রবিবার ২০ জুলাই ২০২৫ ৫ শ্রাবণ ১৪৩২
রবিবার ২০ জুলাই ২০২৫
ইন্টারনেট নির্ভরতায় স্বাস্থ্যঝুঁকি
ড. মো. মাহমুদুল হাছান
প্রকাশ: সোমবার, ২৬ জুন, ২০২৩, ৪:১৩ PM

ইন্টারনেট আধুনিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেটের ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। বিভিন্ন উদ্দেশ্যেই বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ দিন-রাত ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। কিন্ত আমরা হয়তো বা বুঝতেই পারি না যে, ইন্টারনেট ব্যবহার করা কেবল আমাদের অভ্যাস নয়, একটি আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। এই আসক্তির কারণেই আমরা সারাবিশ্বের মানুষের মধ্যে মানসিক ব্যাধির অত্যাধিক বৃদ্ধি লক্ষ্য করি।  এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতা যা জীবনের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শুধু ইন্টারনেট আসক্তি নয়, ইন্টারনেট গেমিং ডিসঅর্ডার (আইজিডি) আমাদের মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অত্যধিক ইন্টারনেট ব্যবহার অনেক মানসিক এবং মনোসামাজিক ব্যাধির সাথে সম্পর্কিত। এতে আমাদের শিক্ষার্থী সমাজ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।

সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মানসিকভাবে অসুস্থ শিক্ষার্থীদের ৮৬ শতাংশই শুধু অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে এবং ৭২.২ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। সম্প্রতি আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রভাব : সতর্ক হওয়া জরুরি’ শীর্ষক সমীক্ষায় ১৭৭৩ জন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম জরিপ চালানো হয়, যাদের মধ্যে ছিলো ৪৯.৫ শতাংশ নারী, ৪৯.৭ শতাংশ পুরুষ এবং ০.৮ শতাংশ তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে ১৬ থেকে ১৯ বছরের শিক্ষার্থী ১৩.২ শতাংশ, ২০ থেকে ২৫ বছরের শিক্ষার্থী ৭৬.৩ শতাংশ এবং ২৬ থেকে ৩০ বছরের শিক্ষার্থী ছিলো ১০.৫ শতাংশ। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৮.৬ শতাংশ কলেজপড়ুয়া, ৬৪.৩ শতাংশ স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী, ৮.৪ শতাংশ স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী এবং ৮.৭ শতাংশ চাকরিপ্রত্যাশী।

উক্ত সমীক্ষায় এটিও দেখা যায় যে,  ৩৮.২ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বিষয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ৬৭.৫ শতাংশ অবসর সময় কাটাতে, ৪২.৯ শতাংশ যোগাযোগের প্রয়োজনে, ২৪.৯ শতাংশ অনলাইন গেম খেলতে বা ভিডিও দেখতে, ১২.৬ শতাংশ অনলাইনে কেনাকাটা করতে এবং ৮ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে। সমীক্ষা মোতাবেক আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের বড় অংশই অফলপ্রসূ কাজে ইন্টারনেটে বেশি সময় ব্যয় করে। দিনে ১১ ঘণ্টার ওপরে অনলাইনে থাকে ৬.২ শতাংশ শিক্ষার্থী। ১৯.৫ শতাংশ  শিক্ষার্থ ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার মতো ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা ইন্টারনেটে থাকে ৩৬.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং ৩২.৩ শতাংশ ব্যবহার করে ২ থেকে ৪ ঘণ্টার মতো।

উক্ত জরিপে জানা যায়, ইন্টারনেটের কারণে ৫৭.২ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তাদের মধ্যে ৫৯.৬ শতাংশ মনে করে ইন্টারনেটে সময় ব্যয় তাদের পড়াশোনার ক্ষতি করছে। ১৭.৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ইন্টারনেটে পর্ন দেখা, সাইবার ক্রাইম, বাজি ধরা ও বুলিংসহ অপ্রীতিকর কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছে। ২৩ শতাংশ অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছেন, ৩৫.৬ শতাংশ ডিপ্রেশনসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপ অনুভব করেছে এবং ২০.৩ শতাংশ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২৩.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেÑ তাদের বাস্তব জীবনের পাশাপাশি আরেকটি ভার্চুয়াল জগত তৈরি হয়েছে; ১৯.৫ শতাংশ জানিয়েছে মন খুলে কথা বলার মত মানুষ পাচ্ছে না। এছাড়াও ৯.৯ শতাংশ জানায়, তারা এর প্রভাবে সামাজিকভাবে মিশতে পারছে না।

সোশ্যাল মিডিয়া ঘাটতে ঘাটতে আমাদের শিক্ষার্থীরা মনের অজান্তে কিভাবে ইন্টারনেট আসক্তিতে পড়ছে, তা আমরা বুঝতেই পারছিনা। ইন্টারনেট আসক্তিতে মানসিক ব্যাধি সৃষ্টির অনেক কারণ রয়েছে।  যখন কারোর ইন্টারনেট আসক্তি থাকে, তখন তার মস্তিষ্ক এমনভাবে কাজ শুরু করে যেন একজন আসক্তের মস্তিষ্ক কাজ করছে।  ইন্টারনেট নির্ভরতা অ্যালকোহল বা নেশাজাতীয় ড্রাগ নির্ভরতার থেকেও মারাত্মক। এটি শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল অঞ্চলকে প্রভাবিত করে। ফলে তাদের জন্য বিশদ মনে রাখা, পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়া, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফোকাস করা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোন কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আসক্তিমূলক আচরণ ডোপামাইন নিঃসরণকে এমনভাবে  ট্রিগার করে যেন  তারা একরকম আনন্দ পেতে এর থেকে আরও বেশি ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।

ইন্টারনেট আসক্তিতে শিক্ষার্থীদের পরিবর্তনশীল আচরণের শক্তি বৃদ্ধি পায়। ফলে তারা ইন্টারনেট ভিত্তিক গেম, কেনাকাটা বা জুয়া খেলায় মত্ত হয়ে উঠছে এবং এক পর্যায়ে  তারা এ থেকে ভার্চুয়াল পুরস্কারও জিতে নিচ্ছে। এ আসক্তির কারণে তারা এতটাই সোশ্যাল মিডিয়াতে সময় ব্যয় করছে যে তারা সর্বক্ষণই বন্ধুদের সাথে আড্ডায় লিপ্ত থাকছে।

প্রায় সকল শিক্ষার্থীই তাদের ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে বা সেটি নিয়েই তারা বেশি ব্যস্ত থাকছে। এতে বুঝা যায় যে, তাদের অধিকাংশই ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডারে ভুগছে। এটি এমন একটি ব্যাধি, যা প্রথমে শনাক্ত করা একটু কঠিন হলেও, কতিপয় লক্ষণ দেখে বুঝা যায় যে, তারা ইন্টারনেট আসক্ত। বিশেষ কয়েকটি লক্ষণের মধ্যে নিম্নোক্ত উদ্বেগ ও বিষণ্নতা, অপরাধবোধ, অগ্রাধিকার দিতে বা সময়সূচির ট্র্যাক রাখতে অক্ষমতা, বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা এবং মিথস্ক্রিয়ার অভাব, সময়বোধ হারানো, কাজে বিলম্ব করা বা কাজ এড়িয়ে চলা, সব ব্যাপারে ক্ষীপ্রতা প্রদর্শন, ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন, ভয় ভয় অনুভব করা, দৈনন্দিন কাজে একঘেয়েমি ভাব থাকা এবং কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া ইত্যাদি।

এছাড়াও ইন্টারনেট আসক্তির কারণে যেমন মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, তেমনি  শারীরিক স্বাস্থ্যেরও অনেক ঝুঁকি রয়েছে। নিম্নের কয়েকটি লক্ষণ দেখে তা সহজে বুঝা যাবেÑ পিঠে ও ঘাড়ে ব্যথা, কারপাল টানেল সিন্ড্রোম, হাত ও বাহুতে অসাড়তা এবং দুর্বলতা, ঘন ঘন মাথাব্যাথা, অনিদ্রা ও ঝিমুনি, পুষ্টির অভাব, স্ক্রিন টাইম বাড়ানোর কারণে চোখ শুষ্ক এবং অন্যান্য দৃষ্টি সমস্যা, ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস এবং শারীরিক অক্ষমতা ও দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়া।

ইন্টারনেট আসক্তির মারাত্মক প্রভাব আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে মানসিকভাবে যে ক্ষতি সাধন করছে, তাতে এর প্রতিকার নাহলে অচিরেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। এজন্য চাই সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা ও সমাধান। শারীরিক ব্যাধি নিরাময়ে যেমন এর ব্যবহারযোগ্য ট্যাবলেট বা সিরাপ রয়েছে, ইন্টারনেট আসক্তিতে সৃষ্ট মানসিক ব্যাধি উপশমে কিন্তু ভক্ষণযোগ্য দৃশ্যমান কোনো মেডিসিন নেই। এ ব্যাধি নিরাময়ে প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের অবিচল বিশ্বাস যে, তারা যেন ইন্টারনেটের অপব্যবহার না করে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় যেন তারা ইন্টারনেটভিত্তিক ডিভাইসে সময় না কাটায়।  ইতিবাচক উপায়ে তাদের আচরণে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে হবে। শারীরিক কার্যকলাপ ইন্টারনেট আসক্তির চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য অবশ্যই ধ্যান-জ্ঞান করে রুটিন মাফিক বিষয়ভিত্তিক বই-পুস্তক পড়াশোনা করতে হবে, লাইব্রেরিতে বইপড়ার কাজে সময় দিতে হবে, বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সাথে বেশি সময় কাটাতে হবে, ইনডোর বা আউটডোর ক্রীড়াঙ্গনে নিয়মিত খেলা করতে হবে এবং শ্রেণি কার্যক্রমসহ অন্যান্য সহপাঠ্যক্রমিক কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ইন্টারনেটের বিকল্প হিসেবে বিনোদনধর্মী কিছু গল্প বা উপন্যাস পড়লেও ইন্টারনেট আসক্তি রোধ করা সম্ভব হতে পারে।

শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্ত রাখতে বা এর অতিব্যবহার রোধ করতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হয়েছে। ইন্টারনেট আসক্তি শিক্ষার্থীদের  শারীরিক, সামাজিক এবং মানসিক ব্যাধি সৃষ্টি করতে পারে, এটি মাথায় রেখেই আমাদের উচিত তাদেরকে সার্বক্ষণিক কাউন্সেলিং করা; ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত করা।

লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত