গত সোমবার(১৯আগষ্ট) সকালে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার মোজাফরপুর ইউনিয়নের মোজাফরপুর (পশ্চিমপাড়া) গ্রামে সরেজমিন গিয়ে কথা হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত আলী হোসেনের স্ত্রী খাইরুন্নেচ্ছার সাথে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে খাইরুন্নেচ্ছা জানান, ঘটনার দিন (১৮ জুলাই) সকালে তার স্বামী আলী হোসেনকে পান্তাভাত খাইয়ে তিনি বের হন অন্য বাসায় ঝিয়ের কাজ করার জন্যে । বেলা ২টার দিকে বাসায় ফেরেন খাইরুন্নেচ্ছা। স্বামীকে নিয়ে উত্তরায় আজমপুর মুন্সি বাজার এলাকায় মাসে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ওইদিন একসাথে দুপুরের খাবার খাবেন এই অপেক্ষায় বসে ছিলেন স্ত্রী। কিন্তু বেলা আড়াইটা পর্যন্ত তার স্বামী বাসায় না ফেরায় তিনি চিন্তায় পরে যান।
পরে মোবাইল ফোনে স্বজনদেরকে বাসায় না ফেরার বিষয়টি জানালে চারদিক থেকে স্বজনরা খুঁজাখুঁজিতে বের হন। অবশেষে সন্ধ্যার পরে তার মরদেহ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে পাওয়া যায়। সেখান থেকে এ্যাম্বুলেন্স যোগে মরদেহ নিয়ে কেন্দুয়ার বাড়িতে পৌঁছান রাত অনুমান ৪ টার দিকে। পরদিন সকালে নামাজের জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
খাইরুন্নেচ্ছা জীবনের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তিন কন্যা সন্তান রেখে তার স্বামী আলী হোসেন গত (১৮ জুলাই)কোটা আন্দোলনে দূর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। গুলিতে তার বুক ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল। তার বড় কন্যা সাদিয়ার বয়স ১৪ বছর। সে মোজাফরপুর মহিলা মাদ্রাসায় পড়ে। মধ্যম মেয়ে মাহিবার বয়স ৬ বছর। সে প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। ছোট মেয়ে সাইবার বয়স ৩ বছর। এই তিন কন্যাকে তার শাশুড়ীর কাছে রেখেই তিনি স্বামী আলী হোসেনকে নিয়ে রাজধানী ঢাকায় ছুটে গিয়েছিলেন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে।
খাইরুন্নেচ্ছা আরও জানান, তার স্বামী আলী হোসেন অভাবের তাড়নায় গ্রাম্য মহাজনদের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। টাকার জন্য প্রতিমাসে সুদের লাভ হিসেবে ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। আলী হোসেনের ছোট ভাই আবু বক্কর বলেন, ভাই যার কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা নিয়েছিলেন তিনি লাভের টাকা অর্ধেক কমিয়ে প্রতিমাসে ১৫ হাজার টাকা দিতে বলেছেন। এই ৬ লাখ টাকা এখন কিভাবে পরিশোধ করবেন, কিভাবে দেবেন প্রতিমাসে লাভের টাকা, তা নিয়ে দিনরাত শুধু কাঁদছেন আর কাঁদছেন।
আলী হোসেনের স্ত্রী আরো বলেন, আমার সব শেষ অইয়্যা গেছে। আমি কি কইরা ৬ লাখ টাকার ঋণ দিব? তিন মেয়েরে নিয়া কিভাবে চলবো? আমি সরকারের কাছে আমার ঋণের টাকা পরিশোধ করে তিন মেয়েকে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে জীবন চলার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতেছি। সরকার আমারে সহযোগিতা না করলে এই ঋণের যন্ত্রনায় আমি মরে যাব।
জানা যায়,কেন্দুয়ার মোজাফরপুর ইউনিয়নের যুবক কোটা আন্দোলনে ঢাকার উত্তরায় দূর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন পান দোকানদার আলী হোসেন। গত ১৮ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গুলিতে তার বুক ঝাঝরা হয়ে যায়। পরে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে গিয়ে তার মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়।
তার বয়স অনুমান ৪০ বছর।
তিনি জানান, ইতিমধ্যে মোজাফরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: জাকির আলম ভূঞা জানাযার দিন এসে নগদ দশ হাজার টাকা, বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম হিলালী ৬ হাজার টাকা এবং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মওলানা হারুন-অর -রশিদ মেয়ের হাতে দিয়ে গেছেন ১ হাজার টাকা। তাছাড়া এলাকার আলেম সমাজ দিয়ে গেছেন ১১ হাজার টাকা। তবে সরকারী ভাবে এখনো কোন টাকা পয়সা পাননি তিনি। সরকারী কোন কর্মকর্তাও থাকে দেখতে যাননি। তবে ইউএনও অফিস থেকে ফোন করে তার মেয়েদের লেখাপড়া বিনা খরচে করানোর জন্য বলে দিয়েছেন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার কথাও বলেছেন।
এ ব্যাপারে গত সোমবার (১৯ জুলাই) বিকেলে কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমদাদুল হক তালুকদারের সাথে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি ব্যস্ততার কারণে যেতে পারেনি, তবে আলী হোসেনের মেয়েদের লেখাপড়া বিনা পয়সায় ব্যবস্থা করার জন্য বলে দিয়েছি। তাছাড়া খুব তাড়াতাড়ি আলী হোসেনের স্ত্রীকে একটি বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করে দেবো। সে জন্য ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। কাল-পরশুর মধ্যেই আর্থিক ভাবে সহযোগিতাও করা হবে। তবে কি পরিমান সহযোগিতা করা হবে তা তিনি এখনো বলতে পারেননি।
ইউএনও ইমদাদুল হক তালুকদার আরও বলেন, আলী হোসেনের স্ত্রী ঢাকায় কারো বাসায় ঝিয়ের কাজ করতেন। এখন যদি মনে করেন এলাকায় থাকবেন, সেক্ষেত্রে আমরা তাকে সেলাই প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করব। এছাড়াও যদি আরও কোন সরকারী সহযোগিতার সুযোগ থাকে সেটি তিনি পাবেন।