বুধবার ২৫ জুন ২০২৫ ১১ আষাঢ় ১৪৩২
বুধবার ২৫ জুন ২০২৫
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারে ব্যর্থতার দায়
অলোক আচার্য
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৫:১৬ PM আপডেট: ২২.০২.২০২৪ ৬:২০ PM
পৃথিবীর আলো দেখার পর থেকেই মা এবং আশেপাশের মানুষের মুখে নানা ভাষা শুনে শিশু ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেটাই তার মাতৃভাষা। সেই ভাষা চর্চার মধ্যে দিয়েই শিশু বড় হয়ে উঠতে থাকে। পৃথিবী থেকে বহু ভাষা আজ বিলুপ্ত। হারিয়ে যাওয়ার পথে অনেক ভাষা। আমাদের বাংলা ভাষাও কেড়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্থানিরা। 

জীবনের বিনিময়ে সে ভাষার অধিকার রক্ষা করেছি। তবে রক্ষা করেও যেন আমাদের ভাষা আমাদের কাছেই বড় অবহেলার। বেশ আয়োজন করেই সেই ভাষা বাদ দিয়ে বিদেশি ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি। এখন তো এই প্রশ্নও মনে আসতে পারে আমাদের ভাষার গুরুত্ব বাংলা না ইংরেজিতে বেশি দিতে হবে? কারণ বাস্তবতা হলো, ইংরেজি চর্চা এবং ইংরেজি শেখা নিয়ে ব্যস্ততার ভিড়ে বাংলা অসহায়। যারা ভালো বাংলা জানেন, উচ্চারণ করতে পারেন এবং ভালো লিখতে পারেন তারাও তথাকথিত ইংরেজের লেজের কাছে অসহায়! এভাবে দিনের পর দিন অবহেলার ফলে ভাষা চর্চার অভাবে ভাষার বিকৃতি ঘটছে। অনেকেই এখন বাংলিশ ভাষা ব্যবহার করেন! চোখের সামনে মায়ের ভাষার এ পরিণতি দেখতে হচ্ছে। বাংলার স্থলে ইংরেজি অনেক বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। 

দেশের জন্য, জাতির জন্য ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার স্বাধীনতা থাকা আবশ্যক। আমারা সৌভাগ্যবান যে আমাদের সেই স্বাধীনতা রয়েছে। ইংরেজি ভাষার আধিপত্যে মাতৃভাষা আজ কোণঠাসা। স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে অফিস আদালত পর্যন্ত ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য। প্রাধান্যের পরিমাণ এতটাই বেশি যে ইংরেজি ভাষা জানলে আর অন্য ভাষার দরকার নেই এমনভাব লক্ষণীয়। নামফলক লেখার ব্যাপারে আদালতের যে আদেশ রয়েছে তাও উপেক্ষিত হচ্ছে। অথচ এই ভাষার কথা বলার অধিকার রীতিমত আন্দোলন করে অর্জন করতে হয়েছে। এ দিকটা ভাবলে ভালোই লাগে। বেশ গর্ব হয়। তবে গর্ব হওয়া পর্যন্তই যেন আমাদের দায়িত্ব। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে শহিদ মিনারে’ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান গাওয়াটাই শেষ কথা নয়। তাদের অবদান ভুলে না যাওয়ার শপথ করলেও আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। প্রথম ভাষা দ্বিতীয় ভাষার যে বিষয় রয়েছে তার মধ্যে আজ ইংরেজি ভাষাই যেন প্রথম ভাষা আর বাংলাই হয়ে যাচ্ছে দ্বিতীয় ভাষা। 

ইংরেজি বিষয়ের গুরুত্ব বেশি, স্কুল-কলেজে ইংরেজি শিক্ষকের গুরুত্ব বেশি, ইংরেজিতে কথা বলার গুরুত্ব বেশি, ইংরেজি জানা ব্যক্তির গুরুত্ব বেশি। তাহলে বাংলার অবস্থান কোথায়? কেবল গর্ব করলেই কি সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? ইংরেজি ভাষা আজও অভিজাত শ্রেণির ভাষা। বাংলা ভাষার অবস্থা তাই ক্রমেই দৈন্য। ভাষা আন্দোলনের পর পেরিয়ে গেছে ৭১ (একাত্তর) বছর। সাত দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো প্রত্যাশা পূরণ হয়নি ভাষা আন্দোলনের। যুগের পর যুগ পেরিয়ে গেলেও নিশ্চিত করা যায়নি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। বাংলা ভাষার ব্যবহার সর্বস্তরে নিশ্চিত করাসহ প্রশাসন, রাষ্ট্র পরিচালনা, শিক্ষা-প্রযুক্তির প্রসার, ভাষার উন্নয়ন আর পাহাড়িদের ভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে আজ পর্যন্ত করা হয়নি জাতীয় ভাষানীতি। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সরকার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সংবিধান, ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ২০১৪ সালে উচ্চ আদালতের রায় এবং ডজন খানেকেরও বেশি সরকারি আদেশ, পরিপত্র বা বিধিতে বাংলা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ইংরেজি বিস্তারে যে পদক্ষেপ বা আগ্রহ ততটা আগ্রহ বাংলা ভাষার শুদ্ধতার বিস্তারে নেই। ইংরেজি শিখলেই সব হয়ে যাবে এমন ভাবটাই প্রাধান্য পাচ্ছে। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে মিশ্রিত ভাষা বাংলাকে আরও দুর্বোধ্য করে তুলছে। অথচ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা বাংলার সুষ্ঠু ব্যবহার ও মর্যাদা রক্ষার কর্তব্য রয়েছে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি বিদ্যমান আইন ও হাইকোর্টের আলাদা দুটি আদেশ থাকার পরও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি সাইনবোর্ড, নামফলক, বিলবোর্ড বাংলায় লেখার প্রজ্ঞাপন থাকলেও তার কোনো তদারকি বা মেনে চলার আগ্রহ নেই। ফলে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা চর্চার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে আইন করা হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ। তবে সেই স্বপ্ন অধরাই থেকেছে বরাবর। প্রতি বছর ঘুরে ফিরে ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা ভাষা চর্চা এবং সর্বস্তরে প্রয়োগের বিষয়ে ব্যপক আলোচনা হয়। তারপর সারাবছর আবার সেই এক অবস্থা। দেশের শহরে বড় হওয়া প্রজন্মের কাছে বাংলা প্রাধান্য না পেয়ে ইংরেজিটাই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। কারণ ইংরেজি সর্বস্তরে তার থাবা বিস্তার করে আছে। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে মন্ত্রিসভার বৈঠকে নয়টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৯৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বাংলায় একটি মামলার রায় দেয়। এছাড়া ২০১৩ সালে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে বাংলার প্রচলন, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার গাড়ির নম্বর প্লেট, বিভিন্ন দপ্তরের নামফলক, গণমাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞাপন ও মিশ্রভাষার ব্যবহার বন্ধে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট (নিমকো) পরিচালিত সর্বশেষ নমুনা জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীর কাঁটাবন থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ৫০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৫১টির নামফলক লেখা হয়েছে বাংলা হরফে। ইংরেজিতে লেখা নামফলকের সংখ্যা ২৮০টি। অন্যদিকে, বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে ‘বাংলিশ’ ধরনের নামফলক রয়েছে ১৬৯টি। ২০০০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাসচিব কোইচিরো মাতসুয়ারা ১৮৮ দেশের কাছে চিঠি দিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি পালনের আহ্বান জানান। বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এ আইনের ৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ এছাড়া ‘উল্লেখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলাভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে উহা বে আইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।’ ভারতীয় উপমহাদেশ বহুবছর ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। বহু বছর তাদের অধীনে থাকার কারণে ইংরেজি আমাদের অস্থি মজ্জায় গেঁথে গেছে। ব্রিটিশরা চেয়েছিল তাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ওপর প্রয়োগ করতে। বহু বছরের শাসনের ফলে তাদের সে অভিপ্রায় আজ অনেকটা সফল।

ভাষার অধিকার আদায়ে আমাদের রক্তস্নাত ইতিহাস থাকলেও বিদেশি ভাষা চর্চার প্রতি আমাদের আগ্রটাই বেশি। এমনকি নিজেদের ভাষা শুদ্ধভাবে না জানলেও বিদেশি ভাষা চর্চার কমতি নেই। বাংলা সমৃদ্ধশালী ভাষা হলেও আমাদের কারণেই কোথায় যেন একটা ঢিলেঢালা ভাব চোখে পরে। হতে পারে বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই ভাষাকে এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় যে মনে করা হয় এটা ভালভাবে আয়ত্ত না করলে জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে। তার মানে এই না যে ইংরেজি বা অন্য ভাষা শেখার গুরুত্ব নেই। তাই বলে নিজ ভাষা চর্চার উপরে অবশ্যই নয়। লেখাপড়া করে বড় হয়েছি সেখানে সারা বছরই আমাদের ইংরেজি প্রাইভেট পড়তে হয়েছে। তারপরেও যে বিষয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীরা ফেল করেছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো ইংরেজি। শ্রেণিতে প্রায়ই পড়া না পারার জন্য বেতের পিটুনি ছিল নির্ধারিত। তাও কিন্তু বেশিরভাগ সময় ঐ ইংরেজি ক্লাসেই খেয়েছি। অর্থ্যাৎ সারা জীবনটাই কিন্তু বিদেশি ভাষা রপ্ত করতে করতে কাটিয়ে  দিলাম কিন্তু তারপরেও এই ভাষার উপর ক’জনে কতটা দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছি। অনেকেই তো কোনমতে শিখে জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। শুধু স্কুলে কেন বাড়িতেও তো বাবা মা বা মুরুব্বিস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সারাক্ষণ ইংরেজি পড় ইংরেজি পড় করেছে। বাংলাটা মনোযোগ দিয়ে পড়া উচিত এরকম কথা পরিবারে বা স্কুলে খুব কম শুনেছি বলেই মনে হয় 

বাংলা ভাষার প্রতি বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ কতখানি তা পরিমাপের একটা চেষ্টা করা হয়। আসলেই বিষয়টা এমন হওয়া উচিত? সারা বছর বাংলা নিয়ে চর্চা হবে। সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করার চেষ্টা করা হবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা মোটা মোটা বিদেশি সাহিত্যের বই নিয়ে দিন রাত ব্যস্ত থাকবে  না। এর একটা অংশ বাংলা বই নিয়েও কাটাবে। মোট কথা শুধু কাগজে কলমে নয় অন্তরে স্থান দিতে হবে বাংলাকে। তাহলেই অন্তর হবে শুদ্ধ। আর শুদ্ধ অন্তর দিয়ে যে ভাষাই আয়ত্ব করতে চাও না কেন তা সম্ভব। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহিদদের সেই মহান আত্মত্যাগ, সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বিকৃতি এসবকিছুই বাংলাকে নিয়ে গর্ব করার মতো যথেষ্ট। এছাড়াও এ ভাষা নিয়ে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে বলার অনেক কিছু আছে। দেশে অনেক ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল রয়েছে। সেখানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলার সঠিক ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ হলে ভাল হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত