একজন সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক এবং বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য শামস রহমান ও ড. অশ্বিনী ইয়াদলাপাল্লী প্রণিধানযোগ্য এক গবেষণা প্রবন্ধ পেশ করেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় তাঁদের প্রবন্ধ প্রাসঙ্গিক বলে আমরা মনে করতে পারি। প্রথমত, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ২০০৯ সালে সরকার ক্ষমতা নেয়। গেল দুই দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি উৎসব করার মতো না হলেও নিঃসন্দেহে তা উল্লেখযোগ্য।
শুধু এটুকু বলাই বোধ করি যথেষ্ট যে অধ্যাপক এনামুল হকের হিসাবে, ২০০০ সালে মাত্র এক লাখ লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করত আর ২০২৩ সালে সংখ্যাটি হলো প্রায় সাত কোটি—মোট জনগণের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং বার্ষিক বৃদ্ধি বছরে ৩৮ শতাংশ হারে। অন্যান্য অবকাঠামোর অসামান্য উন্নয়নের কথা আপাতত থাক। দ্বিতীয়ত, বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সবার নজর কাড়া আরম্ভ করল। সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ শিকল এমনিতে মার্কেটিং জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তার পরও ডিজিটাল করে দক্ষতা বা মার্জিন বৃদ্ধির ওপর তেমন কোনো নির্ভরশীল গবেষণা অনুপস্থিত। সেই সূত্রে অধ্যাপক রহমান ও তাঁর সহগবেষক বাংলাদেশের বিদ্যমান অদক্ষ এবং কিছুটা বৈষম্য ও শোষণমূলক, সাপ্লাই চেইনকে ডিজিটাইজ করে সুবিধা নেওয়া যায় কি না, তা ভেবে দেখতে বলছেন।
দুই.
চলমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, বড় অর্থনীতিগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বিরোধ, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিঘ্ন এবং ভোক্তাদের পছন্দের দ্রুত পরিবর্তন—এসব সমষ্টিগতভাবে বৈশ্বিক সরবরাহ শিকলের জন্য একটি জটিল সমস্যা তৈরি করে। এই জটিল সমস্যা আবার পরিচালন দক্ষতা, সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন ডিজিটাল সাপ্লাই চেইনআর্থিক কর্মক্ষমতা এবং পরিবর্তনশীল বাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, বলা চলে ক্ষুণ্ন করে। একটি সমীক্ষায়, সমীক্ষা করা চার হাজার প্রধান নির্বাহীর মধ্যে প্রায় অর্ধেক নিশ্চিত করেছেন যে তাঁরা সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে তাঁদের সরবরাহ শিকল বা সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত বিধায় উদ্বিগ্ন, যখন ৭৮ শতাংশ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে জলবায়ুর ঝুঁকি আগামী ১২ মাসে তাদের সরবরাহ চেইনে প্রভাব ফেলবে।
পণ্যের বিকাশ, উৎপাদন এবং পণ্য বিতরণ থেকে ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং ঘরবন্দি প্রক্রিয়াগুলোর একটি দুর্বল সরবরাহ শিকলে পরিণত হয়েছে। অথচ একটি সম্পূর্ণ সমন্বিত সাপ্লাই চেইন, যা দৃশ্যমান, স্থিতিস্থাপক এবং চটপটে হবে—এমনটি সৃষ্টি করতে হলে ম্যানেজারদের আরো ব্যাপক ডিজিটাল পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
একটি ডিজিটালি রূপান্তরিত সাপ্লাই চেইন তার সদস্যদের মধ্যে রিয়াল টাইম দৃশ্যমানতা প্রদান করে, ম্যানেজারদের এমন ফাঁকগুলো শনাক্ত করতে দেয়, যা বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং তাদের সমাধান করতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা আক্রমণাত্মকভাবে তাদের সরবরাহ চেইনগুলোকে ডিজিটাইজ করে, সেই কম্পানিগুলো সুদ এবং করের আগে আয়ের বার্ষিক বৃদ্ধি গড়ে ৩.২ শতাংশ এবং বার্ষিক রাজস্ব বৃদ্ধি ২.৩ শতাংশ বৃদ্ধির আশা করতে পারে। তাই এটি প্রত্যাশিত যে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ কোনো এক প্রতিষ্ঠানের আইটি বাজেটের ক্রমবর্ধমান শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে।
বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যয় ২০২৭ সালে প্রায় চার ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে, যেখানে পাঁচ বছরের চক্রবৃদ্ধি বার্ষিক বৃদ্ধির হার হবে ১৬.১ শতাংশ।
ইন্টারন্যাশনাল ডাটা করপোরেশনের তথ্য অনুসারে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নগরায়ণের দিকে দ্রুত অবকাঠামোগত উন্নয়ন পণ্য এবং পরিষেবা উভয় ক্ষেত্রেই ডিজিটাল অফারগুলোর চাহিদাকে চালিত করছে। বাংলাদেশও ডিজিটাল টেকনোলজি (ডিটি) গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।
তিন.
শেখ হাসিনার সরকার ১২ ডিসেম্বর ২০০৮-এ ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের মাধ্যমে ডিজিটাল বিপ্লব ঘটানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি অনুপ্রেরণামূলক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তখন থেকে সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার সেক্টর ২০ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এবং রপ্তানি থেকে ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুধু তা-ই নয়, উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সরকার এখন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ : ২০৪১ সালের রাস্তা’ রূপকল্প অনুসরণ করছে। এই ভিশনের অধীনে সরকার ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণ করতে এবং জাতীয় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখতে ব্যাবসায়িক সাপ্লাই চেইন উৎসাহিত করছে। বাংলাদেশের কৌশলগত সার্বভৌমত্বের জন্য কৃষি, তৈরি পোশাক এবং অন্যান্য ওষুধের মতো শিল্পগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই শিল্পগুলোতে কিভাবে ডিটি গ্রহণ করা যেতে পারে, তা পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন শামস রহমান ও তাঁর সহগবেষক।
চার.
কৃষি, মৎস্য এবং বন বিষয়ে কিছু বলা যাক। বিবিএস বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য ও বনজ পণ্য বাংলাদেশের মোট জিডিপির প্রায় ১৩ শতাংশ এবং মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ নিযুক্ত করেছে। বর্তমানে কৃষকরা প্রধান প্রধান খাদ্য, যেমন—ধানের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে পারেন। যা হোক, স্মরণ রাখতে হবে যে আবাদযোগ্য জমি হ্রাস, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী না-ও হতে পারে। কারণ সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবেলা করার অনুশীলনের ফলাফল শুধু দীর্ঘ মেয়াদে দেখা যায়। তাই প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে নতুন জলবায়ু পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া একটি কার্যকর সমাধান। বাংলাদেশের উচিত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং কৃষিতে আইসিটি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়ে বিশ্বব্যাপী অভিযোজন প্রযুক্তিগুলোকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করা। তথ্য দ্বারা চালিত কৃষি সিদ্ধান্ত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করবে। যেমনÑ আকাশে স্যাটেলাইট এবং মাঠের সেন্সর মাটিতে পুষ্টি ও জল শনাক্ত করতে সক্ষম হবে এবং পুষ্টির ব্যবহার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।
পাঁচ.
আবার তৈরি পোশাক শিল্প হলো বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের উৎস। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় হয়েছে। যা হোক, শিল্পটি কর্মীদের নিরাপত্তা, কর্মদক্ষতা, ব্যবস্থাপনার অন্যায্য শ্রম অনুশীলন এবং এর পরিবেশগত পদচিহ্ন নিয়ে দেশে-বিদেশে নিয়মিত সমালোচনার সম্মুখীন হয়। তবে অত্যাধুনিক কম্পিউটার ভিশন টেকনোলজি পরিগ্রহণ করতে পারলে শ্রমিকদের গতিবিধি ট্র্যাক করতে এবং তাদের ক্রিয়াকলাপ বুঝতে সহায়তা পাওয়া যাবে। এভাবে রিয়াল টাইমে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। অপরদিকে ভিডিও স্ট্রিম বিশ্লেষণ করে এআই সিস্টেম সম্ভাব্য বিপজ্জনক আচরণগুলো শনাক্ত করতে সক্ষম হয়, যেমন—সঠিক নিরাপত্তা গিয়ার ছাড়াই যন্ত্রপাতি চালানো বা ভারী জিনিসগুলো ভুলভাবে উত্তোলন করা। এভাবে একটি নিরাপদ এবং আরো উৎপাদনশীল কাজের পরিবেশ তৈরি করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। অধিকন্তু ব্লক চেইন প্রযুক্তির প্রয়োগ পণ্যের উৎপত্তির বিবরণ, যে পরিস্থিতিতে সেগুলো উৎপাদিত হয় এবং একটি জটিল পোশাক সরবরাহ শিকলে পোশাকের কার্বন ফুটপ্রিন্ট খুঁজে বের করতে সক্ষম হবে।
ছয়.
এবার ওষুধশিল্পে প্রসারমাণ প্রযুক্তির প্রভাব বিবেচনা করা যাক। বাংলাদেশ একমাত্র স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি), যেটি প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ পণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে, যার হিসাবকৃত বাজারের আকার প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে ধরে নেওয়া হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশি ওষুধ পণ্য প্রায় দেড় শ দেশে রপ্তানি করা হয় এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৬৯ মিলিয়ন ডলার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তবে সমালোচনা এই যে বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের আশাব্যঞ্জক বৃদ্ধি ওষুধের ভেজালের কারণে মুখ থুবড়ে না পড়লেও অবশ্যই হুমকির মুখে পড়েছে। কিছু অনুমান দেখায় যে খোলাবাজারে যেকোনো সময় নকল ওষুধের প্রবাহ প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা হতে পারে, যা বিক্রি হওয়া সব ওষুধের ৩০ শতাংশ।
ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এবং ব্লক চেইন পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ, সেন্সিং ও রেকর্ডিং এবং মানব মিথস্ক্রিয়া ছাড়াই নেটওয়ার্কে সেই ডাটা স্থানান্তর করতে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে। এই প্রযুক্তিগুলো ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানিগুলোকে ল্যাব থেকে ভোক্তাদের পুরো যাত্রার সময় তাদের ওষুধ ট্র্যাক করতে সক্ষমতা অর্জন করবে। আবার একই প্রযুক্তি ওষুধের নিরাপত্তার উন্নতি ঘটাবে। কে কাকে কী কখন কোথায় সরবরাহ করে তার একটি যাচাইযোগ্য প্রমাণ নিশ্চিত করবে।
সাত.
তিনটি প্রধান শিল্প সেক্টরে স্পষ্টত প্রতীয়মান যে সফল সাপ্লাই চেইনের (ডিটি) জন্য সংস্থাগুলোকে সব সাপ্লাই চেইন সদস্যের মধ্যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত প্রযুক্তি স্থাপন করতে হবে। একটি সাম্প্রতিক ম্যাককিনসি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে গড় সরবরাহ শিকলের ৪৩ শতাংশ ডিজিটাইজেশন স্তরে রয়েছে। জরিপকৃত নির্বাহীদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ বলেছে যে সাপ্লাই চেইন তাদের ডিজিটাল কৌশলগুলোর কেন্দ্রবিন্দু।
আট.
সঠিক ডিজিটাল-বুদ্ধিসম্পন্ন নেতৃত্ব থাকা অতি জরুরি, যাঁরা তাঁদের ব্যবসার প্রয়োজনগুলো প্রাসঙ্গিক ডিজিটাল অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে রূপান্তরিত করতে পারেন; যাঁরা কর্মীদের নতুন প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা করতে উৎসাহিত করেন, তাঁরাই মূলত ডিজিটালভাবে রূপান্তরিত সাপ্লাই চেইনের চাবিকাঠি। এটির জন্য বিদ্যমান কর্মীদের উল্লেখযোগ্য পুনঃ স্কিলিং এবং স্নাতক ছাত্রদের মধ্যে দক্ষতা বিকাশের প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণকে সাপ্লাই চেইন পেশাদারদের মধ্যে দক্ষতা বিকাশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরই মধ্যে শীর্ষ শিল্প সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নতুন পাঠ্যক্রম ডিজাইন করা উচিত, যাতে সরবরাহ চেইন ডিজিটাইজেশনের দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকে।
তবে যে কথাটি অনেকটা উপেক্ষিত এবং গবেষকদের পর্যবেক্ষণে তা হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীর ছোবল থেকে উৎপাদক ও ভোক্তাকে রক্ষা এবং বাজারকে কার্টেল ও সিন্ডিকেটমুক্ত করার একমাত্র বিকল্প হচ্ছে ডিজিটাল সাপ্লাই চেইন- দ্য সুনার, দ্য বেটার। আর তার জন্য চাই অতীতের চেয়ে আরো বেশি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং প্রতিশ্রুতি।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়