে। কিন্তু এখন যে পুঁজিবাদ প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে সে মুনাফা নয়, বরং লুণ্ঠনকেই বেশি পছন্দ করে। যার দরুন লুণ্ঠনই এখন আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে পারছে ওই কাজ করছে, যে পারছে না সে লুণ্ঠিত হচ্ছে। লুণ্ঠনের এ আগ্রহ সন্ত্রাসকে প্রতিহত করবে কি, উৎসাহ দেয়। দিচ্ছেও। অন্যদিকে এ অনুৎপাদক পুঁজিবাদ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি যে করছে তাও নয়। উল্টোটাই করেছে। উৎপাদনে তার আগ্রহ নেই, কেননা তার চরিত্রটাই হচ্ছে লুটপাটের। যে ঐক্য বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল তা ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ভোগবাদিতাও বেড়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। এটাও একটা ক্ষমতা প্রদর্শন বটে। বিত্ত জমেছে বিত্ত দেখাতে হবে, কেমন করে দেখাবে, ভোগের মধ্য দিয়েই দেখায়।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত