বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একেবারেই অভিন্ন দুটি শব্দ যা একইসূত্রে গাঁথা; একটি অপরটির পরিপূরক। ব্যক্তিত্ব এতটাই দ্যুতিময় যে, একান্ত বৈরী সময়ে, স্বাধীনতার বিপরীত স্রোতে বয়ে চলা রাষ্ট্রযন্ত্র যখন সবকিছু থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল; তখনো বঙ্গবন্ধু বিবিসির জরিপে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের উত্তাল জনসমুদ্রে পরোক্ষভাবে এবং ২৬ মার্চ প্রত্যক্ষভাবে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তার আগে, তিনি বাংলার প্রতিটি মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করেন স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহা। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করেন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে, মানুষকে সংগঠিত করেন, অসম্ভব কষ্ট স্বীকার করেন, জেল-জুলুম সহ্য করেন, কিন্তু লক্ষ্য থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি।
তার ২৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে ১৩ বছরের অধিক কেটেছে জেলে; কারা প্রাচীরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, দু-দুবার ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন জাতির মুক্তির জন্য। বারবার নানা লোভনীয় অফার, নানা মুচলেকার বিনিময়ে কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। কনডেম সেলের সামনে বঙ্গবন্ধুকে দেখিয়ে কবর খোঁড়া হয়েছে, এরকম শাসরুদ্ধকর অবস্থায়ও, পাকিস্তানিদের আপস প্রস্তাবের জবাবে বঙ্গবন্ধু বুক চিতিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মানুষ একবার মরে, দুবার মরে না।’ তিনি বীরদর্পে বলেছেন, তিনি জীবন দেবেন কিন্তু বাংলার মানুষের মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম থেকে বিরত থাকবেন না। এজন্যই তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত কালজয়ী নেতা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রূপকার ও মহান স্থপতি।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তদানীন্তন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের নিভৃতপল্লি টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা-মা তাকে আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’ বলে। ১৯৪১ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এখানে অধ্যয়নকালেই তার সাহসিকতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, বাগ্মিতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি পরস্ফুিটিত হয়ে উঠে। এর পরের ঘটনা ও ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বীরদর্পে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তার রচিত স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন শতাব্দীর এ মহানায়ক। এরপর তিনি দেশগঠনের অংশ হিসেবে যে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন তা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জমির মলিকানার সীমা নির্ধারণ করে সমবায়ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলেন। আমাদের কৃষি জমি যেভাবে কমছে, সেক্ষেত্রে তার সবুজ বিপ্লবনীতি আজও প্রাসঙ্গিক। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করে স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার জন্য মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
সময়ের হিসেবে এই সামান্য কয়েকটি বছরে বঙ্গবন্ধুর যে অসাধারণ কর্মতৎপরতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তার অনন্যসাধারণ রাষ্ট্রনায়কসুলভ প্রতিভা এবং অসাধারণ কর্মদক্ষতার পরস্ফুিটন আমরা দেখতে পাই। যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলতে নিরলস পরিশ্রম করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ক্ষুধা, দুর্নীতি, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক স্বনির্ভর এক উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবুজ বিপ্লব’-এর। তার সেই সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন এখন কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে।
কৃষি গবেষণায় কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সাফল্য তারই অনুপ্রেরণার ফসল। বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার কৃষি বিজ্ঞানী বের হয়ে এ দেশের মানুষকে আলোর পথ দেখাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপ্লবের উদ্যোগ না নিলে এবং কৃষি উৎপাদনের ভিত্তিমূল তৈরি না করলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা আজকের এই অবস্থানে আসতে পারতাম না। এজন্য আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের মদতপুষ্ট কতিপয় উচ্চাভিলাষী, পথভ্রষ্ট সামরিক কর্মকর্তার নির্মম হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে তার এই অগ্রযাত্রা রুদ্ধ হলেও বাংলাদেশ গত দেড় যুগে কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বঙ্গবন্ধুর প্রিয় কন্যা শেখ হাসিনার জীবনে যে দুঃসহ বেদনা এনে দিয়েছে, এই শোক তাকে শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল করেছে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যেতে। সেই বেদনাকে সঙ্গী করে দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তিনি তার পিতার অসমাপ্ত কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন প্রবলভাবে। আজ তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্বদরবারে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ভবিষ্যতে তারই হাতে পিতা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন সফল হবে, ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়নের পর সুখী, সমৃদ্ধ ও উন্নত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে- এই বিশ্বাস আমাদের অনুপ্রাণিত করছে প্রতিনিয়ত।
লেখক : ভাইস-চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর