বুধবার ২ জুলাই ২০২৫ ১৮ আষাঢ় ১৪৩২
বুধবার ২ জুলাই ২০২৫
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের অস্ত্র ও লাইসেন্স নিয়ে বিতর্ক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০২৫, ৯:২৫ PM
সরকারি ওয়েবসাইটে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার প্রোফাইলে তার জন্ম তারিখ ১৯৯৯ সালের ১৪ জুলাই। সেই হিসাবে আজ (১ জুলাই) তার বয়স হয় ২৫ বছর ১০ মাস ১৭ দিন। ২০১৬ সালের নীতিমালা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ব্যক্তি পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেতে সর্বনিম্ন বয়স হতে হয় ৩০ বছর। আয়করের বাধ্যবাধকতাও আছে।

তবে আইনে এর ব্যতিক্রমের সুযোগও আছে। স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সমপদমর্যাদারসহ ৯ ধরনের ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই বয়স শিথিলযোগ্য। তাদের ক্ষেত্রে আয়করের বাধ্যবাধকতাও নেই।

রবিবার বিমানবন্দরে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ব্যাগে গুলির ম্যাগাজিন পাওয়ার পর তিনি জানান, তার লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র আছে। তাই প্রশ্ন উঠেছে তিনি কোন বিবেচনায় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন? সোমবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন তিনি তা জানেন না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি।

ম্যাগাজিন থেকে শুরু
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২৯ জুন সকালে যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়ার ব্যাগ থেকে গুলির ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে দিনভর আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। একটি সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে তখন খবর প্রকাশ করেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা সরিয়ে ফেলে।

রবিবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে এক পোস্টে ব্যাগে ম্যাগাজিন পাওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। তিনি সেখানে বলেন, “নিরাপত্তার স্বার্থে আমার লাইসেন্স করা বৈধ অস্ত্র আছে। গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বের ওপরে কয়েক দফায় যেভাবে হত্যাচেষ্টা চালানো হয়েছে, তাতে অস্ত্র রাখাটাই স্বাভাবিক। যখন সরকারি প্রোটোকল বা সিকিউরিটি থাকে না, তখন নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের উদ্দেশ্যে লাইসেন্সড অস্ত্র রাখা।”

তিনি আরও লিখেছেন, “মরক্কোর মারাকেশে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি ইয়ুথ ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য আজ (রবিবার) ভোর ৬টা ৫০ মিনিটে ফ্লাইট ছিল। ভোরে প্যাকিং করার সময় অস্ত্রসহ একটা ম্যাগাজিন রেখে এলেও ভুলবশত আরেকটি ম্যাগাজিন ব্যাগেই থেকে যায়, যেটা স্ক্যানে আসার পর আমার প্রোটোকল অফিসারের কাছে হস্তান্তর করে আসি। বিষয়টি সম্পূর্ণ আনইন্টেনশনাল। শুধু ম্যাগাজিন দিয়ে আমি কী করবো ভাই? ইন্টেনশন থাকলে অবশ্যই অস্ত্র রেখে আসতাম না। এখানে অবৈধ কিছু না থাকলেও অনেকের জন্যই এটা আলোচনার খোরাক বটে।”

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওঠা চাপ দিয়ে নিউজ সরানোর অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবি করে উপদেষ্টা বলেন, “এই ঘটনার পর আমি টিমসহ টানা ১০ ঘণ্টা ফ্লাইটে ছিলাম। ট্রানজিটে নেমেও দীর্ঘক্ষণ পর অনলাইনে এসে দেখতে পাচ্ছি, এত কিছু ঘটেছে। নাগরিক হিসেবে আপনারও যদি নিরাপত্তা-ঝুঁকি থাকে, যথাযথ নিয়ম মেনে আপনিও অস্ত্রের লাইসেন্স করতে পারেন।”

আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার নিয়ম
আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬-এর ধারা ৩-এ ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির যোগ্যতা সম্পর্কে যা যা বলা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে-

১. বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে।

২. শারীরিক ও মানসিকভাবে সমর্থ ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়স সীমার মধ্যে হতে হবে।

৩. ব্যক্তিশ্রেণির করদাতা হতে হবে।

৪. পিস্তল, রিভলবার, রাইফেল-এর ক্ষেত্রে আবেদনের পূর্ববর্তী তিন বছর ধরে বছরে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা করে কর দিতে হবে। শটগানের ক্ষেত্রে কমপক্ষে এক লাখ টাকা।

এছাড়া প্রবাসী ও দ্বৈত নাগরিকের ক্ষেত্রে আরও কিছু শর্ত আছে। তবে নীতিমালার ৩২ ধরায় বিশেষ প্রাধিকার পাবেন এরকম ১০ ধরনের ব্যক্তিদের কথা বলা আছে। তাদের মধ্যে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সমপদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিরা রয়েছেন। আরও আছেন সংসদ সদস্য, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, “ক” শ্রেণির পৌরসভার চেয়ারম্যান, জেলা ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, বিচারপতি।

এছাড়া নির্ধারিত গ্রেডের সরকারি কর্মকর্তা, সামরিক কর্মকর্তা, জাতীয় দলের শ্যুটারসহ আরও কিছু বিশেষ ব্যক্তিও রয়েছেন সেই তালিকায়। এই ১০ ধরনের ব্যক্তির মধ্যে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সমপদমর্যাদারসহ ৯ ধরনের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৩০ বছর বয়সের বাধ্যবাধকতা নেই। তাদের ক্ষেত্রে আয়কর পরিশোধের বাধ্যবাধকতাও নেই।

এর বাইরে লংব্যারেল (শটগান) আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়স ২৫ বছর করা হয়েছে বলে জানান একজন জেলা প্রশাসক। এছাড়া রাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক ও আইসিটি অনুবিভাগ) খন্দকার মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, “বিশেষ ক্ষেত্রে ২৫ বছরেও আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার বিধান আছে।”

আসিফ মাহমুদের বিষয়ে প্রশ্ন
ব্যতিক্রমের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এখন কয়েকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, তার লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র আছে। এখন প্রশ্ন হলো-

১. তিনি কোন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন?

২. কোন সময়ে নিয়েছেন?

৩. বিমানবন্দরে যে ম্যাগাজিন ধরা পড়েছে, তা পুলিশ হেফাজতে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা না করেই কেন  তার প্রটোকল অফিসারকে দেওয়া হলো?

উড়োজাহাজে বৈধ অস্ত্র হ্যান্ড ব্যাগে বহনের নিয়ম নেই। তবে ঘোষণা দিয়ে বদ্ধ লাগেজ হিসাবে বহন করা  যায়। পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বলেন, “সাধারণ নিয়মে এই ধরনের ঘটনায় ম্যাগাজিনটি জব্দ করে বৈধতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মালিককে ফেরত দেওয়ার কথা। কিন্তু আসিফ মাহমুদ একজন উপদেষ্টা। আর আমার মনে হয় তিনি নিশ্চয়ই বৈধ কাগজপত্র দেখিয়েছেন। সেই কারণে তার প্রটোকল অফিসারের কাছে ম্যাগাজিনটি ফেরত দেওয়া হয়েছে।”

তবে ওই ম্যাগাজিন কোন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের সে বিষয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত নয়। তারা কাগজপত্র পরীক্ষা করেও দেখেননি। এই সব প্রশ্নের জবাব পেতে চায় তারা।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ বলেন, “আমরাও বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। ওই সময়ে ইমিগ্রশনে কারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা কী প্রক্রিয়ায় ফেরত দিয়েছেন- সব কিছু জানার চেষ্টা করছি।”

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স আসিফ মাহমুদের আগ্নেয়াস্ত্র সংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য প্রকাশের দাবি জানিয়ে বলেন, “তার এপিএস-এর দুর্নীতিসহ তিনি ইতোমধ্যে অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন। আমরা জানতে চাই, তিনি কীভাবে অস্ত্রের লাইসেন্স পেলেন? কোন যোগ্যতায় পেলেন? আর বিমানবন্দরে পুলিশের আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া তার প্রটোকল অফিসারকে কেন ম্যাগাজিন ফেরত দেওয়া হলো তারও ব্যাখ্যা দরকার।”

এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক ও আইসিটি অনুবিভাগ) খন্দকার মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, “উপদেষ্টা মহোদয় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন কি-না, নিয়ে থাকলে কখন, কীভাবে নিয়েছেন তা আমার জানা নেই।”

বাংলাদেশে ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ডিসি)। তবে এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। তারাই এসবি ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে যোগ্যতা যাচাই করেন। আর ব্যক্তি ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শর্ত মেনে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিতে পারে। ব্যক্তি পর্যায়ে বন্দুক, রাইফেল, শটগান, পিস্তল ও রিভলবারের লাইসেন্স দেওয়া হয়।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা যা বললেন
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সভাকক্ষে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন বৈধ লাইসেন্স পেতে বয়স কমপক্ষে ৩০ বছর হতে হয়, কিন্তু উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বয়স ৩০ হয়নি, তাহলে তিনি কীভাবে লাইসেন্স পেলেন? উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আমি যেহেতু ওই আইনটা দেখিনি, সেহেতু এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না।”

তবে তিনি জানান, “অনেকে বলছেন তিনি (উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ) একে ৪৭-এর লাইসেন্স পেয়েছেন। এটা একে-৪৭ নয়, এটা তারই একটি হাতিয়ার, তার একটি পিস্তলের খালি একটি ম্যাগাজিন ছিল। সেটি ভুলে রয়ে গিয়েছিল। এটা আসলে ভুলেই হয়েছে। অনেক সময় এমন হয় যে, আপনি একটা চশমা নিয়ে যাবেন, কিন্তু চশমা না নিয়ে মোবাইল নিয়ে রওনা হয়ে গেছেন। এটা জাস্ট একটা ভুল। উনি যদি আগে জানতে পারতেন, তাহলে কোনো অবস্থাতেই এটা নিতেন না।”

সূত্র: ডয়েচে ভেলে
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত