সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার উৎস জনগণ। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিকদের সব অধিকার অবারিত ভোগ করার নিশ্চয়তা দিয়েছে সংবিধান। সংবিধানে মৌলিক অধিকার সমুন্নতসহ নানাবিধ ধর্মীয়, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের স্বাধীন অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা সুরক্ষিত। বিশ্বের প্রতিটি দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, ক্ষমতার পালাবদলের পরিক্রমা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের ভূমিকাই মুখ্য।
অহিংস-পরমতসহিষ্ণু পরিবেশে যথাযথ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে অধিকাংশের রায়ের ভিত্তিতে সরকার কাঠামো পরিবর্তনের ধারা সর্বজনস্বীকৃত। নির্বাচনে ধর্ম-বর্ণ-দল-মত-অঞ্চল নির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের ন্যায্য অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। সৎ, যোগ্য, মেধা-প্রজ্ঞা-দেশেপ্রেমে ঋদ্ধ এবং জনগণের স্বার্থ সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দুঃসময়ে পরীক্ষিত নেতৃত্বকেই জনপ্রতিনিধিরূপে নির্বাচিত করে জনগণ তাদের সংবিধানসম্মত ন্যায়সংগত অধিকার ভোগ করতে চায়।
যে কোনো রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণে সরকারের পাশাপাশি শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার কাঠামো গঠনে জনগণের ইচ্ছাশক্তির প্রতিফলন সুষ্ঠু নিয়ামক হিসাবে কার্যকর। প্রতিযোগিতামূলক উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটারদের অংশগ্রহণে নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে, এটাই জনগণের প্রত্যাশা। বিজয়ী দল সরকার পরিচালনার দায়িত্ব অর্জন করলেও ছায়া সরকাররূপে বিরোধী দলের আবির্ভাব সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারাকে পরিপুষ্ট করে। বিরোধী দল সরকারের গৃহীত নীতি-কর্মসূচি বা অন্যান্য কর্মকাণ্ডে কোনো ধরনের ভুলত্রুটি, অনিয়ম-দুর্নীতি এবং অসংগতি থাকলে তা তুলে ধরে শুধু সংসদকে নয়, দেশবাসীকে অবহিত করে। সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় নীতিমালা-পরিকল্পনাকে পরিশুদ্ধ করে বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনা। সরকারি ও বিরোধী দল উভয়েই জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিধায় সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলের ভূমিকাকে অবজ্ঞা করার কোনো অবকাশ নেই। মাইকেল কার্টিস বিরোধী দলের সংজ্ঞায় বলেন, ‘বিরোধী দল বলতে যে দল সরকার গঠন করে না, কিন্তু সরকার পরিচালনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে জড়িত থাকে।’ ব্রুমহেডসহ অনেক মনীষী এটিকে বিকল্প সরকার নামে অভিহিত করেছেন।
ক্ষমতাসীন সরকারের নৈর্ব্যক্তিক বিরোধিতা ছাড়াও বিরোধী দলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে-সরকারি কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় বিরোধী দল সর্বদা তৎপর থেকে সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা, জনগণের স্বার্থ পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষিত রাখতে সংসদীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, জাতীয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীর মধ্যে স্বদেশপ্রেম সৃষ্টির মাধ্যমে জাতীয় সংহতি ও ঐক্য সৃষ্টি করা, গণতন্ত্র রক্ষার অগ্রদূত হিসাবে বিরোধী দল রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো সমস্যা বা গোলযোগ দেখা দিলে শক্তিশালী বিরোধী দল কর্তৃক তা শান্তিপূর্ণ উপায়ে মোকাবিলা করা, গণতান্ত্রিক সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারের স্বেচ্ছাচারী-স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধ করা, রাজনৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনাসাপেক্ষ জনগণকে সচেতন করা, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিরোধী দল কর্তৃক সরকারি দলকে সমর্থনদানের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়তা করা, নিজেদের বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে সরকারি সিদ্ধান্তের ভালোমন্দ জনসমক্ষে তুলে ধরে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে জনমত গঠন করা ইত্যাদি।
সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা সর্বজনীন। এ ব্যবস্থায় সাংবিধানিকভাবে সরকারের ক্ষমতাচর্চা থাকবে নিয়ন্ত্রিত। এ নিয়ন্ত্রণ তাত্ত্বিকভাবে জনগণের কাছে থাকলেও মূলত তার প্রয়োগ ঘটায় রাজনৈতিক দলগুলো। উন্নত গণতন্ত্রে কার্যকর বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন দলগুলোর চেয়ে কার্যত বেশি অবদান রাখে। সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান সংসদ। সরকার ও বিরোধী দলের সৌহার্দপূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ওপরই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কার্যকারিতা ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে। মাঠে সরকারি ও বিরোধী দলের সম্পর্ক পরস্পরের বিপরীত হলেও গণতন্ত্রের স্বার্থজনিত বিষয়ে উভয়ের সমঝোতা বা পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পৃথিবীতে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থাগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিই সর্বোত্তম ও আদর্শ ব্যবস্থা বলে স্বীকৃত। এ ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে যারা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার ওপর। তারা যদি উদার মনোভাবাপন্ন না হন বা তাদের মনোভাব যদি হয় সংকীর্ণ, তাহলে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, সে সমাজে গণতন্ত্র কখনো বিকশিত হয়ে উঠতে পারে না। গণতন্ত্রকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে জনসাধারণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব ইতিহাস পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট যে, যে দেশের জনগণ যত বেশি সচেতন ও দায়িত্বশীল, সেদেশে গণতন্ত্র তত বেশি শক্তিশালী।
প্রকৃতপক্ষে বলিষ্ঠ বিরোধী পক্ষ ছাড়া কার্যকর গণতন্ত্র কল্পনা করা যায় না। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এর অনুপস্থিতির কারণে স্বাধীন মতপ্রকাশও বাধাগ্রস্ত হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসাবে পরিচিত ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব ছিল না। সেই সময় রাজার বিরোধিতা, উত্তরাধিকার, পররাষ্ট্রনীতি বা জাতীয় বিষয় নিয়ে দ্বিমত পোষণে ছিল প্রাণহানির আশঙ্কা। পরবর্তীকালে সামগ্রিকভাবে রাজ্য শাসনের বিকল্প হিসাবে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে। সে সময় রাজা দ্বিতীয় জেমসের ক্ষমতায় আরোহণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিতর্কের ফলে দল হিসাবে টোরি ও হুইগ পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। উনিশ শতকের প্রভাবশালী দার্শনিক-রাজনীতিক জন স্টুয়ার্ট মিল ১৮৫৯ সালে ‘অন লিবার্টি’ বইয়ে লিখেছেন, ‘সুস্থ রাজনীতির জন্য যেমন দরকার স্থিতিশীলতার পক্ষের দল, তেমনি দরকার প্রগতিশীলতার বা সংস্কারের পক্ষের দল।’ এতে সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ের সহনশীল, আদর্শিক ও দায়িত্বশীল হওয়ার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভুল সংশোধনের পথ বিকশিত হয়।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দীর্ঘ সময় সেনা-স্বৈরশাসনের কারণে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বেশকিছু উপাদান ইতোমধ্যে তার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে। জনজীবনে এর কুফল প্রতিফলিত হয়েছিল অনুন্নয়নে, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অবদমনে, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনায় এবং দুর্নীতিতে। ৭৫-পরবর্তী এদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বিচারহীনতার সংস্কৃতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধানকে লন্ডভন্ড করে আর্থ-সামাজিক, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সব স্তরে দেশকে চরম পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসকরা নিজেদের ইচ্ছামাফিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এর ফলে নির্বাচন ব্যবস্থাও সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। প্রথম সামরিক শাসক ক্ষমতায় এসেই বৈধতার কৃত্রিম সংকট অতিক্রমের জন্য নানাবিধ ভঙ্গুর পদক্ষেপ নিতে থাকেন। ক্ষমতায় থেকে দল গঠন এবং একের পর এক নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দখলকৃত ক্ষমতাকে বৈধ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল এরই একটি ধাপ। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরম্পরায় সেনাশাসকদের অগ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রশাসন গণতন্ত্রের বিকাশে অন্তরায় হিসাবে কাজ করে।
আমাদের সবার জানা, দেশের প্রধান বিরোধী দল ও সমমনা জোটগুলো ২০১৪ সালের মতো ২০২৪ সালের নির্বাচনও বর্জন করে। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল দলগুলো। তাদের ভোট বর্জনের মধ্যেই টানা চতুর্থবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে না গিয়ে দল রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে বলে দাবি করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘একটি নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের তেমন সুযোগ থাকে না। ফলে বিএনপিকে অপেক্ষা করতে হবে আরও ৫ বছর। কম ভোটার উপস্থিতির অভিযোগ ছাড়া বিএনপির এ আন্দোলনে প্রাপ্তি তেমন কিছু নেই। আন্তর্জাতিক তৎপরতা ও দেশের মানুষের সমর্থনে বিএনপির জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য জাতীয় নির্বাচনই ছিল একমাত্র উন্মুক্ত পথ। সে সুযোগ তারা গ্রহণ না করে অরাজকতা, নাশকতা, আগুন সন্ত্রাসসহ নানাবিধ কদর্য কর্মযজ্ঞে রাজনীতি ও জনগণের সঙ্গে বিশাল দূরত্ব নির্মাণ করেছে। এ দেশের মানুষ ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন চায়, সে আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে বিদেশিদের কথায়। কিন্তু তারা কোনো দলকে এনে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে না।’
মোদ্দাকথা, একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে বিএনপি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। জাতীয় পার্টি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, তাদের কাছ থেকেও পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন কতটুকু সম্ভব হবে, তা দেখার বিষয়। বর্তমানে পাকিস্তানে নির্বাচনের পর সরকার গঠনে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা নিরসন করে একটি টেকসই সরকার গঠন কতটুকু সম্ভব হবে, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। সামরিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ভঙ্গুর সরকার গঠন যে কোনোভাবেই টেকসই গণতান্ত্রিক রাজনীতির দৃষ্টান্ত হতে পারে না, বর্তমান পাকিস্তান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশে বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে শুধু বিরোধিতার খাতিরে সরকারের বিরোধিতা নয়; বরং সত্যিকার অর্থে জনদুর্ভোগ লাঘবে এবং দেশে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে সরকারের সঙ্গে ঐকমত্য ও সহযোগিতার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন এবং জীবনযাত্রার মানকে উন্নীত করার উদ্যোগই হবে কাক্সিক্ষত পদক্ষেপ।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়