প্রায় দেড় মাস ধরে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। ক্ষমতায় আসার পরপরই বিচার বিভাগীয় ক্যু, আনসার বিদ্রোহ ইত্যাদি তাদের সামাল দিতে হয়েছে। এখনও তাদের জননিরাপত্তায় বিশেষ মনোযোগ রাখতে হচ্ছে। আমরা দেখছি, অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বড় ধরনের রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা তাদের মোকাবিলা করতে হয়নি।
যে প্রেক্ষাপটে এ সরকার দায়িত্ব নিয়েছে তা পুঁজি করে কোনো রাজনৈতিক পক্ষ এ সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্নও তোলেনি। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে চেয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক মহলে এক ধরনের একাত্মতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, যা দীর্ঘদিন দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক পক্ষগুলো কি কূটরাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে? অবশ্যই না। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও ভোটব্যাংক বাড়ানোর রাজনীতির দিকে। অর্থাৎ সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পথ এখনও সুগম হয়নি।
বিষয়টি আমাদের জন্য যে ইতিবাচক না-ও হতে পারে তা অনেকের কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। সংবাদমাধ্যমে এখনও বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, ভাঙচুরের খবর পাওয়া যাচ্ছে। অধিকাংশ হামলা ও ভাঙচুরের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে তা অনেকটাই স্পষ্ট। অর্থাৎ রাজনীতি বলতে সেই ত্রাস সঞ্চারকেই অবলম্বন করছে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল। অথচ এ সময় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের গুছিয়ে সাংগঠনিক ও মতাদর্শিক তত্ত্ব আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে পারতো।
দেড় মাস খুব দীর্ঘ সময় নয়। তবে সরকারের নীতি, লক্ষ্য, কার্যপ্রণালি ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশের জন্য দেড় মাস নিতান্ত কম সময়ও নয়। সাধারণত যেকোনো সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে প্রথম কিছুদিনের মধ্যেই সরকারের নীতিগত অবস্থান কোনো না কোনোভাবে স্পষ্ট হয়। কিন্তু এবার অন্তর্বর্তী সরকার যে প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব নিয়েছে তা একেবারেই ভিন্ন। তাই দীর্ঘমেয়াদি কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে তাদের সময় দেওয়া জরুরি।
একই সঙ্গে সরকারকে কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক সহায়তাও দেওয়া প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের রাজনীতির সমন্বয় করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাবতে হবে। ভোটব্যাংকের রাজনীতি নয় বরং সংস্কারমুখী ও জনগণের কল্যাণমুখী রাজনীতির কথা ভাবতে হবে। আধিপত্য বিস্তার কিংবা দলীয় কোন্দল-পুরানো বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
প্রত্যক্ষভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমালোচনা-পরামর্শ এমনকি অনেক সময় বিভিন্ন দাবির বিষয়ে রাজনৈতিক অবস্থান পোক্ত করার মাধ্যমেও সহায়তা করতে হবে। সহায়তা মানে শুধু সময় দেওয়া নয়, বরং প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট স্বচ্ছ করার বিষয়ে দাবি উত্থাপনকে গুরুত্ব দিতে হবে।
সরকার একটি কাঠামো এবং রাজনীতির সংজ্ঞা-সূত্র নিশ্চয়ই মানবিক। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এখনও এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেনি। বরং তারা উল্টোরথে যাত্রা করছে। অন্তর্র্বতী সরকারের নীতি স্পষ্ট। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার এবং স্বচ্ছ, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ইতোমধ্যে তারা কয়েকটি সংস্কার কমিশনও গঠনে করেছে। যদিও রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিগত স্থানে বড় পরিবর্তন আনা তাদের পক্ষে সম্ভব নয় যেহেতু তারা অন্তর্র্বতী সময়ের দায়িত্বে রয়েছে কিন্তু সংস্কার করতে হবে তাদেরই। রাজনৈতিক পক্ষকে এখন আগে সংস্কারের পথে যেতে হবে। দীর্ঘদিন যে রাজনৈতিক পরিবেশে তারা নিজেরাও সংঘাতময় কৌশলে এগিয়েছে সে পথে যাওয়া যাবে না। বরং এ মুহূর্তে জনগুরুত্বপূর্ণ দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা তুলতে হবে এবং প্রয়োজনে সেই নিরিখে কার্যক্রম চালাতে হবে।
এ সরকার অন্তর্বর্তী সরকার হলেও রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তাদের রয়েছে। আমরা দেখছি, জননিরাপত্তা এখনও পরিপূর্ণভাবে দেশে নিশ্চিত করা যায়নি। তবে এর পেছনে নানা কারণও বিদ্যমান তা অনেকের অভিমত। আমাদের পাশের দেশ ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো ইতোমধ্যে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা এমনভাবে উপস্থাপন করছে যেন দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা চাড়া দিচ্ছে। ড. ইউনূস আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব হলেও বৈশ্বিক পর্যায়ে একটি দেশের ভাবমূর্তি রক্ষা করা তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলো দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং নিরাপত্তা নিয়েই শঙ্কিত।
এ শঙ্কার প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে। এমনকি রাজনৈতিক একটি পক্ষ অর্থনৈতিক অঞ্চলেও ইন্ধন জোগাচ্ছে এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ১২ সেপ্টেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদন পোশাক শিল্পে অস্থিরতার সংবাদে অনেক চিত্র উঠে এসেছে। অর্থাৎ এখানেও কোনো একটি তৃতীয় পক্ষ নানা সংকট তৈরি করছে। এর পরোক্ষ প্রভাব আমরা সচরাচর দেখতে পাচ্ছি না। মালিক ও বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যকার সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে।
৫ আগস্টের পর শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে দেশে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি বন্ধে তদারকি করেছে। এ কাজ এখনও অনেক স্থানে তাদের চালিয়ে যেতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পক্ষে এসব দায়িত্ব পালন করা কঠিন। বিশেষত তাদের শিক্ষাজীবনে এমনটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে।
জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ বাহিনীকে সক্রিয় করা জরুরি। আমরা জানি, বিদায়ি সরকারের সময় পুলিশ বাহিনীকে বিতর্কিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে পুলিশ বাহিনীর প্রতি জনআস্থা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু ওই সরকারের পদত্যাগের পর পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে এবং বাহিনীতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে ইতোমধ্যে। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার ও জেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকর করা গেলেও মাঠ পর্যায়ে পুলিশকে পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি।
পুলিশের অনেক কর্মকর্তাই সংস্কারের বিষয়টিতে একমত পোষণ করছেন। কারণ মাঠ পর্যায়ে আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা না থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা কঠিন। পুলিশ একটি স্বতন্ত্র বাহিনী এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পুলিশকে সক্রিয় করার বিকল্প নেই। তাদের হৃত আস্থাও ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা দেখছি, গণপিটুনি বা মব জাস্টিসের প্রবণতা বেড়েছে। আমরা সংস্কার চাই কিন্তু মব জাস্টিস চাই না। অতিউৎসাহী হয়ে কতিপয় মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। এর ফল ভালো হতে পারে না।
বিশেষত অনেক অপরাধী চক্র তাদের অপপ্রক্রিয়া চালু রেখেছে বলেও সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশকে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা পুরোপুরি দিতে না পারলে তাদের পক্ষে মামলা সাজানোও কঠিন হয়ে পড়বে। তবে পুলিশ যেন আইনের অপপ্রয়োগ করতে না পারে কিংবা আইনের ব্যত্যয় না ঘটায় তা নিশ্চিত করতে হবে।
জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কেন এখনও সুসংগঠিত করা গেল না, এ প্রশ্নও ইতোমধ্যে নানা মহলে দেখা গেছে। সরকার পরিচালনা এবং আইন বিভাগের কার্যকারিতার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শক্তিশালী করার গুরুত্ব অন্তর্র্বতী সরকারকে বিশেষভাবে দেওয়া দরকার।
অন্তর্র্বতী সরকারের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ স্বাস্থ্যখাত। এখনও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত-নিহতের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে কার্যক্রম চলমান। কিন্তু কীভাবে তালিকা হচ্ছে তা সম্পর্কে আমরা জানি না। এমনকি যারা এখন আহত রয়েছেন তাদের চিকিৎসার বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনাও নেই। আহতের সার্জারির খরচ না লাগলেও দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য কিছু চিকিৎসা সামগ্রী কেনার প্রয়োজন পড়ছে। সেগুলো হাসপাতাল সরবরাহ করতে না পারলে কিনতে হবে।
আহতদের অনেকেই নিম্নবিত্ত কিন্তু তাদের সহযোগিতা করার বিষয়ে নির্দিষ্ট ফান্ড কিংবা বিশেষায়িত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হলেও খরচ বা চিকিৎসার পুরো বিবরণ স্পষ্ট নয়। এ বিষয়টিতে বিশেষ মনোযোগ পাওয়া জরুরি। কারণ সামান্য একটু দেরির কারণে অনেকেই আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করতে বাধ্য হবে। স্বাস্থ্য খাতে এ সময় ডেঙ্গুও একটি বড় সমস্যা আকারে দেখা দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা খাতে বাড়তি মনোযোগ প্রয়োজন।
জননিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষত পুলিশকে মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। আর স্বাস্থ্য খাতে আহতদের দ্রুত কার্যকর চিকিৎসা এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ করতে হবে। সংস্কারের পাশাপাশি এসব বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দরকার। তবে সবার আগে জননিরাপত্তা। এ ব্যাপারে কোনোভাবেই কালক্ষেপণের কোনো অবকাশ নেই। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে সরকারের সামনে যেমন বাড়তি সমস্যা দেখা দেবে তেমনি মানুষও আরও বড় সংকটে পড়বে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়