শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫ ৬ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫
আওয়ামী লীগের সঞ্চয় ও চ্যালেঞ্জ
হারুন হাবীব
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০২৪, ১১:৫৬ AM
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ রবিবার। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই রাজনৈতিক দলটির জন্ম। প্রতিষ্ঠাকালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ন সম্পাদক নির্বাচিত হন।

প্রথম পূর্ব পাকিস্থান আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করে উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটি। ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। 

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ রবিবার। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই রাজনৈতিক দলটির জন্ম। প্রতিষ্ঠাকালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ন সম্পাদক নির্বাচিত হন। প্রথম পূর্ব পাকিস্থান আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করে উপমহাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটি। ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে।

সামরিক ও স্বৈরতান্ত্রিক পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা এবং সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র গঠনের সফলতার কৃতিত্ব যে দলটির তার নাম আওয়ামী লীগ। পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বানানোর কৃতিত্বই শুধু নয়, আওয়ামী লীগ দলটির মুকুটে আরও অনেক সোনালি পুচ্ছ যোগ হয়েছে; যা তাকে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলের মর্যাদা দিয়েছে, অন্যদিকে অনেক সংকট-সীমাবদ্ধতার পরেও এ জনপদের অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার মূল গণসংগঠনে পরিণত করেছে।

সাত দশকের বেশি সময় ধরে পথচলা আওয়ামী লীগের ইতিহাস নানা অধ্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, জন্মলগ্নের বাস্তবতা; দ্বিতীয়ত, সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম; তৃতীয়ত, ছয় দফার জাতীয় জাগরণ অধ্যায়; চতুর্থত, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ অধ্যায়; পঞ্চমত, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর হত্যা এবং ষষ্ঠত, ১৯৯৬ থেকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস। স্মরণযোগ্য, এ প্রতিটি অধ্যায়ে আওয়ামী লীগ যেমন প্রবল প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে, তেমন বিকশিত হয়েছে। তবে সে পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ।

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। দিনটি পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র চার মাস ২০ দিনের মাথায় তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ছাত্রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এক বছরের মাথায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেনে’ আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং জেলে বন্দি থেকেও শেখ মুজিবুর রহমান দলটির অন্যতম যুগ্মসম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পর থেকেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে।

প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল গণতন্ত্র, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভোট, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈষম্য দূর করা। সেই শুরু পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দীর্ঘ যাত্রাপথ। আওয়ামী মুসলিম লীগ হয় ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ। নামের এ পরিবর্তন দলীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণের প্রমাণ।

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালে সূচিত আন্দোলন ১৯৫২ সালে পরিণতি লাভ করে। তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। এ আন্দোলনের পথ বেয়ে বাঙালির জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে, বপিত হয় স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচিন্তার বীজ। এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা দল মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এর পেছনে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের কারণে যুক্তফ্রন্ট সরকার টিকতে পারেনি।

কিন্তু স্বল্পসময়ের জন্য এসেও যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলায় এক মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করে। বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হয় ‘শহীদ দিবস’-এ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ প্রায় সম্পন্ন হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। এরপর যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

এর পরের অধ্যায়ে পাকিস্তানি রাজনীতি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধাবিত হয়। ক্রমাগত বঞ্চনা ও বিশেষত ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের আলোকে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফা উত্থাপন করেন। এ কর্মসূচি জাতিকে দ্রুত ঐক্যবদ্ধ করে। স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণ। শেখ মুজিব এ সময় দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক। ফলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। 

জেলবন্দি হন দলের প্রায় সব নেতা। অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি দেন সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বন্দিমুক্তি ও ছয় দফার দাবিতে আওয়ামী লীগ আহূত হরতালে ঢাকার রাজপথ শ্রমিক-জনতার রক্তে রঞ্জিত হয়। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। কিন্তু ছয় দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিয়ে শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিব ভূষিত হন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। পতন ঘটে আইয়ুব খান স্বৈরাচারের।

এরপর আসেন আরেক জেনারেল, ইয়াহিয়া খান। নতুন সামরিক জান্তা সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট লাভ করে। শেখ মুজিবুর রহমান আবির্ভূত হন বাংলার গণমানুষের অবিসংবাদিত ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে।

এবারেও শুরু হয় আরেক ষড়যন্ত্র। সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ফলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জাতিকে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দান করেন। স্বাধিকার আন্দোলন রূপান্তরিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। সান্ধ্য আইন, গুলি ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বাংলার মানুষ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অচল ও অকার্যকর হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসন। প্রশাসন ও জনগণ চলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে বিকল্প সরকার।

এ পরিস্থিতিতেও সামরিক শাসকের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনী বাংলার মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচার গণহত্যা শুরু করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।

পরের পর্যায়টি দলীয় ও জাতীয় ইতিহাসের আরেক চমকপ্রদ অধ্যায়। ভারতের মাটিতে বসে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে গঠন করে বাংলাদেশের প্রথম সরকার। সেই সরকার শপথ নেয় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায়। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নয় মাসের বীরোচিত মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং ৩ লক্ষাধিক নারীর আহাজারির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর রমনার রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান বাহিনী। শেষ হয় ২৪ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দুরূহ সংগ্রাম। নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ অনেকটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ভারতের মাটিতে আশ্রয় নেওয়া ১ কোটি শরণার্থী দেশে ফিরে আসে। বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার শূন্য। ব্যাংকে নগদ অর্থ নেই, নেই কোনো উপযুক্ত প্রশাসনিক কাঠামো, দক্ষ লোকবল।

