রোদেলা (ছদ্মনাম) চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। দেখেই বোঝা যায়, ক’দিন ঠিকঠাক ঘুম-খাওয়া হয়নি। সদ্য এমবিবিএস পাস করা এই তরুণী ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে আছেন। একটু পর পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলা শুরু করেন মণিপুরি নৃগোষ্ঠীর এ চিকিৎসক।
জানা যায়, দু’দিন পরই তাঁর বিয়ে। এমন আয়োজনের মধ্যে হঠাৎ কয়েক দিন আগে তার নামে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে সাবেক প্রেমিকের সঙ্গে তোলা অন্তরঙ্গ ছবি পোস্ট করা হচ্ছে। বিয়ের আগমুহূর্তে এমন পরিস্থিতির ভয়াবহতা বর্ণনা করে ‘আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো পথ নেই’ বলে কেঁদে ওঠেন তিনি।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার হেল্প ডেস্কে এমন দৃশ্য দেখা যায়। শুধু রোদেলা নন, সারাদিনে এমন অনেক ভুক্তভোগীর দেখা মেলে সেখানে।
সিটিটিসি সাইবার ইউনিটের হেল্প ডেস্কে প্রতিদিনই এমন অনেক ভুক্তভোগী তরুণ-তরুণী আসেন। তাদের নিচু স্বরে কথা বলা ও ফোঁপানো কান্নায় কক্ষের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। প্রতারণাসহ সাইবার অপরাধ-সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আসেন তারা। তবে সবাই যেন নিজের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চান। পাশের লোকও যেন তাঁর সমস্যার কথা না জেনে যায়। কেউ তাঁর কথা শুনলে হয়তো নতুন কোনো বিপদে পড়তে পারেন! সাইবার হেল্প ডেস্ক এমনই এক অন্য জগৎ।
হেল্প ডেস্কের এক কর্মকর্তা রোদেলাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘চিন্তা করবেন না। আমরা এখনই এটার সমাধান করছি।’ কিন্তু কিছুতেই যেন ভরসা পাচ্ছিলেন না রোদেলা।
পরে তাঁর লিখিত অভিযোগ নিয়ে পাশের কক্ষে সহকর্মীদের নিয়ে আলোচনা করেন সাইবার ইউনিটের টিম লিডার। একটু পর বেরিয়ে এসে এক দিন অপেক্ষা করতে বলেন ভুক্তভোগীকে। পরে সমাধান করে দেয় হেল্প ডেস্ক। তবে আইনি জটিলতার ভয়ে মামলা করেননি রোদেলা।
হেল্প ডেস্কে কথা হয় আরেক ভুক্তভোগী আরাধ্য দাসের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ওই শিক্ষার্থীও আসেন রোদেলার মতো প্রেমিকের সঙ্গে তোলা গোপন ছবি ও ভিডিওর বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে। অপরাধী মেয়েটির (আরাধ্যর) ফেসবুক ইনবক্সে ছবিগুলো পাঠিয়ে বলছে, তার কথামতো চলতে হবে। যখন যা বলবে শুনতে হবে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ওই তরুণী বাড়িতে গেলে গোপনে তাদের গৃহকর্মী ফোন থেকে ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও কপি করে নেয়। পরে সেগুলো ঢাকায় থাকা তার এক বন্ধুর কাছে পাঠায়। সেই বন্ধু তরুণীকে ব্ল্যাকমেইল করছে।
সিটিটিসির উদ্যোগে চার বছর আগে হেল্প ডেস্কটি গঠনের পর প্রতিদিন কয়েক ডজন এমন অভিযোগ জমা পড়ছে। এসব ঘটনায় পাঁচ শতাধিক অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায়ও নিয়ে এসেছে ইউনিটটি।
সাইবার সেলের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সিটি ভিকটিম সাপোর্ট হেল্প ডেস্কে আসা ৩ হাজার ৩৭৩টি, ফেসবুকে ৪২ হাজার ২০০টি, ই-মেইলের ৩৪৮টি ও হ্যালো সিটিতে ৮ হাজার ৯৩৯টি অভিযোগ সমাধান করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪৩৫টি মামলা, ৫৫টি জিডি এবং জিডি-পরবর্তী সহায়তা দিয়েছে ১ হাজার ৩৯৬টি।
ডিএমপির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও সিটিটিসির আলাদা ইউনিট রয়েছে। এর বাইরে আরেকটি স্বতন্ত্র ইউনিট করার উদ্যোগ নিয়েছে ডিএমপি। একজন উপকমিশনার (ডিসি) পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিনজন এডিসি, তিনজন এসিসহ পরিদর্শক ও ফোর্স নিয়ে এ ইউনিট গঠন করা হবে। অত্যাধুনিক এ সাইবার সেলে সব কর্মকর্তা ইউনিফর্মে দায়িত্ব পালন করবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, সাইবার অপরাধ থেকে বাঁচতে সবার আগে নিজেকে সতর্ক থাকতে হবে। মোবাইল ও নেট ব্যবহারকারীকে অবশ্যই খেয়াল করতে হবে, তিনি কোন ধরনের ছবি ফোনে ধারণ করছেন। সবারই আগ্রহ প্রিয়জনের সঙ্গে ভালো মুহূর্তের ছবি থাকবে। কিন্তু সেটা কতটুকু ভালো, সেটা কি সমাজে গ্রহণযোগ্য? যদি সমাজে গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে এমন ছবি ফোনে রাখা ঠিক নয়।
উঠতি বয়সী কিশোরী ও তরুণীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সাইবার জগতে বিচরণের ক্ষেত্রে সাবধানতার কোনো কমতি রাখা যাবে না। এ ছাড়া অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে সচেতন থাকতে হবে। আর ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও আদান-প্রদান করা থেকে বিরত থাকা সবচেয়ে নিরাপদ।
সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, সিটি সাইবার হেল্প ডেস্কে বেশি আসে ফেসবুক হ্যাক করে প্রতারণার ঘটনা। এ ছাড়া প্রেমঘটিত সম্পর্কের জেরেও ভুক্তভোগী হচ্ছে অনেকে। প্রতিদিন এসব অভিযোগ নিয়ে একাধিক ভুক্তভোগী আসেন। তবে ভুক্তভোগীকে অবশ্যই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে কপি নিয়ে আসতে হয়। এর পর তাদের থেকে একটি লিখিত অভিযোগ নেওয়া হয়। সেটার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।