সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে আগামী ফেব্রুয়ারিতে দেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাজনৈতিক দল সমূহ নির্বাচন আসনে যোগ্য প্রার্থী খুঁজে নিয়ে মনোন্নয়ন তালিকা চুড়ান্ত করছে। দেশে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ইতোমধ্যে বেশির ভাগ আসনে তাদের প্রার্থীর খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে।
দলটির প্রকাশিত তালিকায় অনেক আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা না দেয়ায় ওসব আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে সংশয়ে রয়েছে। একইরকম সংশয় বিরাজ করছে চট্টগ্রাম-৬ নির্বাচনী আসন রাউজানে। এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী দুই সাবেক সংসদ সদস্য। দলের ঘোষিত মনোনিত প্রার্থীর নাম প্রাথমিক ঘোষণায় কারো নাম না থাকায় দলের নেতাকর্মীরা সবাই হয়েছেন হতাশ।
খবর নিয়ে জানা যায়, এই আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীক পাওয়ার বারবারের প্রতিযোগী দলের চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম আকবর খোন্দকার ও বর্তমানে দলীয় পদ স্থগিত করে রাখা বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী।
এলাকার জনসাধারণের মতে মনোন্নয়ন পাওয়া না পাওয়ার প্রশ্নে এই উপজেলায় বিএনপির রাজনীতিতে দলটির নেতাকর্মীদের গ্রুপিং চলে আসছে বহু বছর থেকে। এই গ্রুপিং এর সূত্র ধরে এখানে বিএনপির চলছে পৃথক পৃথক সাংগঠনিক কমিটি (বৈধ-অবৈধ) মাধ্যমে। কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালন করে দুই গ্রুপ পৃথক পৃথক জায়গায়।
প্রবীণদের মতে- বিএনপির রাজনীতিতে এই বিভক্তির ধারার সূত্রপাত হয়েছিল বিগত ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে। সূত্র মতে ৯৬ পূর্ববতী সময়ে এই আসনের বিএনপির নেতৃত্ব ছিল গোলাম আকবর খোন্দকারের হাতে। ওইসময়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বিএনপিতে যোগ দিলে দলটির প্রার্থী হিসাবে মনোন্নয়ন দেয়া হয় গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। ওই থেকে বিএনপিতে সৃষ্টি হয় দুই বিভক্ত ধারা। যা এখনো পর্যন্ত চলমান আছে।
স্থানীয়রা বলেছেন, গত ১৭ বছর ধরে চলা আওয়ামী দুঃশাসনে যাতাকলে পিষ্ট ছিল বিএনপির উভয়গ্রুপের নেতাকর্মীরা। ওই সময় কেউ থাকতে পারেনি নিজেদের বাড়ি ঘরে। বাড়িতে গিয়ে দেখতে পারেনি মত মৃত মা-বাবার মুখ। যারা সাহস করে গোপনে পরিবারের সাথে দেখা করতে গেছে তাদেরকে অনেককেই তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে নানা কায়দায় পিটিয়ে মেরেছে। নতুবা ভাঙ্গা, পুরানো অস্ত্র হাতে ধরিয়ে দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে মিথ্যে মামলায় জেলে পাঠিয়েছে। অনেকের বাড়ি ঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
এমন অসহনীয় পরিস্থিতির শিকার অনেক নেতাকর্মী ১৭ বছরের নির্বাচিত জীবন শেষে রাজনীতির পরিবর্তিত পেক্ষাপটে এলাকায় ফিরে আসে। এলাকায় এসে অনেকেই উপার্জনের লক্ষ্যবস্তু করে চাঁদাবাজি, মাটি, বালু, কাঠ-বাঁশের ব্যবসা। এসব অবৈধ ব্যবসায় নিয়োজিতরা সুযোগ নেয় দ্বিধাবিভক্ত বিএনপির। তারা ওমুক ভাই তমুক ভাইয়ের অনুসারী পরিচয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠে। প্রতিপক্ষকে কোনঠাসা রাখতে গড়ে তোলে পক্ষ-বিপক্ষে অস্ত্রভান্ডার। একপক্ষ অন্যপক্ষের ওপর চালাতে থাকে গুলি।
সূত্রমতে দুই পক্ষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বিগত প্রায় সোয়া বছরে এই উপজেলায় খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৭টি। গুলিতে আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। স্থানীয়দের মতে হতাহতরা সকলেই দুই নেতার অনুসারী বিএনপির নেতাকর্মী।
মাঠপর্যায়ে যারা বিএনপির আদর্শিক নেতাকর্মী তারা মনে করে এখানে বিএনপি পরিচয়ে থাকা দুই পক্ষের সংঘর্ষ, সংঘাতের ঘটনা শুধু রাজনৈতিক কারণে নয়। প্রায় সব সংঘাতের ঘটনা ঘটছে এলাকায় চাঁদাবাজি, মাটি, বালুর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। সংঘর্ষ সংঘাতে লিপ্তরা অমুক-ভাই তমুক-ভাইয়ের কর্মী পরিচয়ে প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে এখন দল উপদলে বিভক্ত। পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তাক করে আছে।
জানা যায়, রাউজানের চলমান এমন পরিস্থিতির প্রতিদিনের চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে থাকলে ক্ষুদ্ধ হয় বিএনপির হাইকমান্ড। এসবের মধ্যে দলের নীতি নির্ধারক পর্যায় থেকে নেয়া হয় রাউজানে দলীয় শৃংঙ্খলা ফেরাতে কঠোর সিদ্ধান্ত। দলের নীতি নির্ধারণী ফোরাম এই পরিস্থিতির সামাল দেয়ার ব্যর্থতার জন্য কমবেশী দায়ি করে মনোনয়নপ্রত্যাশী দুই নেতাকে। সর্বশেষ কেন্দ্র থেকে শোকজ করা হয় সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। পরে এই নেতার সকল পদ পদবি স্থগিত করে হাইকমান্ড। একই সাথে তার প্রতিপক্ষ সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম আকবর খোন্দকারের নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির কমিটি বাতিল করে সতর্ক বার্তা দেন গোলাম আকবর খোন্দকারকে।
কেন্দ্রের কঠোর মনোভাবের মধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়ে প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। নড়েচড়ে বসে আইন শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুই নেতার সবুজ সংঙ্কেত পেয়ে শুরু করে অভিযান। পৃথক দুটি অভিযানে উদ্ধার করে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র। গ্রেফতার করে সন্ত্রাস ও খুনের সাথে জড়িত বেশ কয়েকজনকে।
দুই নেতা ও প্রশাসনের এই পদক্ষেপে গত প্রায় মাসখানেক থেকে রাউজান শান্ত। মনোনয়ন প্রত্যাশী দুই নেতার এখন মনোনিবেশ এখন কেন্দ্রের দিকে। নিজেদের প্রার্থীতা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করে যাচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতের মধ্যে। এলাকার কর্মীরা এখন অধীর অপেক্ষায় আছে রাউজানে ধানের শীষের প্রার্থীর নাম শোনার।