বস্তুত এক ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে। স্বল্পতম সময়ে বাংলাদেশ যুদ্ধের ক্ষত মুছে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। মাত্র তিন মাসের মাথায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী স্বদেশে ফিরে যায়। বাংলাদেশের নিজস্ব সেনা, নৌ, বিমান ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর) সংগঠিত করে দেশের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করেন বঙ্গবন্ধু। সুসংগঠিত করেন পুলিশ, আনসার ইত্যাদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাংলাদেশ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি অর্জন করে।

অন্যদিকে মাত্র নয় মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ একটি সংবিধান উপহার দেয়। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরাজিত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, অন্তর্ঘাত, বন্যা, খরা ও কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে বসে। কিন্তু স্বাধীনতার শত্রুরা বসে থাকে না। তারা সর্বমুখী অন্তর্ঘাত শুরু করে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটানো হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু জাতীয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ গড়ে তোলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা মরণাঘাত হানে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের অধিকাংশকে হত্যা করা হয়। খুনিচক্র এখানেই থেমে থাকে না। তারা ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকেও রাতের অন্ধকারে হত্যা করে। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাস কালো চাদরে ঢাকা পড়ে। আবারও জাতির বুকে চেপে বসে সামরিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্রের জগদ্দল পাথর।

অর্থাৎ বাংলাদেশ আবারও পাকিস্তানি লিগেসির কাছে ফিরে যায়। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে সৃষ্ট দেশ আবারও উগ্র সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে দেশ জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়। সংবিধান স্থগিত ও পার্লামেন্ট বাতিল করে জারি করা হয় নিরঙ্কুশ সামরিক শাসন। আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। জেনারেল জিয়া নিজের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করেন প্রতিরক্ষা বাহিনীকে। জেনারেল এরশাদ জিয়ারই পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।

এই সামরিক শাসকরা সংবিধান যথেচ্ছভাবে সংশোধন করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্র-বৈশিষ্ট্য পাল্টে দেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্বাসিত করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে পুনর্বাসিত করা হয়। সৃষ্টি করা হয় আতঙ্কের পরিবেশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপনে বাধ্য হয়। ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক সাহায্যনির্ভরতা স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। মুখ থুবড়ে পড়ে স্বাধীনতার অঙ্গীকার।

এসবের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম যার পুরোভাগে থাকে আওয়ামী লীগ। ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নতুন গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান হয়, ক্ষমতাত্যাগে বাধ্য হন জেনারেল এরশাদ। অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদের নির্বাচন। ষড়যন্ত্র ও আঁতাতের অংশ হিসেবে ১৯৯১-এ বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়। চরম নির্যাতন উপেক্ষা করে নব্য স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ। গণঅভ্যুত্থানের মুখে খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ১২ জুন অনুষ্ঠিত অবাধ নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। অবসান হয় ২১ বছরের দুঃসহ স্বৈরশাসন।

সে কারণেই বলি, রাষ্ট্র গঠন ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বহুবিধ বড় অর্জন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের যাত্রাপথ কখনও কণ্টকহীন ছিল না। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আজ অনেকাংশে ফিরে এসেছে। জাতীয় ইতিহাসের পুনরুদ্ধার ঘটেছে। জাতির পিতার হত্যাকারী ও মুক্তিযুদ্ধের ঘাতকদের বিচার সম্পন্ন করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ, যা এক অসামান্য কৃতিত্ব।

অনেক সাফল্য আছে আওয়ামী লীগ সরকারের। অবকাঠামো, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রবৃত্তিতে দেশ এগিয়েছে প্রভূত। কিন্তু নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে সংকট দূর করা যায়নি। বিরোধী দলসমূহ নির্বাচন বয়কট করেছে। তাদের এন্তার অভিযোগ ভোট নিয়ে। দুর্নীতি দূর করা সম্ভব হয়নি। দূর হয়নি ধনী-দরিদ্রের ফারাক। বাংলাদেশ মানবিক বাংলাদেশ হয়নি। রাজনৈতিক কৃতিত্বের পরও তাই এ বিষয়গুলোর মূল্যায়ন জরুরি। মনে রাখা দরকার, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা দমন করা ছাড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মঙ্গল নেই। কখনও সুযোগ নেই আত্মতুষ্টির।

আরও একটি দিক আছে, যা ভাববার। রাজনীতির আদর্শবাদী চর্চার চেয়ে বহিরঙ্গের রাজনীতিই যেন প্রকট হচ্ছে। আত্মতুষ্টি সমাজবাস্তবতাকে গ্রাস করছে। নীতিহীনতা গ্রাস করছে। মনে রাখতে হবে, মুজিবকোট গায়ে চাপালেই মুজিববাদী হওয়া যায় না। অন্যদিকে টানা শাসনকালের ফলে দলের নানা স্তরে আদর্শবিরোধীরা অনুপ্রবেশ করেছে। এ অনুপ্রবেশ ঘটেছে কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে, কিছু ক্ষেত্রে দলীয় নেতাদের অসাবধানতায়। ফলে বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার প্রতি ব্যাপক অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। এসব যদি রোধ করা না যায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সংকট অনেক বেশি ঘনীভূত হবে।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক 

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত