আজ প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও বাংলা শিক্ষা বেশ সীমিত হয়ে পড়েছে। গত শতক পর্যন্ত বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ে বাংলা ছিল শিক্ষার প্রধান মাধ্যম। ২০০৩ থেকে ইংরেজি ভার্সন বলে একটি ধারা চালু হলে সেখানে বাংলা শুধু একটি পত্র বা পেপারে পরিণত হয়। ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীরা ওই একটি পত্র বা পেপারের বাইরে প্রতিষ্ঠানে বাংলা শেখার আর সুযোগ পায় না।
গত ২০ বছরে ইংরেজি ভার্সনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। অর্থাৎ বাংলা শেখানো বা শেখার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ইংরেজি মিডিয়াম, ক্যাডেট পদ্ধতি, কওমি ও সাধারণ মাদরাসা, কারিগরি শিক্ষার ধারাগুলোর বাইরে বাংলা মাধ্যমের সাধারণ শিক্ষাধারাটি এখন ইংরেজি ভার্সনের জাঁতাকলে পিষ্ট!
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’Ñ পাকিস্তান আমলে সংঘটিত এই আন্দোলনের ফলে ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসের সৃষ্টি। এই পথ বেয়েই ১৯৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার ও গ্রহণ, সেই সঙ্গে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলায় ভাষণ প্রদান বাংলা ভাষার উচ্চাসন নিশ্চিত করে। পরবর্তীকালে ‘সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন’ এবং আরো পরে ‘সর্বস্তরে বাংলার শুদ্ধ ব্যবহার’ সম্পর্কে সরকারি আদেশ জারি হয়। সমাজ-সচেতনতা যত না সৃষ্টি হয়েছে—সরকারি আদেশেই তা ছিল সীমাবদ্ধ।
এখন সরকারি কার্যালয়গুলোতে বাংলায় ফাইলপত্তর লেখা হচ্ছে। ছোটখাটো বেসরকারি অফিসগুলোর মধ্যেও এ প্রবণতা আছে। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ভাষা ও বানানবিষয়ক একটি সেমিনারে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়ায় জানা গেল, তাঁরা বাংলা ব্যবহার করেন বটে, কিন্তু অনেক বানান, বিশেষ করে যুক্তবর্ণ সম্পর্কে সঠিকভাবে না জেনে অভ্যাসের বশেই লিখে চলছেন। শুধু তা-ই নয়, ইদানীং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যে বানান-ব্যভিচার চলছে সেদিকটাও তাঁরা তুলে ধরলেন। প্রকৌশলীদের কর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়, এখন ভাষা বা বানান শেখার তাঁদের সময় নেই, বয়সও থাকার কথা নয়।
কিন্তু যা আছে তা হলো, আগ্রহ এবং অসীম জিজ্ঞাসাবোধ। যে অভিজ্ঞতাটি উপস্থাপন করা গেল, তা শুধু একটি নির্দিষ্ট পেশার মুষ্টিমেয় লোকের নয়। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিই এ দ্বন্দ্বের শিকার। আমরা হয়তো লক্ষ করব যে সরকারিভাবে স্নাতক পর্যায়ে আবার ইংরেজি আবশ্যিক করা হয়েছে। সাধুবাদ দিই এই উদ্যোগকে; কিন্তু বিস্মিত হই যে সঠিকভাবে বাংলা লেখা বা লেখার ব্যাপারে কোনো মহলেরই উদ্যোগ নেই।
