বাঙালির ইতিহাস সৃষ্টির অগ্নিঝরা মাস মার্চ শুরু হলো। একাত্তরে এই মার্চ মাসেই শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে যে ৩০ লাখ শহীদ দেশের স্বাধীনতার বেদিতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। একাত্তর থেকে ২০২৪ সাল দীর্ঘ ৫৩টি বছর কেটে গেছে।
পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি আর সমাজব্যবস্থার। এই পরিবর্তনের ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। নষ্ট হয়েছে দেশের রাজনীতি। আর চোখ-ধাঁধানো উন্নতি হয়েছে অর্থনীতির।
স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো আর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই পাশে ছিল প্রতিবেশী ভারত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে ভূমিকা রেখেছিলেন, এককথায় তা ছিল অবিস্মরণীয়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন আর আরব দেশগুলো সরাসরি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাংলাদেশের মানুষ হত্যায় নেমেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
অনেক আরব দেশ পাকিস্তানকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল। ব্যতিক্রম শুধু ইরাক।
অগ্নিঝরা মাসদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড ও ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে আর পার্কিনসন বিশ্বব্যংকের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে। তাঁরা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত কাজ করেছিলেন বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুর গঠিত প্রথম পরিকল্পনা কমিশন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনা কমিশন।
নেতৃত্বে ছিলেন দেশসেরা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আনিসুর রহমান ও অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন। সবাই অর্থনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা প্রণয়নে পাকিস্তানের দুই অর্থনীতির তত্ত্বকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সমৃদ্ধ করতে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বড় গুণ ছিল কে কোন কাজের জন্য উপযুক্ত, তিনি তাঁকে খুঁজে বের করতে পারতেন, যেটি বর্তমানে সেভাবে দেখা যায় না। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, স্বাধীন দেশের ভিত্তি স্থাপনে যাঁরা নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন, তাঁদের রাষ্ট্র কখনো কোনো খোঁজ নেয়নি। বঙ্গবন্ধু আমলাদের রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ করণিক হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় নয়। তিনি কখনো চাননি আমলারা তাঁদের ‘আমলাতন্ত্র’ রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিন। বর্তমানে তো দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী পেশা হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্ববিষয়ে বিশারদ আমলা। তাঁদের কাজই হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁদের তন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, হোক তা কৃষি বা মহাশূন্য গবেষণা বা শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশন যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ গঠনের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছে, তখন কমিশনে যোগ দিলেন পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা একজন আমলা। তাঁর যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু তিনি চারজন শিক্ষক অর্থনীতিবিদের কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। আর ওই পেশাদার শিক্ষক অর্থনীতিবিদরাও আমলা সদস্যের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন না। অচিরেই তাঁরা কমিশন ছেড়ে নিজ নিজ পেশায় ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁরা থাকলে বঙ্গবন্ধুর হাতকে অনেক শক্তিশালী করতে পারতেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক সমস্যা শুরু হয়েছিল বা ১৯৭৪ সালে যে খাদ্যাভাব দেখা দিয়ছিল, তার পেছনে নানা ষড়যন্ত্র ছিল। এই সময় যে ব্যক্তিটি খাদ্যসচিব ছিলেন, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তিনি জিয়ার উপদেষ্টা হয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নানা সময় খাদ্য মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করতে ব্যস্ত থাকতেন।
গত ৫৩ বছরে অন্য যে বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে, তা হচ্ছে রাজনীতি। ১৯৭৫ সাালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলাদেশে পরবর্তী ২১ বছর জেঁকে বসেছিল সামরিকতন্ত্র। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর সুযোগ এসেছিল দেশের রাজনীতিকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরানোর। তিনি তা না করে হেঁটেছেন তাঁর স্বামী, দেশের প্রথম সেনা শাসক বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার পথে, যার ফলে দেশের রাজনীতি তাঁর শাসনামলেও সঠিক পথে হাঁটতে পারেনি। তিনি দুইবার পূর্ণ মেয়াদে ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। একটু চেষ্টা করলে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে নিজের জন্য একটি অবস্থান তৈরি করে নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি নিজের পরিবারের আর দলের স্বার্থের ওপরে উঠতে পারেননি। বর্তমানে তিনি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কারা ভোগ করছেন। তাঁর জীবিত পুত্র তারেক রহমান, যাঁকে তিনি দলের দায়িত্ব দিয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন, তিনিও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে পলাতক। আর দলটির দূর্ভাগ্য হচ্ছে, এই দলে অনেক প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ থাকা সত্ত্বেও শুধু নেতৃত্বের অযোগ্যতার কারণে দলটি বর্তমনে অনেকটা অবলুপ্তির পথে।
