বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতামাথায় অবস্থিত প্রধান ডাকঘরে ঈদের পরদিন রাতে অফিস সহায়ক প্রশান্ত হত্যাকাণ্ড এবং ভল্ট ভেঙ্গে আট লক্ষাধিক টাকা লুটের ঘটনায় মূলহোতাকে গ্রেফতার করেছে বগুড়া জেলা পুলিশ। বুধবার দিনব্যাপী অভিযান চালিয়ে নওগাঁর সাপাহারের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃত আসামীর নাম শফিকুল ইসলাম (৪০)। তিনি সাপাহারের পশ্চিম করমডাঙ্গা এলাকার মৃত আব্দুস সালামের ছেলে। এ সময় তার কাছ থেকে ছয়টি মোবাইল ফোন এবং ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত শার্ট, প্যান্ট, জুতা ও ব্রেসলেট উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী। পুলিশ সুপার জানান, গ্রেফতারকৃত আসামী শফিকুল ইসলাম এর বিরুদ্ধে নওগাঁ, ঢাকাসহ বিভিন্ন থানায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ ৯টি মামলা রয়েছে।
গত (২৪ এপ্রিল) মধ্যরাতে নাইট গার্ডের দায়িত্ব পালনকালে খুন হন অফিস সহায়ক প্রশান্ত কুমার আচার্য্য। নিহত প্রশান্ত শাজাহানপুর উপজেলার বেজোড়া হিন্দুপাড়া এলাকার প্রাণকৃষ্ণ আচার্য্যের ছেলে।
পুলিশ সুপার বলেন, গত ১২ মার্চ মোটরসাইকেলযোগে নওগাঁ থেকে বগুড়ায় আসে শফিকুল ইসলাম। আসার পর সে তার মোটরসাইকেল বগুড়া জেলা ডাকঘরে পার্কিং করতে যায়। লোকজন পোস্ট অফিস থেকে টাকা তুলে বের হচ্ছে এমন দৃশ্য দেখে তার মাথায় পোস্ট অফিসের ভল্ট ভেঙ্গে টাকা লুন্ঠন করার পরিকল্পনা করে। তিনি তখন পোস্ট অফিসের ভিতরে যায় এবং ভল্ট রুম, সিসি ক্যামেরার অবস্থানসহ বিভিন্ন স্থান পর্যবেক্ষণ করে। পরে ১৫ মার্চ আবারো বগুড়ায় এসে শফিকুল ইসলাম নিউমার্কেট থেকে হ্যান্ড গ্লাভস, ট্রাউজার, গেঞ্জি এবং থানার পিছন থেকে বাবু মেশিনারিজ থেকে গ্রিল/ভোল্ট কাটার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং এসএস পাইপের একটি খণ্ড কেনে। পরে টাকা কম পরে যাওয়ায় ওইদিন তিনমাথায় ইসলামি ব্যাংকের বুথ থেকে ১৫ হাজার টাকা উত্তোলন করে এবং ডাকাতির জন্য কেনা মালামাল নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শফিকুল ২০ এপ্রিল আবারো বগুড়ায় আসে। সারারাত ঘুরে ওইদিন মধ্যরাতে পোস্ট অফিসের ওয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে এক কোনায় অপেক্ষা করতে থাকে। পরেরদিন সকালে পোস্ট অফিসের গার্ড বাথরুমে গেলে শফিকুল তার যন্ত্রপাতির ব্যাগ নিয়ে ভিতরে ঢোকে এবং সিঁড়ি ঘরে লুকিয়ে থাকে। এরপর দুপুর সোয়া একটার দিকে গার্ড হাতমুখ ধুতে গেলে সে ভল্ট রুমের দিকে যায় এবং জানালার গ্রিল ভেঙ্গে ভল্ট রুমে প্রবেশ করে। ভল্ট রুমে প্রবেশ করে ভল্ট রুমের সিসি টিভি ক্যামেরার লাইন কেটে দেয় এবং ভল্ট কাটে কিন্তু টাকার বাক্স দুরে থাকায় টাকা নিতে পারে না। পরে সবকিছু ওইখানে রেখে সন্ধ্যার দিকে মূলগেট টপকে বাইরে বের হয়ে তার নওগাঁর ভাড়া বাসায় চলে যায়।
একদিন নওগাঁর ভাড়া বাসায় অবস্থান করে রাতে মোটরসাইকেল নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যায়। পরের দিন ঈদের নামাজ পড়ে বাড়িতেই অবস্থান করে। ঈদের পরের দিন বিকালে তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে নওগাঁর ভাড়া বাসায় আসে সেখানে মোটরসাইকেল গ্যারেজে রেখে বাস যোগে ৯টার দিকে বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা করে এসে চারমাথায় নামে। চারমাথা থেকে সিএনজি নিয়ে সাতমাথা আসে। সাতমাথা নেমে মধ্যরাত পর্যন্ত পোস্ট অফিসের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। রাত দুইটার দিকে শফিকুল চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে ওয়াল টপকে পোষ্ট অফিসের ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু কেঁচিগেট লাগানো থাকায় পোস্ট অফিসের বারান্দার গ্রিলের দুইটা পাতি রেঞ্জ দিয়ে ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে।
সেখানে কর্তব্যরত গার্ড জেগে থাকায় শফিকুল কার্টুন ও বস্তার আড়ালে ঘন্টাখানিক অপেক্ষা করে। এক সময় সতর্কতার সাথে সিসি টিভি ক্যামেরা ঘুরিয়ে দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে সোজা ভল্ট রুমে চলে যায়। ভল্ট রুমের টাকার বাক্স কাছে নিয়ে আসার কিছু না থাকায় সে অন্য ২/৩ টা রুমের তালা কেটে ভেতর থেকে একটি লম্বা রড নিয়ে আসে। রুমের তালা কাটার শব্দে কর্তব্যরত গার্ড প্রশান্ত জেগে যায় এবং প্রশান্তের সাথে তার ধস্তাধস্তি হয়। তার কাছে থাকা এসএস পাইপ দিয়ে প্রশান্তের মাথায় আঘাত করে ও গলা চেপে ধরে থাকে এতে ঘটনাস্থলেই প্রশান্ত মারা যায়। শফিকুল পুনরায় ভল্ট রুমে গিয়ে ওই রড দিয়ে ভল্ট রুমে থাকা র্যাকটি কাছে নিয়ে এসে আট লাখ তার কাছে থাকা ব্যাগে তুলে নেয়। পরে সকাল সাতটার দিকে শফিকুল নিহত গার্ডের পকেটে থাকা কেঁচিগেটের চাবি বের করে নিয়ে ভিতরের গেট এবং মূল গেটের তালা খুলে বাইরে বের হয়ে বাইরে থেকে মূল গেট তালা দিয়ে দেয়। পরবর্তীতে সে সাতমাথা জিরো পয়েন্ট থেকে অটোরিক্সা ধরে চারমাথা যায়। পরে চারমাথা হতে বাস যোগে নওগাঁ চলে যায়।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, নওগাঁ গিয়ে সদর উপজেলার অবস্থিত জলিল মার্কেটের মার্কেন্টাইল ব্যাংকে তার একাউন্টে দুই লাখ এবং ডাচ্ বাংলা ব্যাংকে তার একাউন্টে তিন লাখ ৭৬ হাজার টাকা জমা রেখে নওগাঁর ভাড়া বাসায় যায়। পরে সেখানকার গ্যারেজ থেকে তার মোটরসাইকেল নিয়ে গ্রামের বাড়ি সাপাহারে চলে যায়।
পুলিশ সুপার সুদীপ বলেন, গ্রেপ্তারকৃত আসামি একজন পেশাদার চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী। তিনি এর আগে ২০১৯ সালে ডিএমপি বনানী থানা এলাকায় জনতা ব্যাংকের ভল্ট কেটে টাকা লুন্ঠন করার সময় ধরা পড়েছিল। তাছাড়া তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন থানা এলাকায় দোকানঘরে চুরি, বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি, ছিনতাইসহ পার্শ্ববর্তীদেশ ভারতেও ডাকাতি ও ছিনতাই কার্যক্রম চালিয়ে জেল খেটেছে বলে স্বীকার করেছে। তিনি আর বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া আসামিকে আদালতে পাঠানো হবে। এ ঘটনায় আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তা আরও তদন্ত করা হবে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(প্রশাসন) স্নিগ্ধ আখতার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(ট্রাফিক) হেলেনা আকতার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(সদর সার্কেল) শরাফত ইসলাম, সদর থানার ওসি নূরে আলম সিদ্দিকী, ডিবির ওসি সাইহান ওলিউল্লাহ, শাজাহানপুর থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানীসহ অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
-বাবু/এ.এস