বৃহস্পতিবার ১২ জুন ২০২৫ ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
বৃহস্পতিবার ১২ জুন ২০২৫
ঢাকার বাহিরে প্রথম ভাষা আন্দোলন
এম আর লিটন
প্রকাশ: সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১১:৫৪ PM আপডেট: ২১.০২.২০২৩ ১:২৭ PM
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আমাদের কমবেশি সকলের জানা। তবে, রাজধানী ঢাকার বাহিরেও প্রথম ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়ে ছিল। কিন্তু সেই ইতিহাস আমাদের অনেকের জানা নেই। ঢাকা রাজধানী থেকে ১১০ কিলোমিটার অদূরে তৎকালীন মানিকগঞ্জ মুহকমা শহর, বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অন্যতম বিদ্যাপীঠ (তেরশ্রী কালী নারায়ণ ইনস্টিটিউশন) তেরশ্রী কে এন ইনস্টিটিউশন হাইস্কুলে ঢাকার বাহিরে প্রথম ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
 
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটলেও মাতৃভাষার দাবি শুরু হয়েছিল বহু আগে থেকেই। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান শাসাকগোষ্ঠী অন্যায়ভাবে পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশের) মানুষের ওপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপায়ে দিতে চেয়ে ছিল। পূর্ব বাংলার মানুষ তা মেনে নেয়নি। বাংলা ভাষাপ্রেমী জনগণ ১৯৪৭ সাল থেকেই আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলন ছিল দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির লড়াই, যা ১৯৫৬ পর্যন্ত গড়ায়।
 
মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে দেশব্যাপী যে- আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে, তার প্রভাব রাজাধানী ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার অদূরে মহকুমা শহর মানিকগঞ্জে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে গঠিত হয় ‘মাতৃভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ’। ১৯৪৮ হতে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আন্দোলন চলতে থাকে মানিকগঞ্জের ঘিওর থানার তেরশ্রী অঞ্চলে ।
 
তেরশ্রী কে. এন. ইনস্টিটিউশনের সহকারী প্রধান শিক্ষক কমরেড প্রমথ নাথ নন্দী এই আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন। (যিনি মাস্টার মশাই নামে সমধিক পরিচিত) ছিলেন ঘিওর দৌলতপুর অঞ্চলে প্রগতিশীল বিপ্লবী আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ। প্রমথ নাথ নন্দীর সাথে যুক্ত হন একই বিদ্যালয়ের ক্রীড়াবিষয়ক শিক্ষক কমরেড আফছার উদ্দিন আহম্মেদ। তাদের প্রেরণায় আন্দোলন ক্রমশ বেগবান হতে থাকে। এছাড়াও মানিকগঞ্জে মাতৃভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকে জেলার প্রগতিশীল ছাত্রজনতা ও রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিবর্গ।
 
সে সময়ে মানিকগঞ্জে ভাষা আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেন, কলেজ শিক্ষার্থী প্রমথ নাথ সরকার, ডা. মোবারক আলী, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ডা. আব্দুল সালাম। তেরশ্রী কে এন ইনস্টিটিউশনের (ম্যাট্রিক) পরীক্ষার্থী আব্দুল হাকিম, আব্দুর রহমান ঠাকুর, মনিন্দ্র নাথ সরকার, সিরাজ উদ্দিন মৃধা, নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিরান উদ্দিন, মো. ওয়াজ উদ্দিন, মো. রেহাজ উদ্দিন প্রমুখ। মানিকগঞ্জ সদরের যারা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, ডা.সামসুর রহমান, আনোয়ার আলী চৌধুরী, ওয়ারেশ উদ্দিন পাশা, জাফর আলম চৌধুরী ও খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। আরও যাঁরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন, মুনীন্দ্র নাথ ভট্ট্যাচার্য, অরুণ রায় উকিল, প্রিয় নাথ সরকার, নিখিল রঞ্জন ভট্ট্যাচার্য (দক্ষিণাবাবু), সমবায় পরিদর্শক সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী উল্লেখযোগ্য।
 
