উচ্চমূল্যস্ফীতির চাপে বাংলাদেশ ধুঁকছে দুই বছরের অধিক সময়- চলমান ঊর্ধ্বমুখী প্রায় ১০ শতাংশ হারে, কারও হিসাবে এর চেয়ে বেশি। সে যাই হোক, মূল্যস্ফীতির কারণে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের খানায় বিরূপ প্রভাব অতি সহজেই অনুমেয়- নুন কিনতে গেলে পান্তা কেনা যায় না অথবা তদ্বিপরীত।
গেলবার যা কিনল ১০০ টাকায়, এবার সেটাই ১১০-১২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে, কিন্তু মজুরি অনড়। ফলে খাদ্য পরিগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ভোগ নিচে নেমে যায় বলে এসব শ্রেণির মানুষ দিশাহারা; প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে অবস্থা প্রাণান্তকর। আর এই মুদ্রাস্ফীতির কারণ কী, তা মোটামুটি সবাই অবগত : চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে অমিল- চাহিদা যখন জোগান ছাড়িয়ে যায়; অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি এবং উৎপাদন হ্রাস ও চাহিদার দিক বা সরবরাহের দিক বা উভয়ের পরিবর্তনের কারণে। তবে এসব পরিবর্তনের পেছনে দেশীয়, আন্তর্জাতিক কিংবা উভয়ের প্রভাব কাজ করে থাকে।
মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে এবং অর্থনীতির বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করতে পারে। প্রাথমিক প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি হলো ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টাকার মূল্য হ্রাস পায়। এটি সঞ্চয়কে ক্ষয় করতে পারে এবং ভোক্তাদের পণ্য ও পরিষেবার সামর্থ্য হ্রাস করতে পারে। অধিকন্তু, মুদ্রাস্ফীতি আর্থিক বাজারে অনিশ্চয়তা এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত ও সম্পদের দামকে প্রভাবিত করে। উপরন্তু মুদ্রাস্ফীতি পুনর্বণ্টনমূলক প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ ঋণদাতা ও সঞ্চয়কারীরা ক্রয়ক্ষমতা হারাতে পারেন, যখন ঋণগ্রহীতারা নিম্ন প্রকৃত সুদের হার থেকে উপকৃত হন।
দুই.
মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারি পর্যায়ে এবং সমাজে প্রচুর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বস্তুত সরকারের প্রথম টার্গেট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। এটাই স্বাভাবিক কারণ। এর ধকল সবচেয়ে বেশি বহন করে গরিব শ্রেণি, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। মুখরা রমণীকে বশ করতে না পারলেও সংসার কোনোভাবে টিকে থাকে, কিন্তু লাগামহীন মূল্যস্ফীতি বশে আনতে না পারলে সমাজের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে- ঊর্ধ্বগামী মূল্যস্ফীতি রাজনৈতিক ডিনামাইটে রূপ নিতে পারে। ইতোমধ্যে খানার আয় এবং ব্যয় সমীক্ষা (২০২২) জানাচ্ছে, আয় বৈষম্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে- যেমন নব্বইয়ের দশকের শূন্য দশমিক তিন পাঁচ থেকে ২০১০ সালে শূন্য দশমিক চার পাঁচ এবং ২০২২ সালে শূন্য দশমিক চার নয় এবং মূল্যস্ফীতি, যা গরিবের ওপর রিগ্রেসিভ ট্যাক্সের মতো। সেই বৈষম্যে জ্বালানি দিয়ে পরিস্থিতি নাজুক করে তুলছে। তবে দারিদ্র্য ও বৈষম্য এই দুই সংকটের মধ্যে দারিদ্র্য হ্রাসের ইতিবাচক সংবাদে বাঁচল বাংলাদেশ।
তিন.
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সমস্যার প্রকৃতি ও উৎস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া। এমন একটি প্রায়শ উপেক্ষিত দিক হচ্ছে মূল্যস্ফীতির ওপর বিনিময় হারের সঞ্চারণ বা ‘পাস থ্রু প্রভাব’ পর্যবেক্ষণ করে, এটা কমাতে মানসম্মত অস্ত্র উদ্ভাবন করা যখন লক্ষ্যমাত্রা যুদ্ধ-পূর্ববর্তী পাঁচ দশমিক পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ। আইএমএফের অভিমত, এক অসুখকর অনুভবের দিকে ঠেলে দেয়, যখন প্রতিষ্ঠানটি মনে করে যে, ‘অপ্রত্যাশিত সহায়ক অভিঘাত’ না পেলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কয়েক মাস থেকে দুই বছরও লেগে যেতে পারে। এই দীর্ঘ বেদনাদায়ক প্রতীক্ষায় না থেকে একটা ‘অপ্রত্যাশিত সহায়ক অভিঘাত’ দেওয়ার কথা বলতে হবে।
আমরা এও জানি, উদ্বেগের জায়গাটা অবশ্য রোগ নয়, রোগ নিরসনে যথাযথ দাওয়াইর অভাব বা অনুপস্থিতি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, পৃথিবীর বহু দেশ বাংলাদেশের চেয়েও অধিক হারে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরে এখন ৩-৫ শতাংশের ঘরে ঘোরাঘুরি করছে। অথচ বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন পর্যন্ত নামানো যায়নি। বেশিরভাগ সময় মূল্যস্ফীতির প্রকৃত প্রকৃতি ও কারণ শনাক্তে ব্যর্থতা ছিল। আবার যখন কারণ জানা গেল, তখন রোগ নিরাময়ে ভুল ওষুধ সুপারিশ এবং বাস্তবায়িত করে রোগ প্রলম্বিত করা হলো। সমালোচকরা এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল নীতিকে দায়ী করছেন। তবে আমরা আনন্দিত যে, এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সেই প্রেক্ষিতে বেশ কিছু নীতিসূচক পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়াস লক্ষণীয়। আশা করা যায়, গৃহীত পদক্ষেপের কারণে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে।
চার.
নীতিগত বিষয়ে কিছুটা অগ্রগতি তো আছেই এবং তা জানা দরকার। প্রায় দুই বছরের ব্যবধানের পর অবশেষে বৈদেশিক মুদ্রাব্যবস্থা এবং মুদ্রানীতিকে যথাস্থানে রাখা হয়েছে সমন্বয়ের মাধ্যমে। এই সাহসী নীতিগত সিদ্ধান্ত ভালোভাবে বাস্তবায়িত হলে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ। সমন্বয় প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপ হলো- রাজস্বনীতি সমন্বয়ের সঙ্গে এই নীতি সংস্কারের কার্যকারিতা বাড়ানো। কেননা মুদ্রাস্ফীতি কমাতে রাজস্বনীতি সংস্কার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্ব-সংক্রান্ত সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা সহজ। যেমন- মূল্যস্ফীতি কমাতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমানো প্রয়োজন। এটি করতে হলে স্বভাবতই মোট ঋণের প্রবৃদ্ধি হ্রাস করার দিকে ইঙ্গিত আসে। স্মর্তব্য, যদিও ঋণের মোট চাহিদায় বেসরকারি খাতের প্রাধান্য রয়েছে, বছরের পর বছর ধরে পাবলিক সেক্টরও ঋণÑ বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সুতরাং, ব্যক্তি খাতে ঋণ কমাকেই মূল্যস্ফীতি কমবে, সেটা মনে করা বোধহয় ঠিক নয়।
সন্দেহ নেই যে, মুদ্রানীতি সংশোধনের ফলে সুদের হার বেড়েছে, এর ফলে বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কমেছে এবং আমরা ধরে নিতে পারি যে, এটা অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতি ও বিনিময় হার উভয়ের ওপর চাহিদার চাপ কমাতে সাহায্য করবে। কিন্তু পাবলিক সেক্টরের বা সরকারের ঋণের চাহিদা মূলত বাজেট ঘাটতি এবং কীভাবে এই ঘাটতি অর্থায়ন করা হয়, তার ওপর নির্ভর করে। বলা যেতে পারে যে, রাজস্ব ঘাটতির মাত্রা যত কম হবে এবং বিদেশি ও নন-ব্যাংক প্রাইভেট ফাইন্যান্সিংয়ের শেয়ার যত বেশি হবে, সরকারি খাতে ব্যাংকঋণের চাহিদা তত কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পাঁচ .
অর্থবছর ২৫ এ বাজেটে, যা কদিন আগে পেশ করা হলো- জিডিপির চার দশমিক ছয় শতাংশ রাজস্ব ঘাটতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে জিডিপির প্রায় এক দশমিক সাত শতাংশ বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে এবং জিডিপির শূন্য চার শতাংশ নন-ব্যাংক ব্যক্তিগত ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা হবে। তার মানে ব্যাংক অর্থায়নের মাত্রা হবে জিডিপির দুই দশমিক পাঁচ ভাগ। চুলচেরা হিসাবে প্রতীয়মান হয়, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা দ্বারা নির্ধারিত মোট ঋণ বৃদ্ধির সীমা বেঁধে দেওয়া হলে রাজস্ব ঘাটতির জন্য ব্যাংক অর্থায়নের এই মাত্রা বেসরকারি খাতের ব্যাংক ঋণকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাইরে ঠেলে দেবে। অর্থাৎ ব্যক্তি খাত সরকারি খাতের কনুইর গুঁতায় রিঙয়ের বাইরে অবস্থান নিতে বাধ্য। সুতরাং, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ঋণের সীমিত সরবরাহের জন্য বেসরকারি খাত সরকারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা মানেই সুদের হার বেড়ে যাবে।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতের রাজনৈতিক চাপ সম্ভবত বাংলাদেশ ব্যাংককে ঋণ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা শিথিল করতে বাধ্য করবে এবং এই উদ্যোগ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কৌশলের সঙ্গে আপস করতে হবে বলে ধারণা করা চলে এবং এটাই হবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক। বেসরকারি খাতের প্রতি ন্যায্য হয়ে বলতে হয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করে এমন বেসরকারি খাতের ওপর সব সমন্বয়ের চাপ দেওয়া এক অর্থে খারাপ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। তাই এমন ক্রান্তিলগ্নে সরকারের উচিত হবে রাজস্ব ঘাটতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে রাখা।
ছয়.
তিনটি রাজস্বনীতি ব্যবস্থার মাধ্যমে ঘাটতি- অর্থায়ন ঝামেলা সহজেই মিটমাট করা যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ। প্রথমত, যদিও নৌকা দুলে যাওয়ার ভয়ে সরকার ধনী ও ক্ষমতাবানদের করের ক্ষেত্রে সাহসী পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক, সেক্ষেত্রে উচিত হবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোর কিছু মৌলিক সংস্কারের আশ্রয় নিয়ে সরকারের আয় বাড়াতে সাহায্য করা। এই উদ্যোগে সরকারের বিনিয়োগ থেকে আয় বৃদ্ধি পাবে। এটা কীভাবে সম্ভব, তার বিস্তারিত নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে অবহিত। দ্বিতীয়ত, সরকার জীবাশ্ম জ্বালানি, বিদ্যুৎ, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর ভর্তুকি বাদ দিতে পারে; যা জিডিপির প্রায় এক দশমিক দুই শতাংশ বাজেট সাশ্রয় করবে। বিনিময় হার মুক্ত করলে, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ভর্তুকি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে।
মনে রাখা দরকার, জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি কার্বন নির্গমন কমাতে সরকারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। বিদ্যুৎ খাতে, আইপিপি এবং রেন্টাল পাওয়ার কন্ট্রাক্টে যে ভুলগুলো হয়েছে, সেগুলো ভর্তুকি দিয়ে অতিরিক্ত খরচের অর্থায়ন না করে বরং সংশোধন করতে হবে। কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে সর্বনিম্ন খরচের উৎসে ফিরে যেতে হবে। বিদ্যুতের দাম কোনো ভর্তুকি ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকৃত খরচ প্রতিফলিত করতে হবে। তৃতীয় এবং পরিশেষে, সরকারের উচিত অর্থবছর ২৫-এ এডিপির আকারকে আরও কম এবং বাস্তবসম্মত স্তরে পুনর্মূল্যায়ন করা। তবে অবশ্যই শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য, জল এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি মেগা অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ কমাতে হবে। এই পুনর্বণ্টন জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য হ্রাসকে দীর্ঘমেয়াদি মেগা পরিবহন অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর তুলনায় ভালোভাবে রক্ষা করবে; যা শুধুমাত্র দীর্ঘমেয়াদে সুবিধা প্রদান করবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়