বৃহস্পতিবার ৩ জুলাই ২০২৫ ১৯ আষাঢ় ১৪৩২
বৃহস্পতিবার ৩ জুলাই ২০২৫
ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কৌশলী কূটনীতি
ড. আব্দুল্লাহ হেল কাফি
প্রকাশ: রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪, ২:৫০ PM
বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে আগামী বছর। এই উপলক্ষ সামনে রেখে ৮ জুলাই চীন সফরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সফরে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা আছে। 

চার দিনের সফর শেষ করে আগামী ১১ জুলাই দেশে ফিরবেন তিনি। চলতি বছর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়েছে। ভারত সফরে ১১টি সমঝোতা স্মারকে চুক্তি হওয়ার পাশাপাশি দুই দেশের অগ্রগতি-উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সংগতকারণেই প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। কারণ, চীনের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিরিখে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মূল্যায়ন করা জরুরি। 

মনে রাখা জরুরি, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। এই ধরনের সম্পর্ক বাণিজ্যিক-কূটনৈতিক পর্যায়ের। ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তাবিষয়ক কোনো সমঝোতা হলে দেখা যেত, এ ক্ষেত্রে শুধু ভারত নয় পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশই আপত্তি জানাত। তেমনটি যেহেতু নয় সেহেতু চীনের সঙ্গে এবারের সফর আমাদের কূটনৈতিক চ্যানেলের জন্য একটি বড় সাফল্য অবশ্যই। বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কৌশলী কূটনীতির বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। লক্ষণীয় এই আলোকেই সম্পর্কের সমীকরণ চলছে।

ফিরে দেখি অতীতে। প্রায় আট বছর আগে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের সম্পর্ক চিরাচরিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক থেকে কৌশলগত সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত করে দেন। এবারের বেইজিং সফরে চীন এ সম্পর্ককে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ‘নিবিড় কৌশলগত অংশীদারত্বে’ রূপ দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে দু-দেশের মধ্যে। 

আট বছর আগে চীনের রাষ্ট্রপতির সফরে চীনের অঞ্চল ও পথের উদ্যোগে (বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভ) যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ। এবার চীনের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশ যুক্ত হবে। শুধু তাই নয়, দেশে পরিকল্পিত দক্ষিণাঞ্চলীয় সমন্বিত অবকাঠামো উদ্যোগে (সিডি) চীন সম্ভবত যুক্ত হবে- এমন একটি কথা শোনা যাচ্ছিল। এবার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। 

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি প্রচারিত হবে, সেখানে এই নতুন সম্পর্কের মাত্রা সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানতে পারব। কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর ঘিরে সরকার বেশ কয়েক বছর আগে উন্নয়ন অবকাঠামো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। জাপানের বঙ্গোপসাগরীয় শিল্পাঞ্চল প্রবৃদ্ধি বলয়ে (দ্য বিগ বি ইনিশিয়েটিভ) যুক্ত হয়ে সরকার সমন্বিতভাবে এই উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় সরকার পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ (সিডি) নিচ্ছে। 

বাংলাদেশ চাইছে সিডি বাস্তবায়নে অংশীদার হোক চীন। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে বেইজিংয়ের রাজনৈতিক মহলসহ নানা স্তরে বাংলাদেশের প্রত্যাশার বিষয়টি জানানো হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন হয়েছে। ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর গুরুত্বপূর্ণ একাধিক কারণে। এই সফরে নতুন প্রকল্পে অর্থায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশের বাজেট-ঘাটতি পূরণে আর্থিক সহায়তার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, চীনের এক্সিম ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছে। অর্থাৎ বাণিজ্যিক কূটনীতির বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের সময় দুই দেশের সহযোগিতা ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত হয়। তখন চীনের বিআরআই নিয়ে সমঝোতা স্মারক সই ছাড়াও বাংলাদেশের বেশ কিছু বৃহদায়তন উন্নয়ন অবকাঠামো প্রকল্পে চীনের ঋণ ও অর্থায়নের সিদ্ধান্ত হয়। বিআরআইয়ের অন্যতম প্রকল্প হিসেবে পদ্মা রেল সেতু নির্মাণে ঋণ দিয়েছে চীন। সাধারণত এ ধরনের শীর্ষ বৈঠকে স্বাগতিক দেশের পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিসহ সংশ্লিষ্ট নানা সরকারি দলিলের খসড়া তৈরি করে স্বাগতিক দেশ। 

প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগী চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)। সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে এই বার্তাই দিয়ে গেছেন সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাও। আগামী বছর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হবে। ওই উদযাপন ঘিরে দুই দেশের সমাজের নানা স্তরে যোগাযোগ বাড়াতে বিশেষভাবে জোর দিচ্ছে চীন।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশেষ করে এবার শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগে (সিডি) চীনের অংশীদারত্ব কিংবা সহযোগিতার বিষয়টি সরকার সামনে এনেছে। গত ৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। এরপর ৩ জুন বেইজিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন চীনের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সচিব) সুন ওয়েডং। 

সর্বশেষ ২৪ জুন ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাও দেখা করেন। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওই তিন আলোচনায় সিডিতে চীনের সহযোগিতা নিয়ে আগ্রহের কথা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে বাংলাদেশ। চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সৌজন্য সাক্ষাতের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সহযোগিতার ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকারের বিষয়ে পরামর্শ চান। তখন শেখ হাসিনা তাকে পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় চীনের বিনিয়োগের কথা জানান। ওই বৈঠকের এক সপ্তাহ পর সরেজমিনে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে চীনা রাষ্ট্রদূত পায়রা সমুদ্রবন্দর ও এর আশপাশের এলাকা পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের আগে সিপিসির মন্ত্রী লিউ জিয়ানছাওয়ের ঢাকা সফরটি তাৎপর্যপূর্ণ অবশ্যই।

রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশার বিষয়গুলো তিনি সরাসরি বোঝার চেষ্টা করেছেন। লিউ জিয়ানছাওয়ের সঙ্গে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে সরকারের সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনার বিষয়টি তুলে ধরেন, এমনটিও সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ঘিরে আঞ্চলিক সংযুক্তির কেন্দ্র গড়ে তুলতে সরকার মনোযোগ দিচ্ছে। একইভাবে সরকার পায়রা সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্রে রেখে দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগের কাজটা করবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এটি মূলত ওই অঞ্চলের ভবিষ্যতের উন্নয়নের রূপরেখা। 

বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাদের কাঙ্ক্ষিত প্রকল্পের প্রস্তাব ইআরডির কাছে জমা দেবে। এরপর সব ক’টি সমন্বয় করে তার তালিকা করা হবে। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অনন্য উচ্চতায় রয়েছে। এই সম্পর্কের পরিধি-পরিসর আরও বিস্তৃত হবে এই প্রত্যাশা অমূলক নয়। বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কৌশলী কূটনৈতিক সূত্র ধরে বাংলাদেশ যেভাবে বৈশ্বিক সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নির্ণয় করছে তাতে দূরদর্শীতার ছাপ স্পষ্ট।

আরেকটি বিষয় বিবেচনা করা দরকার। বিআরআই হচ্ছে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি চীনের একটি উদ্যোগ, যা এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার মধ্যে সহযোগিতা ও সংযোগ ঘনিষ্ঠ করেছে। এটি এমন একটি ধারণা, যেখানে অসংখ্য বড় ও ক্ষুদ্র প্রকল্পের সমন্বিত চিন্তাভাবনা সামনে চলে আসে। এর অনেকগুলো ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত বা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে আছে। 

আরও অসংখ্য নতুন প্রকল্প আগামীতে গ্রহণ করা হবে। এই ধারণাটি চীনের জন্য নতুন বা বিশেষ কিছু নয়। তাদের ভবিষ্যতের ভাবনা ও দৃশ্যকল্পের ধারাবাহিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে মিলে যায়। বাংলাদেশ চারদিকে ভারত ঘেরা। তাই ভারত ও মিয়ানমার উভয়েরই বিআরআইতে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের বিআরআই থেকে সর্বাধিক সুবিধা পাওয়ার পূর্বশর্ত। এ ছাড়া অনুন্নত অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি, রপ্তানিযোগ্য পণ্যের অভাব, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির অভাব, দক্ষ জনশক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন, পরিবেশগত অবনতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ, ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর অবস্থান এবং মিয়ানমারের সঙ্গে টানাপড়েন সম্পর্ক। এসব কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিআরআইতে কার্যকরী অংশগ্রহণ বাংলাদেশের জন্য অনেক সুবিধা এনে দিতে পারে।

বিশ্বে এমন কোনো উদ্যোগ নেই, যা চ্যালেঞ্জ বা বাধার সম্মুখীন হয়নি। বিআরআইও এর ব্যতিক্রম নয়। ওপরে উল্লিখিত বিআরআইয়ের চ্যালেঞ্জগুলোর বর্ণনা থেকেই প্রাসঙ্গিক প্রতিকারের ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এমন বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত, যা অংশগ্রহণকারীদের কাছে বিশেষ আবেদন রাখবে। অংশগ্রহণকারীদের চাহিদা এবং আগ্রহের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত