যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া এমকি ইরান ও ভারত তাদের হাইপারসনিক অর্থাৎ শব্দের চেয়ে পাঁচ থেকে নয়গুণ দ্রুতগতিসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে। কিন্তু কেন এটা ঘটেছে, ব্যাপারটা কী? বিশ্লেষকরা বলেছেন, পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে সামরিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতার একটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ পর্ব চলছে এখন। এ মুহূর্তে প্রতিযোগিতাটা হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে। এতদিন ধরে বিভিন্ন দেশের হাতে যে সব দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছিল, সেগুলোর অনেকটা সেকেল হয়ে যাচ্ছে এবং তার শূন্যস্থান পূরণ করতেই এ প্রতিযোগিতা; কার আগে কে নতুন প্রজন্মের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে পারবে।
তাছাড়া পরাশক্তিগুলোর হাতে এখন যেসব প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র আছে, এগুলো যেভাবে ঠেকাতে হবে তার কৌশল প্রতিপক্ষ দেশগুলো ইতোমধ্যে বের করে ফেলছে। তাই চেষ্টা চলছে এমন এক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি যা প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা বূহ্যকে ভেদ করতে পারবে। আমরা জানি যে শব্দের গতি হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ১১২৫ ফুটের মত। কিন্তু একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুটতে পারে শব্দের চেয়ে পাঁচ থেকে নয় গুণ বেশি গতিতে। রয়র্টাসের বিশ্লেষক বলেন, বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে ঘণ্টায় ৩৮৫০ মাইল গতিতে ছুটতে পারে এই হাইপারসনিক মিসাইল। এটি উৎক্ষেপণের পর খুব দ্রুত ওপরে ওঠে আবার নেমে এসে আণুভূমিকভাবে বায়ুমণ্ডলের মধ্যেই চলতে থাকে, গতিপথও পরিবর্তন করতে পারে। তার-মানে, এটি কোন দিকে যাবে তা আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব নয়। তাই তা মাঝপথে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব।
বর্তমান আটটি দেশের কাছে এই হারপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। এটির জনক বলা হয় রাশিয়াকে। রাশিয়া যখন সিরিয়ায় সামরিক অভিযান করে তখন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া এটি ব্যবহার করছে বলে ইউক্রেন সরকার দাবি করছে।
আন্তর্জাতিক পরমাণু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাশিয়ার কাছে এ ধরনের কয়েক প্রকার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বিদ্যমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ডজনখানেক হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছেন বলে পেন্টাগণ জানিয়েছেন। পরবর্তী প্রজন্মের এই অস্ত্র প্রতিপক্ষকে প্রতিক্রিয়ার সময়টুকুও দেয় না, তার আগেই তাদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিরক্ষার সরঞ্জামগুলো ধ্বংস করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্র গত জুলাই মাসে একই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটি ছিল আরো একটু ভিন্ন ধরনের। এটি ছিল এয়ার ব্রিদিং হাইপারসনিক ওয়েপন যা উৎক্ষেপণের পর একটা ইঞ্জিনচালিত ক্রজ মিসাইলের মতই বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে উড়ে গিয়ে তার লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
চীন যেভাবে তার ক্রমবর্ধমান সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে তা বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী বিষয়ক মন্ত্রী ফ্রাংক কেন্ডাল বলেন, চীন এক নতুন অস্ত্র তৈরি করেছে, এবং মহাশূন্য থেকে সারা বিশ্বে আঘাত হানতে পারে এমন অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে বিপুল অগ্রগতি অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র বিশেষজ্ঞ জেফরি লুইস বলেন, আমেরিকার ভেতরে আঘাত হানতে পারে এমন শত খানেক পারমাণবিক আইসিবিএম চীনের হাতে এখনই আছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান সদস্য মাইক গ্যালাহার সতর্ক করে বলেন, ওয়াশিংটন যদি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে তার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গিতেই আটকে থাকে, তাহলে চীনের সাথে এই নতুন স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এক দশকের মধ্যে হেরে যাবে।
দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র ‘সতর্ক ঝড়’ নামের ছয়দিনের বিমান মহড়া শুরু করার পর গত সপ্তাহে উত্তর কোরিয়া পরীক্ষামূলকভাবে সাগরে অনেক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতশত কামানের গোলা ছুড়ে প্রতিক্রিয়া জানায়। উত্তর কোরিয়া ঐ সময় ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ঝড় বইয়ে দেয়। একদিনে সর্বোচ্চ নিক্ষেপণের রেকর্ডও গড়ে। পিয়ংইয়ং এ সময় একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল।
অন্যদিকে ইরান এবার হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। দেশটির আধা সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিমের এমন দাবি করেছে। তাসনিমের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ক্ষেপণাস্ত্রটি শব্দের চেয়ে অন্তত পাঁচগুণ দ্রুত এবং এটি বায়ুমন্ডলের মধ্যে এবং বাইরে কৌশলে চালানো সম্ভব। ক্ষেপণাস্ত্রটি শত্রুর উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নিশানা করবে। আর ক্ষেপণাস্ত্রের জগতে এটি কয়েক প্রজন্ম এগিয়ে। ইরান তার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেই সৌদি আরবকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, এখন পর্যন্ত ইরান দৃঢ় যৌক্তিকার সঙ্গে কৌশলগত ধৈর্য অবলম্বন করেছে। তবে শত্রুতা অব্যাহত থাকলে, এই ধৈর্য অব্যাহত রাখার আর কোন পরিস্থিতির নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না। ইরান যদি প্রতিশোধ নেওয়ার এবং শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে কাচের প্রাসাদগুলো ভেঙে যাবে এবং দুই দেশ আর স্থিতিশীল থাকার সুযোগ পাবে না।
প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথেসাথে উন্নত দেশগুলো নানান মরণঘাতী পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক কারণে উন্নত দেশগুলো এসকল অত্যাধুনিক মরণাস্ত্র ব্যবহার করে আমাদের আগামীর পৃথিবীকে সংঘাতময় করে তুলছে। গত বুধবার নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে মার্কিন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব অনুযায়ী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় ১ লাখ কওে সেনা হতাহত হয়েছে। সংঘাতের কবলে পড়ে ৪০ হাজার বেসামরিক লোকজন নিহত হয়েছে।
রাশিয়ার আগ্রাসনে ইউক্রেনের প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ জনগণ বাস্তুচু্যুত হয়েছে। শীত আসার আগেই উভয় পক্ষকেই যুদ্ধ অবসানে আলোচনার বিষয়টি ভাবতে হবে। তীব্র শীতে দুই পক্ষের জন্যই লড়াই চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে; হতাহতের সংখ্যা তীব্র আকার ধারণ করবে। হাইপারসনিক ক্ষমতাধর ৮টি রাষ্ট্র কেউ কাউকে এক চুল পরিমাণ ছাড় দিতে নারাজ। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র-চীন, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান, যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া, ইরান-সৌদিআরব, উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার সম্পর্কগুলি সাপ-বেজির সম্পর্কের মতো তিক্ত। ফলে এই তিক্ত সম্পর্কের কারণে পাশ্ববর্তী বা স্বার্থের সম্পর্কজনিত দেশগুলো দিনদিন আরো বেশি হিংসাত্মক হয়ে উঠছে। গতমাসে ইরানে মাইশা আমিনি নামক এক তরুণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানজুড়ে যে বিক্ষোভ চলছে, তার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ তুলছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনি।
ইরানের চলমান বিক্ষোভ কঠোর হাতে দমনের ফলে শতাধিক মানুষ হতাহত হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক জান্তা বিরোধিরা প্রায় ৩০ জন সৈন্য হত্যা করেছে। সুদানের দক্ষিণাঞ্চলের ব্লুনাইল রাজ্য জাতিগত সংঘর্ষে গত দুইদিনে প্রায় ১৫০ জন আবালবৃদ্ধবনিতা নিহত হয়েছে। আফ্রিকার দেশ শাদে চলমান বিক্ষোভে অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। রাশিয়ার বিমান হামলায় সিরিয়ায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ইথিওপিয়ায় চলছে সংঘাত। বিশ্বব্যাপি চলমান এইসব বিক্ষোভ-সহিংসতার পিছনে কোনো না কোনো ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ইন্ধন রয়েছে। দেখা গেছে যেখানে এ সকল ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের স্বার্থহানি হয়েছে সেখানেই তারা সামরিক হস্তক্ষেপের কথা বলেছে। এর মূল উদ্দেশ্য একটি অত্যাধুনিক অবস্থানিক ও রাজনৈতিক বেড়া-জালের বিস্তার করা, যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে এ সকল ক্ষমতাধর মোড়ল রাষ্ট্রগুলো।
লেখক : প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা
-বাবু/সাদরিনা