বৃহস্পতিবার ৩ জুলাই ২০২৫ ১৯ আষাঢ় ১৪৩২
বৃহস্পতিবার ৩ জুলাই ২০২৫
ঘটনা-দুর্ঘটনার একটি সপ্তাহ
আবদুল মান্নান
প্রকাশ: সোমবার, ২৭ মে, ২০২৪, ২:৪১ PM
এক সপ্তাহেরও কম সময়ে দেশে ও দেশের বাইরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল। ২০ মে নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টে (আইসিসি) ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালানোর দায়ে আদালতের প্রধান কৌঁসুলি করিম এ এ খান ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভা গ্যালান্ত ও তিনজন হামাস নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন। 

আইসিসির কৌঁসুলি নিয়োগ করে জাতিসংঘ। এই গণহত্যার অন্যতম মদদদাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাউডেন ঘোষণা করেন, ফিলিস্তিনে কোনো গণহত্যা হচ্ছে না। বাইডেন আরো বলেন, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানারা যদি একমত হন, তাহলে তিনি আইসিসিকে নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নেবেন।

উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাটির অস্তিত্বই স্বীকার করে না এবং যুক্তরাষ্ট্রে ‘দ্য হেগ ইনভেসন অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন আছে, যাতে বলা হয়েছে, আইসিসি কখনো মার্কিন কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির বিচার করতে পারবে না। যদি করা হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র হেগ দখল করতে পারবে। হেগ অন্য একটি স্বাধীন দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গণহত্যা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু আজ পর্যন্ত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা এই দেশটিকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিশ্বের কোনো আদালতে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র নিজের প্রয়োজন ও স্বার্থে করতে পারে না এমন কোনো কাজ নেই। বিশ্বের সবচেয়ে ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধী ছিলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ১৯৬৯ থেকে শুরু করে ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত কিসিঞ্জার দীর্ঘ সময় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

এই দীর্ঘ সময়ে কিসিঞ্জারের অন্যতম অর্জন ছিল ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চিলিসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কয়েক লাখ মানুষ হত্যা এবং দেশে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনে মদদ দেওয়া। কয়েকটি দেশে সরকার উৎখাতে সরাসরি জড়িত ছিলেন কিসিঞ্জার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, তার সঙ্গে কিসিঞ্জার সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁকে বলা হতো একজন জীবন্ত যুদ্ধাপরাধী। তিনি শেষ জীবন পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গিয়েছেন। এমন একজন মানবতাবিরোধী অপরাধীকে নোবেল শান্তি পুরস্কারও দেওয়া হয়েছিল।

আইসিসিতে নেতানিয়াহু ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই ২০ মে বিশ্ব জানল ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী একটি হেলিকপ্টার ইরান-উজবেকিস্তানের সীমান্তে নিখোঁজ হয়েছে। রাইসির সঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পরে ইরান ঘোষণা করে, রাইসিসহ ওই হেলিকপ্টারের কোনো যাত্রী বেঁচে নেই। ইব্রাহিম রাইসি ও তাঁর সফরসঙ্গীদের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পশ্চিমা দুনিয়ার গণমাধ্যমে চাউর হওয়া শুরু হয়েছে। 

সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তত্ত্বটি আসে ফ্রান্সের একটি টেলিভিশনের একজন বিশ্লেষকের কাছ থেকে। তাঁর দেওয়া তথ্য মতে, হেলিকপ্টারটির চালক ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন সদস্য ছিলেন। গুপ্তহত্যায় সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ ও মোসাদের খ্যাতি রয়েছে। এর আগে ইরানের একজন পরমাণুবিজ্ঞানীকে মোসাদ চলন্ত পথে দূর নিয়ন্ত্রিত মেশিনগানের সহায়তায় হত্যা করেছিল। ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ড্রোনের সাহায্যে ইরানের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরে হত্যা করেছিল। 

গত ২ এপ্রিল ইসরায়েল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে একই কায়দায় ইরানের দূতাবাসে হামলা চালিয়ে সাতজন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে, যাঁদের দুজন ছিলেন ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার। এই ঘটনার পাল্টা হিসেবে রাইসির নির্দেশে ইরান ইসরায়েলে ভয়াবহ মিসাইল হামলা করে। এতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই চরম ক্ষুব্ধ হয় এবং ঘোষণা করে, এই ঘটনার বদল নেওয়া হবে। তত্ত্ব ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহলে কি হেলিকপ্টারটির যোগাযোগব্যবস্থা জ্যাম করে দেওয়া হয়েছিল? এই প্রযুক্তি খুব সহজলভ্য। আঙুল আবারও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দিকে। 

কারো কারো মতে, আকাশ থেকে (হতে পারে স্যাটেলাইট) লেজার দিয়ে হেলিকপ্টারটির গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগব্যবস্থা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি অকেজো করে দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এটি করা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। ইরান এখন পর্যন্ত এই ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী করেনি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের একজন মূখপাত্র গণমাধ্যমের সামনে এসে জানিয়ে দেন, ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ যেন ‘ঠাকুর ঘরে কেরে, আমি কলা খাই না’ প্রবাদের মতো।

এখন সব শেষে আসি বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ (অবসর ২০২১ সালের ২৪ জুন) ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের বিষয়টির আলোচনায়। তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ এনেছে। যুক্তরাষ্ট্র আরো বলেছে, ‘তাঁর কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে।’ যুক্তরাষ্ট্র এমন এক দেশ, যেটি অন্য আরেকটি দেশের প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্রেফ অভিযোগ তুলেই সেই অভিযোগের বিরুদ্ধে কোনো শুনানির সুযোগ না দিয়ে তার বিরুদ্ধে সাজা শুনিয়ে দিয়ে থাকে। অথচ নিজের দেশের হাজারটা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও আসামি খালাস পেয়ে যায়।

এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের পরম পছন্দের একজন বাংলাদেশি নাগরিকের বাংলাদেশের আদালতে বিচার হচ্ছে। তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার থেকে শুরু করে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নেই, যাঁরা মাতম করেননি বা করছেন না। বাংলাদেশের আইনে দোষী প্রমাণিত হলে তিনি সাজাপ্রাপ্ত হবেন আর না হলে অব্যাহতি পাবেন। এটি তো সেই বাংলাদেশে, যেখানে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকদের বিচার না করার জন্য সংবিধান বদল করে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় এমন একটি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের তো কোনো প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের কোনো মিত্র থেকে শোনা যায়নি। আবার জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করার পর যখন সংবিধানের এই দায়মুক্তি ধারা বাতিল করে, তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই তাদের অস্বস্তি প্রকাশ করে। ঘাতকদের দু-একজন এখনো যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশে নিরাপদে বসবাস করছে। বাংলাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করল, তখন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সে কী আহাজারি!

যেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র ব্র্যান্ডের গণতন্ত্র চর্চা করা হবে, সেখানে থাকতে হবে প্রাকৃতিক সম্পদ। আর দেশটি যদি কৌশলগত কারণে গুরুত্ব্পূর্ণ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে এই বিপদেই আছে, যা প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার ১৪ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের সময় বলেছেন। তিনি একজন ‘সাদা’ মানুষের আবদার না রাখার কথা বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন, এই সাদা মানুষদের কথা না শোনার কারণে তিনি এই মুহূর্তে বেশ চাপে আছেন। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের দু-একজন বেতনভুক ‘শিক্ষিত নাগরিক সমাজে’র সদস্য এরই মধ্যে আবার বেশ লম্ফঝম্প শুরু করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়ই তাঁর বিরুদ্ধে চলা ষড়যন্ত্রের কথা বলেন। তাঁর তো মনে থাকার কথা গত নির্বাচনের আগে তাঁর প্রতিপক্ষের মোসাদ কানেকশন। তিনি তাঁর চারপাশে তাঁকে ঘিরে থাকা মানুষগুলোকে নিয়ে কত দূর এই ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে পারবেন, সেটি তিনিই ভালো জানেন। তাঁর পিতা কিন্তু পারেননি। তাঁর সাহস ও দৃঢ়তা এত দিন পর্যন্ত তাঁকে টিকিয়ে রেখেছে। ভবিষ্যতে কী হবে, তা দেখার বিষয়। শেষ করি কিসিঞ্জার ডকট্রিন বলে খ্যাত হেনরি কিসিঞ্জারের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে। তিনি বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হওয়া বিপদের কারণ হতে পারে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হলে তা আত্মঘাতী হতে পারে।’

লেখক : শিক্ষাবিদ, বিশ্লেষক ও গবেষক

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত