জন মেইনার্ড কেইন্স নামে এক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, একমাত্র সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি গুণক ও লিঙ্কেজ সৃষ্টি করে ঝিমিয়ে পড়া বা বিয়ারিশ একটা অর্থনীতিকে ষাঁড়ের মতো দৌড়াতে সাহায্য করতে পারে, যাকে বলে বুলিশ প্রবণতা। সুতরাং কেইন্সীয় অর্থনীতি বলে, আর্থিক মন্দার সময় সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি একটা মোক্ষম দাওয়াই।
বস্তুত সেই দর্শনের ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, এমনকি কোভিড-পূর্ব বাংলাদেশে সম্প্রসারণমূলক বাজেটের মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল। তাতে বেশ সুফল ঘরে তুলে বাংলাদেশের তিলকে উন্নয়ন ধাঁধার তকমা জোটে। তবে দেশি ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন কার্যকারণেÑএর মধ্যে করোনা তো আছেই, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ব্যাপক পাল্টে যায়। আর তাই সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি এ মুহূর্তে আশীর্বাদ না হয়ে বরং অভিশাপ হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ঠিক এমনি একটা ক্রান্তিকালে জাতীয় সংসদে পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আয়ব্যয়ের খতিয়ান- বাজেট।
দুই.
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন কী ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ অব্যাহত আছে। তার মধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা ও আর্থিক খাতের নাজুকতা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে ধারণা। বর্তমান সরকার এবার ক্ষমতায় এসে সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব সূচকে নজর দিতে হবে ভেবেছিল তার অন্যতম মূল্যস্ফীতি। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, ব্যাংক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি ঋণ, রাজস্ব ইত্যাদি তো ছিলই। আরও আশ্বস্ত করেছিল, দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাদের সহ্যসীমা শূন্য (জিরো টলারেন্স)। অর্থাৎ কোনো ধরনের দুর্নীতি বরদাশত করা হবে না।
তবে পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। ব্যাপক এবং বিস্তৃত দুর্নীতি ও বিদেশে অবৈধ অর্থপাচার এবং অপেক্ষাকৃত কম রাজস্ব আয় অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছে। অন্যদিকে নানান ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতির পারদ কিছুতেই যেন নিচে নামছে না বরং ১০ শতাংশের আশপাশে ঘুরছে। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি বশীভূত। বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না শর্ষের ভেতর ভূতের জন্য না অন্য কারণে, সে এক মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো সমস্যা অন্যখানেও; তলানিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, টাকার মানে ধস ইত্যাদি। এসব সংকট সাপেক্ষে প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ বলছে বাংলাদেশের আর্থনীতিক প্রবৃদ্ধির হার অন্তত ২০২৩-২৪ বছরে ৬ শতাংশের নিচে থাকবে। ইতোমধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের হুমকি আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত করে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্তর আরও বাড়িয়ে দিলে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না। সুতরাং সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
তিন.
আর প্রায় এক মাস পর জাতীয় সংসদে পেশ হতে যাচ্ছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট। অর্থনীতির জন্য এমন একটা অস্বস্তিকর এবং পীড়াদায়ক পরিবেশে দেশের নতুন অর্থমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসান মাহমুদ আলী এমপি আসন্ন বাজেট পেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে হয়তো তিনি নতুন কিন্তু অর্থনীতির শিক্ষক, কূটনীতিক, সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্র ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক ভারী। আমরা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি, গেলবারের তুলনায় এবারের বাজেটের আকার প্রান্তিক কম হবে। অথচ করোনার আগ পর্যন্ত বাজেটের আকার অব্যাহত বাড়ছিল ১০-১২ শতাংশ হারে। মূলত দুটি কারণে আসছে বাজেটের আকার বড় করা উচিত নয়। প্রথমত, ব্যয় নির্বাহের জন্য অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের অবকাশ কম; দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতি বা বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সব ধরনের ব্যয় কমাতে হবে যখন ধরে নেওয়া হয় যে অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির অন্যতম শক্ত নিয়ামক। সন্দেহ নেই তাতে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাবে, অর্থনীতি তার তেজিভাব হারাবে। তবে আপাতত উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত মনে করছেন অর্থনীতিবিদ কিংবা অর্থনীতির পণ্ডিতরা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যের লাগাম টেনে ধরতে হলে আপাতত ব্যয় হ্রাসের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। আমরা আশা করব অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলবেন কেন অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলেও বাংলাদেশে তা অধরা থেকে যায়; বিশেষ করে আমরা জানতে আগ্রহী বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থা কেন যথাযথভাবে কাজ করছে না।
এখন কৃচ্ছ্রসাধনের যথাযথ সময়। ‘রাজনৈতিক প্রকল্প’, অপচয়ের প্রকল্প বাদ দিন, মেগাপ্রকল্প না হলেই নয় এমনটি নিন। সরকার যা রাজস্ব পায় তার প্রায় অর্ধেক নাকি খরচ হয় বেতনভাতায়। স্মল ইজ বিউটিফুল- সরকারের আকার ছোট রাখুন, বিলাসিতা পরিহার করুন। টাকা বাঁচানো মানে টাকা আয় করা। তবে যতটুকু অর্থের জোগান আছে তা দিয়ে আগামী বাজেটে আশা করব খাদ্য উৎপাদন, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষিতে ভর্তুকি এবং জ্বালানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হবে। সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ভর্তুকির সিংহভাগ অসাধু ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা চেটেপুটে খান বলে অভিযোগ আছে। সুতরাং পুরো ভর্তুকি প্রক্রিয়ার ফোকাসে পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি, যাতে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও দুর্বল প্রবেশগম্যতা পায়। আমরা কি এ বিষয়ে নতুন কিছু শুনতে পাব?
অনেক পুরোনো অপবাদ, এতদঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম। বাংলাদেশে নাকি ৯৭ লাখ মানুষ কর প্রদানের যোগ্য অথচ বর্তমানে কর দেয় মাত্র ৯ লাখ মানুষ; বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৫ হাজার ডলার এমন লোক এ দেশে প্রায় আড়াই কোটি। ড. ফরাসউদ্দিন মনে করেন, তাদের পর্যায়ক্রমে করের আওতায় আনা গেলে কর-জিডিপি অনুপাতের তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি সম্ভব। গবেষকরা বলছেন, করজাল বিস্তৃত করে ও আয়কর বাড়িয়ে পরোক্ষ করের চাপ কিছুটা হলেও লাঘব করা যায়। কয়েক দশক ধরে কর ও ব্যাংকিং খাত সংস্কারের কথা শুনে আসছি। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি মন্থর কেন তা জানার অধিকার জনগণের আছে। কতগুলো মন্দ ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? যেখানে গ্রেশামস ল কাজ করে অর্থাৎ মন্দটা বাজার থেকে বিতাড়িত করে ভালোটাকে?
রিজার্ভের সমস্যা কাটাতে অবশ্যই বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। এত পদক্ষেপ নেওয়ার পরও কেন বাংলাদেশ ভিয়েতনাম, ভারত এমনকি মিয়ানমারের চেয়ে অনেক কম এফডিআই আকর্ষণ করে সে বিষয়ে চিন্তার অবকাশ আছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন একটি সূত্র ধরে বলছেন এবং জাতিসংঘও তাতে একমত যে, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার পাচার হয়। তার মানে ৭ বিলিয়ন ডলার যা মোট প্রায় চার মাসের রেমিট্যান্স আয়ের সমান। তা ছাড়া ‘বেগমপাড়া, সেকেন্ড হোম’ ইত্যাকার বিষয়ে দুর্বলকণ্ঠ বক্তৃতা-বিবৃতির বদলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। একজন সাবেক মন্ত্রীর বিদেশে ২৫০টি বাড়ির মালিকানা এবং ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং রিজার্ভের ১ শতাংশ দেশান্তরিত হওয়ার যে খবর ব্লুমবার্গ দিয়েছে, তার সঙ্গে অন্যান্য মুদ্রা পাচার, করমুক্ত দ্বীপরাষ্ট্রে সম্পদের নোঙর করা বৈদেশিক মুদ্রা ফিরিয়ে আনতে পারলে রিজার্ভ শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা। অর্থমন্ত্রী কি বিষয়গুলো ভেবে দেখবেন এবং পথ দেখাবেন?
চার.
এমনিতে জনগণ প্রকৃতিদত্ত তাপদাহে নাকাল। তার মধ্যে আবার বাজারসৃষ্ট তাপদাহে অবস্থা অনেকটাই নাজুক। আগামী বাজেটে প্রধান বিবেচনা হওয়া উচিত মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা। কারণটি অজানা নয় কারও। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘খাদ্যনিরাপত্তা’সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাবারের ক্রমবর্ধমান দাম দেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশে এখন মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মানলে, খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা ২ কোটি ৯০ লাখের বেশি পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয়।
পাঁচ.
সুশাসন নিশ্চিত করে দুর্নীতি দূরীকরণ ও আর্থসামাজিক বৈষম্য হ্রাসে বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার আছে বলে দেশের প্রতিটি মানুষ প্রত্যাশা করে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় আমরা তার প্রতিফলন প্রত্যাশা করি। চোখ ধাঁধানো ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দ্রুতবর্ধনশীল দুর্নীতি ও বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এযাবৎকালের সব অর্জন বিসর্জন দিতে হতে পারে। সেই লক্ষ্যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি সাপেক্ষে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি দমন ও আর্থসামাজিক বৈষম্য হ্রাসে জাতির কাছে অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকার জন্য একটানা পঞ্চমবারের মতো রেকর্ডধারী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আরও কঠোর হতে হবে। এবারের বাজেটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ ও ফলাফল সম্পর্কিত বক্তব্য এবং বৈষম্য হ্রাসে সরকারি পদক্ষেপের বিবরণী চাই। বাজারপ্রদত্ত তাপদাহ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার যথাযথ নীতিমালা চাই।
পাদটীকা :
একবার আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে মস্কো গেলেন। কী আলাপ হয়েছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রিমাকভ বললেন, তিনি আশা করেছিলেন মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার ব্রিফকেস ভর্তি করে ডলার নিয়ে এসেছেন; তিনি আসলে ব্রিফকেস ভর্তি করে নিয়ে এসেছেন শর্তের কাগজপত্র। সেদিন আর নেই। এখন আইএমএফ যেখানেই যায়, ব্রিফকেস ভর্তি করে ডলার ও শর্ত দুটোই নিয়ে যায়। পরিস্থিতি বুঝে সবাই বদলাতে পারে, আমরা কেন পারব না? আল্লাহ সবাইকে সুমতি দিন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়