শনিবার ২১ জুন ২০২৫ ৭ আষাঢ় ১৪৩২
শনিবার ২১ জুন ২০২৫
অসংক্রামক ব্যাধি : প্রতিরোধের বিকল্প নেই
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: শনিবার, ১৩ মে, ২০২৩, ৪:০৫ PM

সারাবিশ্বে অসংক্রামক ব্যাধি নীরব ঘাতকের মতো ধেয়ে আসছে এবং আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অসংক্রামক ব্যাধি এখন মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, বসন্ত, যক্ষ্মা, হামের মতো বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি সহজেই চিকিৎসায় নিরাময় হচ্ছে এবং প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপদ পানি, খাদ্য সরবরাহ, রোগ নির্ণয়ে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা পদ্ধতি, কার্যকরী টিকা কর্মসূচি, সর্বোপরি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সংক্রামক ব্যাধি কমছে এবং মানুষের গড় আয়ুও বাড়ছে।

অসংক্রামক ব্যাধি কোন জীবাণুর মাধ্যমে হয় না এবং একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায় না, অর্থাৎ ছোঁয়াচে না। এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে ছড়ায় না। অসংক্রামক ব্যাধি বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন বয়সজনিত কারণে বার্ধক্যজনিত রোগ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, অস্টিওপরোসিস, অস্টিওআর্থাইসিস, উচ্চ-রক্তচাপ, ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের প্রদাহ এবং  মানসিক রোগ। এধরনের রোগের প্রকোপ মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, হয়ে উঠছে বড় ঘাতক। ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মানুষের পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনীতির ওপর প্রভাব ও চাপ পড়তে শুরু হয়েছে। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলনে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, যেভাবে অসংক্রামক ব্যাধি বেড়ে চলছে তাতে অর্থনীতির উপর বিরাট প্রভাব পড়ছে। এর মূল কারণ এ ধরনের রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। গরিব বা নিম্নবিত্ত, এমনকি অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেও এই রোগের চিকিৎসার ব্যয় বহন করা অসম্ভব। এর আরেকটি অন্যতম কারণ হলো এই ধরনের রোগে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চালাতে হয়।

এ ধরনের ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে তাদের পূর্ব পুরুষের রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে।  পারিবারিক বা জিনগত (জেনেটিক) ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে যোগ হয় পরিবেশগত উপাদান, যেমন পরিবেশ দূষণ, অস্বাস্থ্যকর ও বাজে খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের অভাব, ধূমপান, মানসিক চাপ ইত্যাদি। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান সময়ে অনেক কম বয়সেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে,  সারা পৃথিবীজুড়ে অনেকেই কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে এবং চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। সময়মতো সচেতন হলে বংশ পরম্পরায় থাকা এসব রোগ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও সংক্রামক ব্যাধির চেয়ে অসংক্রামক ব্যাধির ব্যাপকতা অনেক বেড়ে গেছে এবং বর্তমানে বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৬৫ ভাগের জন্য দায়ী। পূর্বে ধারণা করা হতো, অসংক্রামক ব্যাধি শুধু ধনী দেশে বসবাসকারীদের এবং বয়স্ক লোকের হয়। প্রকৃতপক্ষে এ রোগে আক্রান্তদের অর্ধেকই কম বয়সী এবং নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এধরনের ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী এদেশে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৬৫ ভাগ অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত। হাসপাতালে ভর্তির রোগীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ হচ্ছে অসংক্রামক ব্যাধি। মৃত্যুর প্রধান দশটি কারণের মধ্যে অধিকাংশই এসব ব্যাধির জন্য দায়ী, যেমন- কিডনি, ফুসফুস ও লিভার প্রদাহ, হৃদরোগ, ক্যানসার, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, সি.ও.পি.ডি বা শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ ইত্যাদি।

অসংক্রামক ব্যাধির কারণ :

মানুষের জীবনযাত্রার মান, সামাজিক অস্থিরতা, খাদ্যাভ্যাস, যান্ত্রিক জীবন সবকিছু মিলিয়েই অসংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির জন্য দায়ী। আর্থিক অসচ্ছলতা, অশিক্ষা এবং চিকিৎসার অপ্রতুলতা এ সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলছে। আরও কিছু কারণ যেমন: ১. কায়িক শ্রম ও হাটাচলা বা ব্যায়াম না করা। ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যেতে পারে। ২. অলস জীবনযাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া। অধিক ওজন সম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ কোলেস্টারলও বেড়ে যেতে পারে। ৩. খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, শাক-সবজি, ফল-মূল কম খাওয়া, অধিক ক্যালরিসমৃদ্ধ ও অধিক চর্বি-শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস, ফাস্টফুডে আসক্তি, চিনি ও মিষ্টি জাতীয় এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমলপানীয় গ্রহণ। ৪. ধূমপান, তামাকপাতা, জর্দা, গুল লাগানো,  মাদকসেবন। ৫. অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, এর ফলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ে। ৬. খাদ্যে কেমিক্যাল ও ভেজাল। ৭. খেলার মাঠের অভাব, বিদ্যালয়ে শরীরচর্চা বা খেলাধুলার সংস্কৃতির বিলোপ। ৮. মোবাইল, ইউটিউব, টিকটক, ইন্টারনেট, টেলিভিশন, কম্পিউটার গেম ও ফেসবুকের অপব্যবহার। এগুলো ব্যবহারে বাচ্চাসহ যে কোন বয়সের মানুষের অলস জীবনযাপনের প্রবণতা বাড়ছে। ৯. গাড়ি-লিফট-চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহারের প্রবণতা। ১০. জলবায়ু দূষণ। ফলে শ্বাসজনিত রোগ, যেমন হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, সিওপিডি, এমনকি জন্মগত ত্রুটি, ক্যানসার ও হৃদরোগ বেড়ে যাচ্ছে। ১১. অতিরিক্ত টেনশন, মানসিকচাপ, অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভয়ভীতি, এসবগুলো রক্তচাপ বাড়াতে পারে। ১২. মানুষের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। শারীরিকভাবে অসুস্থতাবোধ না করলে কেউ চিকিৎসকের কাছে যায় না এবং নিয়মিত চেকআপ করায় না। এ কারণেই অসংক্রামক ব্যাধি মানুষের ওপর ভর করছে। 

কীভাবে প্রতিরোধ করা যাবে: 

১. এসব ব্যাধির চিকিৎসা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যয়বহুল এবং অনিরাময়যোগ্য হয়ে থাকে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিকার প্রতিরোধ করার বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। ২. আমাদের সামাজিক জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কম চর্বি ও কম কলেস্টারলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চকলেট, আইসক্রিম, চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার যেমন শরবত, গ্লুকোজ, পায়েস ইত্যাদি পরিহার বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ৩. লবণ নিয়ন্ত্রণ: তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে। ৪. কায়িক শ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। সকাল সন্ধ্যা নিয়মিত হাঁটাচলা, হাটে বাজারে কোথাও গেলে অল্প দূরত্বে রিকশা বা গাড়ি ব্যবহার না করা, অল্প কয়েক তলার জন্য লিফট ব্যবহার না করা। সম্ভব হলে সাঁতার বা জগিং করা, ব্যয়ামাগারে গিয়ে ব্যায়াম করা। ৫. অতিরিক্ত মোবাইল, ইউটিউব, ফেসবুক,  টেলিভিশন আর কম্পিউটার ব্যবহারের প্রবণতা কমাতে হবে। ৬. যারা বয়স্ক বা অবসরপ্রাপ্ত তারাও নিয়মিত হাঁটাচলা করতে পারেন। এর সাথে বাগান করা এবং পরিচর্যা করতে পারেন। ৭. নগরবাসীর জন্য ব্যায়াম ও হাঁটার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠের ব্যবস্থা করা। ৮. বাড়তি ওজন কমাতে হবে। এর জন্য খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। ৯. ধূমপান, মদ্যপান, মাদকদ্রব্য, তামাকপাতা ও জর্দা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। ১০. বায়ুদূষণের কারণগুলো চিহ্নিত করে এগুলো প্রতিরোধে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে। সবুজায়ন বৃদ্ধির জন্য প্রচুর গাছপালা লাগাতে হবে। ১১. মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে। নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, নিজের শখের কাজ করা, নিজ ধর্মের চর্চা করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশি হবে। ১২. শিক্ষা ও সচেতনতা অত্যন্ত  জরুরি। এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা, পাঠ্য পুস্তকে এ সম্পর্কে অন্তর্ভুক্তি করা, মিডিয়ার ব্যবহার, শিক্ষক, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং সামাজিক নেতাদের প্রশিক্ষণ, সমাজকর্মীদের সচেতন করে তোলা, সচেতনতা ক্যাম্প ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ১৩. নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া, নিয়মিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি পরীক্ষা করা জরুরি। এমনকি বয়স ৪০ পার হলে প্রতি বৎসর মেডিকেল চেকআপ করা উচিত।

আমাদের স্বাস্থ্যখাতে সফলতা আছে, সীমাবদ্ধতাও আছে। অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে আমাদের সঠিক পরিকল্পনা করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে, কারন এসব ব্যাধি আজ মারাত্মক জনস্বাস্থ্যের সমস্যা, যেগুলো কখনো নির্মূল করা যাবে না। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। রোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের ব্যাপারে বেশি যত্নবান হতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যেহেতু একবার আক্রান্ত হলে এ ধরনের ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না, তাই সচেতনতা ছাড়া প্রতিরোধের বিকল্প নেই।

লেখক : ইমিরেটাস অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও  প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


Also News   Subject:  অসংক্রামক   প্রতিরোধ  







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত