বিশ্বায়ন ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কারণে উচ্চতর শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য শিক্ষানীতিতে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তাদীপ্ত, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিক বোধসম্পন্ন জাতি গঠনে জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র তথা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রত্যয়টি সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যক্তির সম্পৃক্ততা ও সম্যক জীবনযাপনের গুণগত পরিমাণ দ্বারা পরিমাপযোগ্য। একটা জাতিকে বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে হলে মানবসম্পদকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তাই মানবসম্পদকে প্রকৃত সম্পদে পরিণত করতে হলে মানবের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, জ্ঞানগত ও পেশাগত দক্ষতা, কর্মসংস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উন্নতির প্রয়োজন।
জ্ঞান ব্যবস্থাপনা ও জ্ঞান পুনঃউৎপাদনের পাশাপাশি বর্তমান ও ভবিষ্যতের সমস্যাবলি, আন্তর্জাতিক মানের কারিগরি উৎকর্ষ, আধুনিক শিল্প ও বাজার ব্যবস্থাপনা জ্ঞান, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা, টেকসই সমাজ ব্যবস্থাপনার সমস্যাবলিকে শিক্ষা কারিকুলামের সঙ্গে সমন্বিতভাবে সংযুক্ত করতে হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় এনে এর বিভিন্ন ব্যবস্থাপনাকে কারিগরি অটোমেশনে ফেলে সেন্সিবল করতে পারলে বেশ কিছু মৌলিক উন্নতি আসবে। অভাবনীয় কারিগরি উৎকর্ষের যুগে বাংলাদেশের ইন্টেলেকচুয়াল, একাডেমিক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও রিসোর্স ডেপেলপমেন্টগুলো কেমন হবে, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবা উচিত। বাংলাদেশের বিজ্ঞান, প্রকৌশল প্রযুক্তি পড়ানো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চস্তরের প্রায়োগিক গণিত, প্রায়োগিক পরিসংখ্যান, কোডিং, রোবটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পড়ানোর ইনফ্রাস্ট্রাকচার যদিও রয়েছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রোবটিকস পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসেবে পড়ানো হচ্ছে। বহুবিধ ডোমেইনে উচ্চস্তরে ডেটা মাইনিং, ফলিত পরিসংখ্যান ও এআই কনটেন্ট আনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়েরই ডিজিটালাইড করে রূপান্তর করতে হবে। সরকার গণিত অলিম্পিয়াড, সায়েন্স অলিম্পিয়াড, আন্তর্জাতিক রোবট অলম্পিয়াডে গুরুত্ব দিচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে রূপান্তর করতে হবে যেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই আন্তর্জাতিক মানে বিষয়ভিত্তিক কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়েই শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করতে পারে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি ও কর্মসংস্থান বাজারের চাহিদার আলোকে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। একটি ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে সামগ্রিকভাবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সামগ্রিক প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব নয়, প্রয়োজন সামগ্রিক শিক্ষা রূপান্তর। উচ্চশিক্ষায় ২০৩০ পর্যন্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সফল অংশীদার হওয়ার সম্ভাবনার দিকগুলো যেমন আছে, একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জও আছে। সেগুলো মোকাবিলা করে নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। আর সেই প্রস্তুতের ক্ষেত্রটা হলো শিক্ষা। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে স্মার্ট বানাতে সরকার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃত শিক্ষাবিদ ও বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে শিক্ষা কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। সার্বিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পল জে মায়ার মানবসম্পদকে একটি দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে অভিহিত করেছেন। আর এই জনশক্তি তখনই দক্ষ মানসম্পদে রূপান্তরিত হবে, যখন তথা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসরণ করে পরিচালিত হবে। আমাদের বিপুল জনশক্তিকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে পারি, তাহলে আমরাও উন্নত বিশ্বের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারব। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার চতুর্থ হলো শিক্ষা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞান তৈরি ও বৈশ্বিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভাবনমূলক গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া। অর্থাৎ শুধু জ্ঞান অর্জন করলেই হবে না, একইসঙ্গে এর প্রায়োগিক ব্যবহারও জানতে হবে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একটি ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে রূপকল্প-২০২১, এসডিজি-২০৩০, রূপকল্প-২০৪১, ডেল্টাপ্ল্যান-২১০০। এরই আলোকে জাতীয় শিক্ষানীতিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে মিল রেখে উচ্চশিক্ষার কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। অবাধ বুদ্ধিচর্চা, মননশীলতা ও চিন্তার স্বাধীনতা বিকাশে সহায়তাদান হচ্ছে এর অন্যতম লক্ষ্য। উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে এ দেশের উদীয়মান বৈশ্বিক অর্থনীতি ও সমৃদ্ধি পূর্ব এশিয়া এবং নর্ডিক অঞ্চলের দেশসমূহে দৃশ্যমান। জাতির যে কোনো দুঃসময়ে জনকল্যাণকর ও যুগোপযোগী গবেষণার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে পথ দেখাতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। অবশ্যই তাদের কার্যকরভাবে বিশ্বমানের শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা জাগানো এবং নৈতিক ও মানবীয় গুণাবলি অর্জনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে হবে।
সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে পাঠদান পদ্ধতিতে দেশের সামসময়িক প্রেক্ষাপট উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত করা, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সমস্যা নিরূপণ ও সমাধানের উপায় বের করতে হবে। রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানের উপযোগী অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক, মানবমুখী, প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক ও দূরদর্শী নাগরিক সৃষ্টি করতেও কাজ করতে হবে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, সৃজন-মননশীলতা ও উদ্ভাবনী হতে জ্ঞানের নব নব ক্ষেত্র সৃষ্টি করার পাশাপাশি মেধার বিকাশ এবং সৃজনশীল নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবনেও সহযোগিতা করতে হবে।
২০৭১ সালে জাতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার একশত বছর উদ্যাপন করবে। শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রযুক্তির সমন্বয়ের ফলে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত ডিজিটাল সুবিধা পৌঁছে গেছে। ই-লানিং, মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ, আধুনিক বিশেষায়িত ল্যাব স্থাপন আমাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে শামিল হয়ে এগিয়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। শিক্ষার্থীদের বর্তমান বিশ্বের জন্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কয়েকটি ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করা উচিত। শ্রেণিকক্ষগুলো উন্নত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সর্বশেষ প্রযুক্তিতে সজ্জিত শ্রেণিকক্ষগুলোকে তারা যেন সঠিকভাবে ব্যবহার করতে শেখে এবং পারে সেদিকে খেলায় রাখতে হবে।
শিক্ষকদের অবশ্যই বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা প্রদানের ক্ষেত্রে নিজেদের আগে দক্ষ হতে হবে। পাঠ্যক্রমটি অবশ্যই পরিবর্তিত ও আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তিত করে নিতে হবে। এর মধ্যে অবশ্যই সময়োপযোগী এমন পাঠ্যসূচি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে প্রয়োজনীয় সমস্ত জ্ঞান, দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত থাকে। শিক্ষার সঙ্গে প্রশিক্ষণসহ শিল্প এবং শিক্ষার মধ্যে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে হবে। প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ আন্তর্জাতিক মননশীলতা ও মানসিকতায় প্রস্তুত করতে হবে। শিক্ষকদের নতুন নতুন বিষয় ও প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। মাল্টিডিসিপ্লিনারি এডুকেশন সেন্টার চালু করতে হবে। ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন করাসহ বাধ্যতামূলক ইন্ডাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট থাকতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে ওবিই (Outcome Based Education) পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্য বলেছে। চলমান শিক্ষাব্যবস্থায় যেখানে সিজিপিএকে মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু ঙইঊ শিক্ষাব্যবস্থায় একাডেমিক ফলাফলের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের দক্ষতার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটা সুনির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জনভিত্তিক শিক্ষা। এ প্রক্রিয়ায় সেমিস্টার শেষে একজন শিক্ষার্থী কী শিখল, তা পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ করাও সহজ। উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সকলে আন্তরিক হলে দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসার ও এর মানের উন্নয়ন হবে।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়