অভুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে আছেন অনেক মন্ত্রী, এমপি। বেশিরভাগই গণমাধ্যমে কথা বলা থেকে দূরে আছেন। তবে সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি বাড়ি ছেড়েছেন গত ৭ আগস্ট; আন্দোলন দমাতে গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথাও স্বীকার করেছেন। বলেছেন, দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদ ছেড়ে দেওয়াই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এখন একমাত্র পথ।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত
প্রশ্ন: চলমান পরিস্থিতি থেকে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াবে কীভাবে?
উত্তর: আমি বাংলাদেশে ১০ বছর ৬ মাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলাম। এই সময়কালে অনেক উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করেছি। এখন সবকিছু ৩৬০ ডিগ্রি উল্টে গেছে। গত বছরের ৩ থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে প্রায় ৪৬০টি থানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়, ৫ হাজার ৮২৯টি অস্ত্র থানাগুলো থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন থেকে এসএসএফের (ভিভিআইপি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) অস্ত্রও নিয়ে যাওয়া হয়। আমি নিজে ৫ ও ৬ আগস্ট ঢাকায় ছিলাম এবং ৭ আগস্ট বাড়ি থেকে বের হয়েছি'।
প্রশ্ন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আপনি কি এই পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেননি?
উত্তর: যখন থানাগুলো পুড়েছে কার্যত পুলিশ তখন অকার্যকর হয়ে যায়। তখন জাতির কেবল নিঃশব্দে দেখা আর মৃতদেহ গোনা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। পুলিশই নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়। কিন্তু যদি পুলিশই পঙ্গু হয়ে যায়, তখন কী হবে? আমি বলবো বাংলাদেশে যৌথ অভ্যুত্থান ঘটানো হয়েছে। ইসলামী উগ্রবাদ এবং সেনাবাহিনীর যৌথ অভ্যুত্থান।
প্রশ্ন: একটি বিশাল গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আপনি কি স্বীকার করেন?
উত্তর: আমি একমত যে একটি গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল, তা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যাই হোক। তবে এটি ছিল একটি সেনা অভ্যুত্থান। সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ গোয়েন্দা ইউনিট আছে, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)। তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করে। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাও (এনএসআই) সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করে। এমনকি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে কেবল গোয়েন্দা রিপোর্টের সারসংক্ষেপ আসে।
প্রশ্ন: আপনার দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে কি আপনার যোগাযোগ হচ্ছে?
উত্তর: আমি তার সাথে দেখা করতে পারি না, তবে ফোনে তার সাথে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলি, দিকনির্দেশনা চাই। ৪ আগস্ট প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত আমি তার সঙ্গে ছিলাম। পুলিশপ্রধান সেখানে ছিলেন। সেনাপ্রধানও সেখানে ছিলেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে কিছুই ঘটবে না, আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখব।
তিনি বলেছিলেন, আপনার সুরক্ষা আমার দায়িত্ব। আমি এসবের সাক্ষী। আমি তাকে আবারও জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কি পুরো দায়িত্ব নিচ্ছেন? তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ। এরপর আমি আমার অধীনে থাকা পুলিশপ্রধানকে বলেছিলাম যে তিনি যেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনভাবে আলোচনা করেন এবং সবকিছু যেন স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু আপনারা ৫ আগস্ট যা ঘটেছিল তা দেখেছেন।
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগের কর্মীদের মনোবল আপনি কীভাবে ধরে রাখবেন?
উত্তর: আওয়ামী লীগ কর্মীদের মনোবল অত্যন্ত উঁচু। তারা শেখ হাসিনা ছাড়া ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারে না। তিনিই বাংলাদেশকে পরিবর্তন করেছেন। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলায় পরিবর্তন এনেছেন।
প্রশ্ন: আপনি ভারতের কাছ থেকে কী আশা করেন? ভারত কীভাবে সাহায্য করতে পারে?
উত্তর: আমি মুক্তিযোদ্ধাদের একজন কমান্ডার ছিলাম, তাই আমি জানি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে ভারত কী করেছে। আমি স্বীকার করি, ভারত সবসময় বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। এখন ভারত কূটনৈতিকভাবে সাহায্য করতে পারে। আমাদের আদালতগুলো পঙ্গু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে যেতে পারছেন না। সব বিচারক নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাই প্রথম কাজ হলো কূটনৈতিক চাপ দেওয়া এবং উচ্চস্বরে দাবি তোলা, যাতে আদালতগুলো আবার কার্যকর হয়। ভারত এতে সাহায্য করতে পারে।
প্রশ্ন: আপনি কি দেশে ফিরে আইনের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত? নির্বাচন লড়তে প্রস্তুত?
উত্তর: আমি ফিরে যেতে ভয় পাই না। তবে সেটি কেবল তখনই সম্ভব, যখন আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, বিচারকরা স্বাধীনভাবে মামলা শুনতে পারবেন এবং আমাদের পক্ষের আইনজীবীরা আমাদের পক্ষে লড়তে পারবেন। আমরা নির্বাচনে বিশ্বাস করি। আমরা অবশ্যই নির্বাচন লড়ব, যদি সেখানে যেতে পারি।
প্রশ্ন: শেখ হাসিনার নির্বাসনে থাকা অবস্থায় দলকে সংগঠিত করা কতটা কঠিন?
উত্তর: কিছুই অসম্ভব নয়। আমি বিশ্বাস করি এটি সম্ভব। এবং আমি বিশ্বাস করি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সবকিছু বদলাবে। বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে আমি দেশটিকে দেখেছি, বাংলাদেশের মানুষকে দেখেছি, এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমরা খুব শীঘ্রই এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব। আমাদের অনেক নেতার অবস্থান আমরা জানি না… কিন্তু যদি আমরা আন্দোলন শুরু করি, বিক্ষোভ শুরু করি, তাহলে তারা আবারও এগিয়ে আসবে।
আমার বয়স ৭৫ পেরিয়ে গেছি, এখন আমি বোনাস জীবনে আছি। আমি ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। আমি বিশ্বাস করি আওয়ামী লীগের তরুণ নেতারাও এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। এখন সময় এসেছে তরুণ নেতাদের এগিয়ে আসার।
প্রশ্ন: শেখ হাসিনার সঙ্গে আপনার কথা হলে, কী বলেন তিনি?
উত্তর: তিনদিন আগে তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, তোমরা সব নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলো এবং আমরা অবশ্যই খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠব।
প্রশ্ন: আপনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কী বার্তা দিতে চান?
উত্তর: তার চেয়ারে বসার কোনো অধিকার নেই। তিনি নেতা নন, রাজনীতিক নন। আমাদের দেশে খুব অদ্ভুত কিছু ঘটেছে। বাংলাদেশ একটি অদ্ভুত দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। ড. ইউনূসের উচিত তার পদ ছেড়ে আওয়ামী লীগসহ সকল রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে লড়তে দেয়া।
'সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্ট' এর প্রতিক্রিয়া
পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য নিয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে 'সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্ট'। তারা বলেছে, সংঘবদ্ধ অপপ্রচারের অংশ হিসেবে, পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের কথার ওপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। পত্রিকাটি যাদের বক্তব্য প্রকাশ করেছে তারা সবাই সন্দেহভাজন অপরাধী ও গণহত্যায় অভিযুক্ত। সাংবাদিকতার মৌলিক নিয়ম অনুসরণ না করে প্রকাশিত এসব প্রতিবেদন মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যে পরিপূর্ণ।