২০০৬ সালে বিএনপি যে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, তারা এই এখন পর্যন্ত ক্ষমতার বাইরেই থেকে গেছে। আগামী দিনে ক্ষমতায় আবার ফিরতে পারবে, তেমন কোনো সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কার্যক্রমের কারণে মানুষকে শুধু হতাশই করেনি, নিজেরাই নিজেদের বিলুপ্তির কারণ হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ঊনবিংশ শতকের রাজনীতির চিন্তাধারা আঁকড়ে ধরে থাকলে খুব বেশি দূর যে যাওয়া যায় না, পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালেই দেখা যায়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জাঁদরেল নেতা সোমনাথ চ্যাটার্জি কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের আমলে লোকসভার স্পিকার ছিলেন। ২০০৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি সরকার থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে সোমনাথ চ্যাটার্জিকে স্পিকারের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বললে তিনি তা করতে অস্বীকার করেন এই বলে যে স্পিকার কোনো দলের নন। কমিউনিস্ট পার্টি তখন তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে। ১৯৯৬ সালে মার্ক্সবাদী নেতা জ্যোতি বসুর সামনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। দলের সিদ্ধান্তের কারণে তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করেননি। ভারতে বামধারার রাজনীতি এখন অস্তাচলে। বাংলাদেশেও তাই।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির পক্ষে একটি সম্মানজনক সংখ্যক আসনে বিজয় লাভ করাটা অসম্ভব ছিল না। তবে ২০১৮ সালের মডেলে হলে তা হতো না। ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নামে প্রতি আসনে একাধিক প্রার্থীর কাছে মনোনয়ন বিক্রি করেছিল। এটি শুধু দলের নিবন্ধন বাঁচানোর কৌশলই ছিল না, ছিল মনোনয়ন বাণিজ্যও। সেই বাণিজ্যের কয়েক শ কোটি টাকা গিয়েছিল লন্ডনে। বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৌড়ঝাঁপ ছিল লক্ষণীয়। একসময় তাদের এই দৌড়ঝাঁপ কিছুটা অশোভন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তাদের সহায়তা করার জন্য তারা এ দেশে তাদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল নাগরিক সমাজের বেশ কিছু ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীকে। একটি জায়গায় তাঁদের মৌলিক আদর্শের মিল ছিল, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগ বিরোধী। তাঁরা বিরাট অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। এই রকম একজনের একটি সংস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে ১৪টি বিদেশি সংস্থা থেকে বিরাট পরিমাণের অর্থ নেয়। এই সংস্থাটি নাকি গঠিত হয়েছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন মেরামত করতে। অর্থায়নকারী সংস্থার একটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত দেশে দেশে সরকার পরিবর্তনে পারদর্শী। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের এই সংস্থাটি সরকারের অনুমোদন নিয়ে চলে, তবে ভিন্ন পরিচয়ে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যখনই কোনো প্রতিনিধিদল বাংলাদেশকে হেদায়েত করতে ঢাকায় আসে, তাদের ডাক পড়ে এই বিষয়ে তাদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য। শলাপরামর্শ শেষে তারা ফিরে গিয়ে বিএনপিকে আশ্বাস দেয়, কোনো চিন্তা নেই ৭ জানুয়ারি সরকারি দলের পরিকল্পনামাফিক নির্বাচন হচ্ছে না। আপনারা রাজপথে আন্দোলনের নামে যা করছেন, তা চালিয়ে যান। ক্ষমতা আপনাদের দ্বারপ্রান্তে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করল তথাকথিত রহস্যজনক ভিসা স্যাংশন। সন্ত্রাস দমনে পারদর্শিতার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত র্যাবের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয় এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা। যুক্তরাষ্ট্রের এসব ডানা ঝাপটানো দেখে বিএনপি ও তার মিত্ররা হয়ে ওঠে বেশ উজ্জীবিত। তারা বুঝতে পারে না পশ্চিমা দুনিয়ার পররাষ্ট্রনীতি তাদের করপোরেট স্বার্থের ওপরে কখনো ওঠে না। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার স্রেফ ধাপ্পাবাজি বৈ আর কিছু নয়। গর্তে পড়া যদি ভাগ্যে লেখা থাকে বাঁচানো কঠিন।
শেষতক সব জল্পনাকল্পনা পেছনে ফেলে হয়ে গেল ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন। বিএনপি ও তাদের অপরিণামদর্শী মিত্ররা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল। শেখ হাসিনার সাহস, দূরদর্শিতা, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা মূল্যায়ন করার সক্ষমতা আর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে সবাই ধরাশায়ী। আর যারা এই নির্বাচন না হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল, তারা রাজধানীর গলি-ঘুপচি থেকে দেশের মানুষকে জানিয়ে দিল, নির্বাচন হলে কী হবে, কোনো দেশ এই নির্বাচন মেনে নেবে না। তারা আবারও তাদের নির্বুদ্ধিতার স্বাক্ষর রাখে। তারা বুঝতে পারে না এটি কোনো প্রবাসী সরকার নয়। দেশের ভেতর থেকে দেশের সংবিধান মেনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন। এখানে স্বীকৃতি দেওয়া না দেওয়ার কিছু নেই। আছে নিজেদের স্বার্থ। সরকার গঠন করার অনুষ্ঠানে যেসব দেশের এ দেশে অবস্থানরত প্রতিনিধিরা নির্বাচনের আগে ডানা ঝাপটে ধুলা উড়িয়েছিলেন, তাঁরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজপথে ধুলা উড়িয়ে ছুটলেন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সামনের চেয়ার দখল করতে। সেসব দেশের প্রতিনিধিরা উড়ে এলেন ঢাকায়। দর্শন দিলেন এ দেশে তাঁদের হতাশ মিত্রদের। পিঠে হাত রেখে বললেন, শান্ত হোন। ধৈর্য ধরুন। একটু বাস্তববাদী হোন। নেতৃত্ব আর কৌশল ঠিক থাকলে ২০২৮ সালে ভাগ্য সুপ্রসন্নও হতে পারে।
বিএনপি কী করবে এটি তাদের ব্যাপার। তাদের পরামর্শ দেওয়ার মানুষের অভাব নেই। তবে অভাব বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার। অভাব দেশের মানুষের ওপর আস্থা রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার। অক্ষমতা এটি বোঝার যে বিদেশিরা কখনো কোনো দলকে ক্ষমতায় বসাতে পারে না, যদি না পেছনের দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সেই আশা আপাতত সুদূর পরাহত।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক