বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স দুই মাস। বলতে গেলে শিশু, হাঁটি হাঁটি পা পা। এরই মধ্যে সরকারের কর্মকাণ্ড মূল্যায়নে আমরা সবাই ব্যস্ত। টং থেকে টক শো, বকলম থেকে বৈজ্ঞানিক সবাই। এই সরকার কারো কাছে হাল, কারো কাছে কাল। মোটকথা, সরকারের শুরুর দিন থেকে প্রশংসা ও সমালোচনার কমতি নেই।
সাধারণত এই মূল্যায়ন শুরু হওয়ার কথা ১০০ দিন বা তিন মাস পর। এর কারণ অনেক সরকার বা প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব পেয়েই তিন মাসের কর্মসূচি ঘোষণা দেয় এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া প্রবাহিত হতে থাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ঘোষিত সেই কর্মসূচি ঘিরে।
তবে বর্তমান সময়ের ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এই ব্যাপারটি একটি বিশেষ দিক থেকেও দেখা যেতে পারে।
যেমন আমরা ধরে নিতে পারি, যেসব কারণে ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি গণ-অভ্যুত্থান ঘটার পর বিগত সরকারের পতন হয়েছে, অনেকের ধারণা, ‘আলাদিনের চেরাগ’ নিয়ে আসা অন্তর্র্বতীকালীন সরকার রাতারাতি সে সমস্ত দাবি পূরণ করতে সমর্থ হবে বা অবশ্যই করতে হবে। যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তিতে তারই আভাস মেলে। বলা বাহুল্য, এমন উচ্ছ্বাস থাকাতে দোষের তেমন কিছু নেই।
দুই.
তার পরও গত এক মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গৃহীত কিছু নীতিমালা, পদক্ষেপ, এমনকি হস্তক্ষেপ জনমনে ইতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। যেমন বেহাল ও ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি এবং অর্থ লুট বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি সন্তোষজনক হস্তক্ষেপ, সুদ ও বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, টাকা ছাপিয়ে ব্যাংক উদ্ধার না করার প্রতিশ্রুতি, মূল্যস্ফীতি রোধে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের ওপর করছাড়, সংস্কারের সুপারিশের জন্য ছয় কমিশন গঠন এবং সর্বোপরি সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত পরিবেশে অর্থ ও পুঁজি ব্যাজারকে কাজ করতে দেওয়ার অঙ্গীকার ইত্যাদি।
তবে এটিও ঠিক যে পাশাপাশি গত এক মাসে আইন-শৃঙ্খলা পরিবেশের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনো গতি পায়নি, বরং শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনা অহরহ, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কেউ প্রগলভ প্রচারণায় ব্যস্ত ইত্যাদি বিতর্ক উসকে দিচ্ছে। আবারও বলি, ঠিক এই মুহূর্তে সফলতা ও ব্যর্থতার এই হিসাব নেহাত ছেলেমানুষি। কেননা একটি সরকারের ঝেড়ে কাশতে গেলেও একটু সময় লাগার কথা।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা তবে হুটহাট ভালোমন্দ বিচারের এই ‘উন্মাদনার’ একটি ভালো দিক যে আছে, তা ভুললে চলবে না। এর অর্থ হলো দেশের নাগরিকরা খুব সচেতন, তারা ‘ওয়াচডগ’, পান থেকে চুন খসলে কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। জনগণ নিরপেক্ষভাবে ওয়াচডগ হিসেবে থাকলে যেকোনো সরকারের জন্যই মঙ্গল।
তিন.
সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর জনগণের ধারণা সম্পর্কিত একটি সমীক্ষা চালিয়েছে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এই প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত এমন এক সমীক্ষারও সন্ধান আছে। সুতরাং জানুয়ারি-আগস্ট মাসের মধ্যে একটি তুলনামূলক পর্যালোচনার অভিপ্রায় ছিল বলে মনে হয়।
জাতীয় পর্যায়ে টেলিফোনের মাধ্যমে দুই হাজার ৩৬৩ পুরুষ ও নারীর ওপর (পল্লীতে ৬৬ শতাংশ, নগরে ৩৩ শতাংশ) পরিচালিত এই সমীক্ষার শিরোনাম অর্থাৎ ‘নাড়ি সমীক্ষা’ দিয়ে জনমত যাচাই করা হয়েছে; সমীক্ষায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ সংক্রান্ত মানুষের ধারণার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
তবে গবেষণার ফলাফলে পরে আসছি, তার আগে বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিনের প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য দিয়ে শুরু করলে ভালো হয়, ‘একটি বিশ্বাসযোগ্য উপলব্ধ বিষয় সমীক্ষা (পারসেপশন সার্ভে) বিচার-বিবেচনার গণতন্ত্র প্রয়োগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিয়মিত পালস সার্ভে চালাব, যেন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের কৃতিত্ব সম্পর্কে মানুষ কী ভাবছে তার তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করতে পারি।’ যা হোক, সমীক্ষার কয়েকটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা যাক।
১. সমীক্ষার ফলাফল বলছে, চলমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতিপথ সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরদাতা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। তার পরের কথাটুকু বেশ হৃদয়গ্রাহী এবং প্রাসঙ্গিক—“যা হোক, বিগত অভ্যুত্থানগুলোতেও এমন ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ করেছি।
যেমন—একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি এবং পরিণামে আমরা আশাভঙ্গ প্রত্যক্ষ করেছি। নাগরিকরা সংস্কার চায়, কিন্তু আসল সংস্কার তখনই সম্ভব, যখন যদি আমরা মানসিকতা পরিবর্তন করি এবং ‘কখনোই আর না’, ‘কেউ আমাদের গণতন্ত্র কেড়ে নিতে পারবে না’, ‘জাতীয় মূল্যবোধ’ মনে গাঁথি।”
২. এ বছরের জুলাই-আগস্ট রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে উত্তরদাতাদের বেশির ভাগ (প্রায় তিন-চতুর্থাংশ) মনে করে বাংলাদেশ সঠিক রাস্তায় আছে; সঠিক নয় বলেছে উত্তরদাতাদের ১২ শতাংশ। অথচ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে চালানো সমীক্ষায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল মাত্র ৪৩ শতাংশ। গবেষকরা এই পার্থক্যের একটি নির্মোহ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন এই বলে যে রাজনৈতিক আশাবাদের উন্নীত অবস্থার কারণ অন্তর্র্বতী সরকারের কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশানির্ভর, এদের আমলে বাস করার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নয়।
৩. দেশ অর্থনৈতিকভাবে সঠিক বা বেঠিক রাস্তায় এগোচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে বেশির ভাগ বলেছে সঠিক ট্র্যাকে রয়েছে দেশ (৬১ শতাংশ), এক-চতুর্থাংশের আছে উল্টো মত। জানুয়ারির সমীক্ষায় হিসাবটি যথাক্রমে ছিল এক-তৃতীয়াংশ বনাম দুই-তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ সময়ের আবর্তনে আশাবাদীর অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে, হতাশাবাদীর হিস্যা হ্রাস পেয়েছে।
৪. পালস সার্ভেতে উঠে আসে উত্তরদাতাদের ৪০ শতাংশ মনে করে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা মূল্যবৃদ্ধি, ব্যবসায় মন্দা ইত্যাদি। এর বিপরীতে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রায় ৭০ শতাংশ বলেছিল এ কথা। আগস্টে সরকারের পতনের পর অপরাধ বেড়েছে কি না এমন প্রশ্নে তিন-চতুর্থাংশ মনে করেছে, না; এক-চতুর্থাংশের ধারণা অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫. কোটা সংস্কার থেকে রূপান্তরিত এক দফা দাবি সমর্থন করেছে এমনটি বলেছে উত্তরদাতাদের চার-পঞ্চমাংশ; ৩৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, সরকারের তিন বছর কিংবা তারও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা দরকার; অন্যদিকে এক-চতুর্থাংশ মনে করে, ছয় মাস কিংবা তারও কম; ১১ শতাংশ মনে করে, সর্বোচ্চ এক বছর এই সরকারের ক্ষমতায় থাকা উচিত। ‘যা হোক ৮১ শতাংশ উপলব্ধি করে যে একটি অবাধ ও মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সরকারের ক্ষমতায় থাকা উচিত।’
৬. দলীয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে ৮১ শতাংশ উত্তরদাতা এবং ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, ক্যাম্পাসে দলীয় শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা দরকার। এটি প্রমাণ করে, দলীয় রাজনীতির আবরণে শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসে যে দুর্নীতি, সহিংসতা ঘটায় তার প্রতি জনগণ বীতশ্রদ্ধ।
৭. বর্তমান সরকারের কাছে আপনার চাওয়া কী? নির্বাচনের আগে প্রথম চাওয়া অর্থনৈতিক সংস্কার, যেখানে অন্তর্ভুক্ত দাম কমানো, বাজার-বিধিনিষেধ, কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য আর্থিক সংস্কার (৩২ শতাংশ); ১৭ শতাংশ চায় রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংস্কার এবং ১২ শতাংশের চাওয়া আইনি সংস্কার—আইনের শাসন, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচারালয়ের স্বাধীনতা, পুলিশ সংস্কার ইত্যাদি।
৮. এ পর্যন্ত সংস্কারমুখী প্রচেষ্টায় অন্তর্র্বতী সরকারকে গড়ে ১০০-এর মধ্যে ৭৫ নম্বর দিতে প্রস্তুত উত্তরদাতা। মোটকথা, মেজাজে এখন আশার আলোর প্রাধান্য। উত্তরদাতাদের ৫৩ শতাংশ মনে করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে সুবাতাস সমাসন্ন; অবশ্য না বললেই নয় যে এদের মধ্যে ১৩ শতাংশ হতাশায় হাবুডুবু খাচ্ছে। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, অনেক দিন পর একনায়কসুলভ সরকারের পতন-পরবর্তী রাজনৈতিক আবহাওয়া নাগরিকদের মধ্যে একটি ভালো ভবিষ্যতের আশা সঞ্চার করেছে।
সমীক্ষাটির একটি বিশেষ গুরুত্বের কথা না বললেই নয়। আগামী ছয় মাস পর মানুষের মতামতসহ যখন অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে চাওয়া-পাওয়া, বিভিন্ন সংস্কাররের অগ্রগতি, মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি এবং সার্বিক কৃতিত্বের একটি তুলনামূলক চিত্র তৈরি হবে, তখন সেটি সরকারের জন্য যেমন মঙ্গলকর, তেমনি হবে জনগণের কাছে। সুতরাং এই সমীক্ষাকে সরকারের প্রতি সমর্থন হিসেবে না দেখে যদি ‘আয়নায় মুখ দেখা’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে ভালো হবে।
তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং বিশেষত সমন্বয়কদের বা তরুণ নেতৃত্ব সম্পর্কে দু-একটি প্রশ্ন থাকলে ভালো হতো। সরকারের এই নতুন ‘মডেল’—যেখানে ২১ জনের মধ্যে তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত, এটি নিয়ে জনমনে প্রতিক্রিয়া জানালে ভালো হতো কিংবা সর্বক্ষেত্রে ছাত্রদের হস্তক্ষেপ নিয়ে অনুভূতি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারত বলে অন্তত আমদের ধারণা।
বস্তুত এমন পিরিয়ডিক সমীক্ষার জন্য আয়োজক বিআইজিডি ধন্যবাদ পেতেই পারে। আমাদের দেশের গবেষণাপ্রতিষ্ঠাগুলো সংবাদপত্রের মতো ওয়াচডগ হিসেবে কাজ করবে বলে সবার কামনা। ‘এত কালের ভয়-ভাবনা কোথায় যে যায় সরে, ভালোমন্দে ভাঙাচোরা আলোয় ওঠে ভরে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়