ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসন। প্রবীণ রাজনীতিবিদ এডভোকেট মো. মোসলেম উদ্দিন ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ছিলেন নির্বাচিত গণ পরিবষদ সদস্য।
স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হয়ে পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হন নৌকা প্রতীক নিয়ে। এবারও তিনি ভোটের মাঠে লড়ছেন নৌকা নিয়ে। এবার তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন নিজের মেয়ে সেলিমা বেগম সালমা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বাবা নৌকা প্রতীক ও মেয়ে ঈগল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় এলাকা ছাপিয়ে বিষয়টি এখন জেলা জুড়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়েছে। বাবা-মেয়ে ভোটযুদ্ধে থাকায় দলীয় নেতাকর্মীরা চরম বিপাকের মধ্যে রয়েছেন।
এছাড়াও এ আসনে সদ্য পদত্যাগী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. আব্দুল মালেক সরকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাক প্রতীক নিয়ে, জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফিজুর রহমান বাবুল লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রওশন এরশাদপন্থি জাতীয় পার্টি নেতা ডা. খন্দকার রফিকুল ইসলাম (ডা. কেআর ইসলাম) কেটলী প্রতীক নিয়ে, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রিন্সিপাল আব্দুর রশিদ গামছা নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর সব প্রার্থীই পুরোদমে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এ আসন থেকে এবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. আব্দুল মালেক সরকার উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে ট্রাক প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন অংশ নিয়েছেন।
জানা গেছে এই আসনের বর্তমান সংসস সদস্য এবং নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী প্রবীণ রাজনীতিবিদ মো. মোসলেম উদ্দিন নৌকা প্রতীক নিয়ে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এবার তিনি, তার ছেলে এবং মেয়েসহ একই পরিবার থেকে তিনজন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চান। শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পান পিতা মোসলেম উদ্দিন। ছেলে বাবার পক্ষে অবস্থান নিলেও কন্যা সেলিমা বেগম সালমা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। সেলিমা বেগম সালমা নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামছুন নাহার হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এর আগে সংসদ নির্বাচনের সময় প্রবাস থেকে এসে তার বাবার পক্ষেই নির্বাচনি প্রচার চালিয়েছেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবার লক্ষে গত প্রায় দেড় বছর তিনি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়েছেন। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। যাচাই-বাছাইয়ে তিনি বাদ পড়লেও নির্বাচন কমিশনে আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।
উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, একটি পৌরসভাসহ ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) সংসদীয় আসন। এ আসনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয় প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মোট ভোটার রয়েছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৫ জন। পুরুষ ভোটার এক লাখ ৯৪ হাজার ৪৪২ ও মহিলা ভোটার এক লাখ ৯১ হাজার ৫৪৩ জন। এর মধ্যে দুই জন হিজড়া ভোটার রয়েছেন। ভোটকেন্দ্র ১২১টি ও ভোট কক্ষ রয়েছে ৮৫৭টি।
আওয়ামী লীগ নেত্রী সেলিমা বেগম ভোটারদের আকৃষ্ট করতে তার কর্মী সমর্থকদের নিয়ে মাঠে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। দলীয় নেতাকর্মী ও ভোটারদের তার ভাগে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। দুর্নীতিমুক্ত উপজেলা গড়াসহ নানা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ভোটারদের।
বাবার সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রসঙ্গে সেলিমা বেগম জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে এলাকার সাধারণ মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এবার আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নের জন্য আবেদন করেছিলেন। এলাকার উন্নয়নের লক্ষে তিনি এবার দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তবে এ নিয়ে বাবার সঙ্গে তার কোনও সমস্যা হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
এডভোকট মোসলেম উদ্দিন এমপি তার নিজস্ব বলয়ের নেতাকর্মীদের নিয়ে পৌরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডে নিজ বাসায় বসে নির্বাচনি কার্যকলাপ পরিচালনা করছেন। অজ্ঞাত কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাকর্মীদের তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগেও তিনি সাত বার নির্বাচনে অংশ নিয়ে পাঁচবার নির্বাচিত হয়েছেন। ৮৫ বছর বয়সে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এসে নিজের কন্যাসহ আওয়ামীলীগের (বিদ্রোহী) স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে।
আওয়াম লীগের দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মোসলেম উদ্দিন দলীয় ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে অনেকটা বেকায়দার পড়েছেন। তিনি টানা প্রায় ৪৫ বছর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদটি তার হাতছাড়া হয়ে যায়। সভাপতি হন তার ছেলে এডভোকেট এমদাদুল হক সেলিম।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. আব্দুল মালেক সরকার, এমপির পারিবারিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগের একাংশ নেতাকর্মীদের নিয়ে ভোটের মাঠে দৌড়াচ্ছেন। অপরদিকে নৌকার পক্ষে আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ এখনও অনেকটাই নিষ্ক্রিয় রয়েছেন।
স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অনেকেই নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, বাবা-মেয়ের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় বেকায়দার মধ্যে রয়েছে দলীয় নেতাকর্মীরা। উপজেলা জুড়েই এ আলোচনা চলছে, ভোট চাইতে গিয়ে ভোটারদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ ছাড়াও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আ. মালেক সরকার স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন।
আব্দুল মালেক সরকার বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সারা দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও ফুলবাড়ীয় দৃশ্যমান কোনও উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য। তিনি দলীয় ও পারিবারিক কোন্দলে জর্জরিত। তার কাছে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা সবসময় অবমূল্যায়িত হয়েছে, যে কারণেই তাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হয়েছে।
এডভোকেট মোসলেম উদ্দিনের ছেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইমদাদুল হক সেলিম বলেন, নির্বাচনে সবারই অধিকার আছে অংশ নেওয়ার। তবে যার জনপ্রিয়তা বেশি সেই নির্বাচনে জয়লাভ করবে। দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার সুযোগ এবার আওয়ামী লীগই করে দিয়েছে।
তবে এসব ব্যাপারে নৌকার প্রার্থী এডভোকেট মোসলেম উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।