এই কিছুদিন আগেও বাঙালিকে বাংলা ‘শিখতে’ হবে এ কথা মানতে চাইতেন না অনেক ‘জানু-পণ্ডিত’ (যারা অনেক জানেন বলে মনে করেন) বলে কথিত শিক্ষিতজন। এই ভাষারও যে একটি বৈজ্ঞানিক পারম্পর্য আছে এবং আছে একটি আন্তঃশৃঙ্খলা তার প্রতি উপেক্ষাই যেন ছিল সবার। স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা পাঠ্যসূচির দিকে তাকালে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তা হলো এখানে বাংলা শেখার কিছু নেই, আছে মুখস্থ করার বিষয়। আর এখন ফটোকপির বদৌলতে বা গাইড বইয়ের কল্যাণে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা মুখস্থবিদ্যা দিব্যি ফলাচ্ছেন তাঁদের খাতায়। পাস করে বেরিয়ে গিয়ে যাঁরা চাকুরে হচ্ছেন, তাঁদের বাংলাবিষয়ক সমস্যা তখন থেকেই শুরু। অথচ এই সমস্যা তো হওয়ার কথা স্কুলে বা কলেজে। একজন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র হঠাৎ করেই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘তপসে মাছ’ কবিতা পড়ে বুঝতেই পারেন না বিষয়টি কী? (একসময় এই কবিতা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্য ছিল) তার কাছে মনে হয় একটি মাছের রং, স্বাদ বা গন্ধ নিয়ে লেখা কবিতা এমন কী থাকতে পারে, যাকে স্যার মাসভরে পড়াচ্ছেন? আর এ কারণেই সে বাংলা ক্লাসে মনোযোগ হারায়। শিক্ষকও ওই কবিতা থেকে একটির বেশি প্রশ্ন মনেই আনতে পারেন না; আসলে আনা সম্ভবও নয়। কারণ ঈশ্বর গুপ্তের ওই কবিতা বা উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পাঠ্য কবিতাগুলো থেকে ভিন্নমাত্রিক প্রশ্ন করার অবকাশ কম। ফলে যা হয়, তপসে মাছের ‘কনককান্তি’ ছাত্রের কাছে ‘ছাইভস্ম’ ঠেকে। অথচ কবিতাটির গুরুত্ব যে বাংলা কাব্যধারার বিকাশের সঙ্গে জড়িত, তা পড়ানো হয় না।
]আসলে আমাদের বিচারে সাহিত্যকেন্দ্রিকতার চেয়ে ভাষার দিকটি গুরুত্ব দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্তই বাংলা পঠনপাঠন হওয়া উচিত। কেননা উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির পর ছাত্ররা বিষয়ভিত্তিক লেখাপড়ায় নিজেকে নিয়োজিত করে এবং তারপর তার চাকরি বা ব্যবসা। ফলে একজন বাঙালির জীবনে বাংলা সাহিত্যের চেয়ে বাংলা ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগই বেশি ব্যাবহারিক কাজে লাগে। একজন বাঙালি ডাক্তার, প্রকৌশলী, গণিত শিক্ষক বা রসায়নবিদদের অবশ্যই ভালো বাংলা জানা থাকা দরকার। কিন্তু তার সময় দ্বাদশ শ্রেণির বেশি তিনি পান না। এ ক্ষেত্রে যাঁরা স্কুল বা কলেজের সিলেবাস তৈরি করেন তাঁদেরও ভাবা প্রয়োজন যে বাংলা লেখার সময় যেহেতু সীমিত, সেহেতু প্রথম থেকেই একজন ছাত্রের বাংলা জ্ঞান যাতে ঠিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে সেদিকে নজর দেওয়া। আমি একজন প্রখ্যাত ডাক্তারকে জানি, যিনি ব্যবস্থাপত্রে রোগীদের যখন পরামর্শ লিখে দেন (বাংলায়) তখন অনেক বাংলা বানানই অশুদ্ধ লেখেন। ডাক্তারটির কিন্তু দোষ এখানে খুব বেশি দেওয়া যায় না। তিনি নিজ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, কিন্তু দ্বাদশ শ্রেণির পর তো আর বাংলা পরীক্ষা তাঁকে দিতে হয়নি।
স্নাতক পর্যায়ে ইংরেজি বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি যদি বাংলা সিলেবাস বা পাঠ্যরীতির পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে জাতীয়ভাবে লাভের আশা শূন্য। স্নাতক (পাস) পর্যায়ে দেখা গেছে, ছাত্ররা ভালো করে বাংলা বাক্যই লিখতে পারে না। তাদের ইংরেজি পড়ার দরকার নেই বলছি না, কিন্তু আগে তো মাতৃভাষাটা শুদ্ধভাবে তাকে লিখতে জানতে হবে? স্নাতক হচ্ছে তো সে! স্নাতক পর্যায়ের বাংলা যেন দায়সারা কবিতা, গল্প আর প্রবন্ধের পাঠÑ একটি এক বছর এলে অন্যটি পরের বছর আসবে; ফটোকপি আর মুখস্থ এবং অন্য কিছুও।
বাংলা বানান নিয়ে এখন হরহামেশাই আলোচনা তর্ক চলছে। বিভ্রান্তিও এ নিয়েই। কিন্তু ভাষার সাম্প্রতিক গতিপ্রবণতা এসব পাঠ্যসূচিতে নেই। লিপির বিবর্তন না থাকুক অন্তত একটি যুক্তবর্ণে কোন কোন বর্ণ আছে তা তো জানতে হবে। ‘উত্থান’ লিখতে ‘ত’+‘থ’ না ‘থ’+‘থ’; ‘ক্ষ’ এবং ‘হ্ম’ এই দুটো বর্ণে কী কী আছে এ বিষয়ে তো সজাগ হওয়া আবশ্যক। অথচ দেখা যাচ্ছে, স্নাতক ডিগ্রিধারী একজন ছাত্র বা ছাত্রী অনেক ক্ষেত্রেই এ বিষয়গুলো জানেন না। সাহিত্যে যাঁরা সম্মান নিয়ে উচ্চ ডিগ্রি নিচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও এ ব্যাপারটি উত্থাপন করা চলে। কেননা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যসূচি শুধুই সাহিত্যকেন্দ্রিক। সাহিত্য পড়ার আগে বা পাশাপাশি কোনো ছাত্রকে অন্তত ওই ভাষাটির আন্তঃশৃঙ্খলা অবগত হয়ে শুদ্ধ প্রয়োগে পারদর্শিতা অর্জন করা দরকার, সে কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও অনেক সময় বুঝতে চান না। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পরিবর্তিত সিলেবাসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫০০ নম্বরের সম্মান বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে যাঁরা পাস করেছেন তাঁদের মাত্র ২০ নম্বর ছিল ব্যাকরণ ও বানান বিষয়ে। অথচ সেখানে পালি-প্রাকৃত ধাতুরূপ ও প্রায় সমনম্বরে পড়তে হয়েছে—যার প্রাত্যহিক প্রয়োজন একেবারে শূন্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বানান ও অনুবাদ বিষয়ে পড়ানোর কথা থাকলেও সিলেবাসে অবৈজ্ঞানিকতা এতটাই, যার ফলে অনায়াসে বা ফাঁকি দিয়ে বহু নম্বর পাওয়া সম্ভব। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ একটি সম্পূর্ণ কোর্স প্রবর্তন করেছিল এই বানান-ব্যাকরণ ও ভাষার আন্তঃশৃঙ্খলাবিষয়ক, যা প্রথম বর্ষে সবার জন্য আবশ্যিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের প্রতিটি বিষয়ে বাংলা আবশ্যিক কোর্স হিসেবে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষক-রাজনীতির শিকার হয়ে সে কোর্স বছর পাঁচেক পরেই উঠে গেছে।
একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে আমরা এখনো যদি আমাদের বাংলা ভাষা ব্যবহারে অবৈজ্ঞানিকতা দূর করতে ব্যর্থ হই, তাহলে পরিতাপের সীমা থাকে না। অন্য ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা আমাদের অতীব প্রয়োজন এ কথা মানতেই হবে। তবু বাংলা আমাদের প্রথম ভাষা। আর বাংলা ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগের লক্ষ্যে এর পঠনপাঠনরীতি ঢেলে সাজাতে হবেÑ অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তো অবশ্যই।
লেখক : উপাচার্য, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