১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে তীব্রতা পায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্র জনতার মিছিলে কোনো সতর্কাবস্থা ঘোষণা ছাড়াই পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে এতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ নাম না-জানা অনেক আন্দোলনকারী শহিদ হন। রফিক উদ্দিনের মাথার পিছনে গুলি লাগে এবং মাথার পিছনের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ উড়ে যায়। শহিদ রফিক (রফিকউদ্দিন) ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার পারিল বলধারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করেন,  মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ থেকে আই, কম পাস করে পরবর্তীকালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন।
 
সেই দিন (২১ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার মিছিলে মানিকগঞ্জের খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, আ. সালাম, মীর আবুর খায়ের (ঘটু) অংশ নেন। খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র, আ. সালাম ছিলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তৎকালীন সময় ঢাকার মিছিলে গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশব্যাপী তীব্র গণজাগরণ গড়ে ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় ঘিওরের তেরশ্রী স্কুল মাঠ, মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ মাঠ, সিংগাইরের চারিগ্রামে গণপ্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
 
কমরেড প্রমথ নাথ নন্দী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানালে, ১৯৪৮ সালে তেরশ্রীতে এক ছাত্রজনতার বিভোক্ষ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে এক বিশাল মিছিল ঘিওর থানারসহ বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ভাষা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। সকল আন্দোলনকারী গ্রেফতার এড়িয়ে গোপনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পাকিস্তান প্রশাসন আন্দোলনকারীদের ওপর কড়া নজরদারি রাখে। ১৯৪৯সালে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি পুলিশ প্রশাসন হঠাৎ করে তেরশ্রী কে. এন. ইনস্টিটিউশনের চার শিক্ষার্থী মো. ওয়াজ উদ্দিন, মো. রেহাজ উদ্দিন, ভূপেন্দ্র নাথ দাশ (হাসী), মনিন্দ্র নাথ সরকার’কে গ্রেফতার করে। ঘিওর থানার পুলিশ তাদেরকে সাধারণ কয়েদির মতো জেল হাজতে পাঠাতে চাইলে উপস্থিত ছাত্র জনতা প্রতিবাদ করে বাধ্য হয়ে পুলিশ তাঁদেরকে হাতকড়াবিহীন অবস্থায় মানিকগঞ্জ পাঠায়। মানিকগঞ্জ কোর্টের কোন আইনজীবী তাদের পক্ষে কোর্টে দাঁড়াতে সাহস করেনি। মানিকগঞ্জ কারাগারে খাওয়া-দাওয়াসহ জেলখানার অনিয়ম জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ১৬ দিন পর চার জনকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। বয়স ছোট হওয়ায় তাদেরকে ‘ছোকড়া’ সেলে বন্দি রাখা হয়।
 
২১ ফেব্রুয়ারির পরবর্তীসময় ভাষা শহিদদের স্মরণে মানিকগঞ্জের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢাকার অনুরূপ শহিদ মিনার তৈরি করা হয়। কিন্তু তৎকালীন সরকারে পুলিশবাহিনী সবগুলো শহিদ মিনার ভেঙে ফেলে। এরপর আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ নির্মাণ করতে গেলে কর্তৃপক্ষের বাধার কারণে ছাত্রজনতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মানিকগঞ্জ শহরে অ্যাডভোকেট আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের বাসার সামনে শহিদ মিনার তৈরি করে। ১৯৫২ সাল থেকে ঐ শহিদ মিনারটি এখনো মানিকগঞ্জের প্রথম শহিদ মিনার হিসেবে টিকে আছে।
 
দুঃখজনক হলেও সত্য, মানিকগঞ্জে ভাষা আন্দোলন ও ভাষা সৈনিকদের কার্যকলাপের ওপর জেলায় পৃথক কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই। এমনকি ভাষাসংগ্রামী কেউ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। মানিকগঞ্জে ভাষা আন্দোলনের মহানয়ক কমরেড প্রমথ নাথ নন্দী ও তার সহযোগী অন্যান্য আন্দোলনকারীদের স্মৃতির জন্য অবশ্য রাষ্ট্রের এমন কিছু করা উচিত, যাতে করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভাষাসৈনিকদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে পারে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও গবেষক
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত