সোমবার ৭ জুলাই ২০২৫ ২৩ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ৭ জুলাই ২০২৫
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা
কাজী শায়লা সুলতানা
প্রকাশ: শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৩:৪৭ PM
বাংলাদেশের পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, পূর্বে আসাম ও ত্রিপুরা, উত্তরে আসাম ও মেঘালয় রাজ্য আর দক্ষিণে নীল সমুদ্র বঙ্গোপসাগর। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয় এবং দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।

প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশ শাসিত আর ২৪ বছর পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা নিপীড়িত বঞ্চিত একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব এই ভগ্নপ্রায় ছোট দেশটির পুনর্গঠনের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। এ যেন জন্মদাতা পিতার মতো সন্তানকে গড়েপিটে মানুষ করার দায়িত্ব। শিল্প-কারখানাবিহীন কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতি তখন চরম দুর্দশাগ্রস্ত। ১৯৭২ সালে সরকার গঠন করার পর থেকে বঙ্গবন্ধু হাজারো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন।
একদিকে দারিদ্র্য, র্কমসংস্থানের স্বল্পতা, খাদ্যসংকট, অন্যদিকে বিশ্বের সব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রত্যাশা, কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে তাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু করা। এই কণ্টকাকীর্ণ পথে চলতে চলতেই বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ একদিন নিশ্চিত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে। স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি—এই তিনের মধ্যে ব্যবধান অনেক। কিন্তু পথ চলা শুরু না করলে যেমন গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না, তেমনি স্বপ্ন না দেখলে লক্ষ্যও অর্জিত হয় না। 

চিন্তাধারায় দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু তাই তখনই দেশের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত বিশাল সমুদ্রের জলসীমা নিয়ে ভেবেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সংসদে উত্থাপিত হয় ‘দ্য টেরিটরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট’। এই অ্যাক্টেই প্রথম গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের কন্টিগিউয়াস জোন, ইকোনমিক জোন, কনজারভেশন জোন, কন্টিনেন্টাল শেলফ ও টেরিটরিয়াল ওয়াটার্স নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। একই সঙ্গে এসব নির্ধারিত এলাকায় অনুপ্রবেশ ও অননুমোদিত তৎপরতার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের উল্লেখও এই বিলে করা হয়। সংসদে উত্থাপিত বিলের ওপর যথারীতি আলোচনা ও মতামত গ্রহণের পর ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পাস হয় দ্য টেরিটরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর স্বভাবতই একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরে আঞ্চলিক জলসীমা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। মূলত সমুদ্র সম্পদ আহরণ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্যই এই জলসীমা নির্ধারণ করা অপরিহার্য ছিল। আজ থেকে পাঁচ দশক আগেই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন সদ্যঃস্বাধীন একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সমুদ্র সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা একান্ত জরুরি।

১৯৭২ সালে গৃহীত আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৩(২)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সংসদকে টেরিটরিয়াল ওয়াটার এবং কন্টিনেন্টাল শেলফ নির্ধারণ সম্পর্কিত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়। আর এই ক্ষমতাবলেই তৎকালীন সংসদ ১৯৭৪ সালে ‘দ্য টেরিটরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ পাস করে।

এই আইনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এতে টেরিটরিয়াল ওয়াটার, কন্টিগিউয়াস জোন, ইকোনমিক জোন, কনজারভেশন জোন এবং কন্টিনেন্টাল শেলফ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে সামগ্রিক দূষণ কিভাবে প্রতিরোধ করা যাবে। সব শেষে এই আইন বাস্তবায়নের জন্য সরকার কর্তৃক কোনো রুলস লঙ্ঘিত হলে সেটার শাস্তি কী হবে সেই বিধানও রাখা হয়েছে।

‘দ্য টেরিটরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪’-এর অনুচ্ছেদ (৩) অনুসারে সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সমুদ্রে বাংলাদেশের জলসীমা নির্ধারণ করতে পারবে এবং উক্ত জলসীমার উপরিস্থ আকাশ সীমানায় দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা বিরাজমান থাকবে। এই জলসীমার ভেতরে কোনো বিদেশি জাহাজ ‘ইনোসেন্ট প্যাসেজ’-এর অধিকার ব্যতীত প্রবেশ করতে পারবে না। উল্লেখ্য, ‘ইনোসেন্ট প্যাসেজ’ হলো এমন একটি অধিকার যে অধিকার বলে কোনো বিদেশি জাহাজ অপর একটি দেশের জলসীমার ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে—যতক্ষণ পর্যন্ত না এই প্রবেশের কারণে উক্ত দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। টেরিটরিয়াল ওয়াটার থেকে গভীর সমুদ্রে অগ্রবর্তী অংশকে বলা হয় কন্টিগিউয়াস জোন। সমুদ্রের জলরাশির এই অংশে দেশের নিরাপত্তা, অভিবাসন, কাস্টমস ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার্থে যেকোনো ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার সরকারকে দেওয়া হয়েছে দ্য টেরিটরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর অনুচ্ছেদ-৪ এর মাধ্যমে।

আইনের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ সরকারকে জলসীমা থেকে গভীর সমুদ্রে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত এলাকা ইকোনমিক জোন হিসেবে ঘোষণা করার অধিকার দিয়েছে। ঘোষিত ও নির্ধারিত এই অর্থনৈতিক সীমানার মধ্যে অবস্থিত সব ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর (Both Living and Non Living) রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার থাকবে।

আইনের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সমুদ্রের জীব সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য জলসীমাসংলগ্ন এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার অধিকার সরকারকে দেওয়া হয়েছে এবং নির্ধারিত সংরক্ষিত এলাকায় সমুদ্র সম্পদকে ক্ষতি বা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য সব ধরনের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকারও সরকারের রয়েছে।

আইনের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের উপত্যকাসংলগ্ন সাবমেরিন এরিয়ার সি বেড, সাবসয়েল, জলসীমা পরবর্তী সীমা থেকে কন্টিনেন্টাল মার্জিন পর্যন্ত এলাকা কন্টিনেন্টাল শেলফ হিসেবে পরিগণিত হবে। এই কন্টিনেন্টাল শেলফ এলাকার সব খনিজ সম্পদ, জীব সম্পদের ওপর বাংলাদেশের অধিকার রয়েছে। এসব সম্পদকে যেকোনো প্রকার ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করতে পারবে।

আইনের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ এই আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘিত হলে শাস্তির বিধানসংবলিত রুল তৈরি করার অধিকার বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছে। এই রুলের মাধ্যমে আইনের কোনো বিধান কারো মাধ্যমে লঙ্ঘিত হলে তাকে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা জরিমানা, যা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। দ্য টেরিটরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর উল্লিখিত বিধানগুলো পর্যালোচনা সাপেক্ষে বলা যায় বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলরাশির ওপর নির্ধারিত কিছু সীমানাসংবলিত অঞ্চলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে।

১৯৭১ সালে দেশকে স্বাধীন করে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জলসীমা নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুভব করতে পেরেছিলেন আজ থেকে ৫০ বছর আগে। আজ এরই ধারাবাহিকতায় আমরা সমুদ্র জয় করে এর বিশাল জলরাশি থেকে সম্পদ আহরণ করছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত করার দায়িত্ব আজ আমাদের কাঁধে অর্পিত। অকুতোভয় বীর বাঙালি নিশ্চয়ই একদিন এই স্বপ্নকে দিনের আলোর মতো সত্য করে তুলবে এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

লেখক : একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক


« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত