ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘এসএমই নীতিমালা ২০১৯-এর সংষ্কার: প্রেক্ষিত টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উদ্ভাবন’ শীর্ষক মতবিনিময় সভা আজ ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা চেম্বার সভাপতি আশরাফ আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের এসএমই উদ্যোক্তারা কর্মসংস্থান সুযোগ তৈরি করছেন ঠিকই, তবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সংযোজনে এখাতের ভূমিকা এখনও আশানূরূপ নয়, এক্ষেত্রে অর্থায়ন প্রাপ্তির জটিলতা, দক্ষতার অভাব, রাজস্ব নীতিমালা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে থাকার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে দেশের তরুণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠার কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে বিশেষকরে সেবাখাতের বিকাশ একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
ডিসিসিআই সভাপতি আরো বলেন, সিএমএসএমই খাতের সার্বিক উন্নয়নে ‘কুটির, ক্ষুদ্র, মাঝারী’ উদ্যোক্তাদের সংজ্ঞায় একান্ত অপরিহার্য, সেই সাথে সরকারের অন্যান্য নীতিমালাসমূহেও সেই সংজ্ঞার অনুসরণ করা আবশ্যক। এছাড়াও তিনি ব্যবসায়িক কাজে সম্পৃক্ত সকল ধরনের লাইসেন্স প্রদান ও নাবায়ন প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল কার্যক্রমের আওতায় আনায়ন, রাজস্ব কাঠামোর সংষ্কার, শুল্ক ব্যবস্থাপনার সহজীকরণ, লজিস্টিক অবকাঠামোর উন্নয়ন, অর্থায়ন প্রক্রিয়া সহজীকরণ, এসএমইদের বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়াতে দক্ষতা বাড়ানো ও পণ্যের বহুমুখীকরণের উপর জোরারোপ করেন।
এসএমই নীতিমালার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পাশাপাশি শিল্পনীতির সাথে সমন্বেয় মাধ্যমে শিল্পখাতের ভবিষ্যতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে বলে ঢাকা চেম্বার সভাপতি মত প্রকাশ করেন। সেই সাথে বিভিন্ন সংস্থাগুলোর বাজেট এবং কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন কার্যক্রমে এসএমই নীতিমালার লক্ষ্যমাত্রা সম্পৃক্ত থাকার উপর তিনি জোরারোপ করেন।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নীতি, আইন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা) মোঃ সলিম উল্লাহ, রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)-এর পরিচালক (দক্ষতা ও প্রযুক্তি) কাজী মাহবুবুর রশিদ, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি’র নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াকুব হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (এসএমই এন্ড স্পেশাল পোগ্রাম্স ডিপার্টমেন্ট) নওশাদ মোস্তফা, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর সহকারী অধ্যাপক ড. মোঃ মোশাররফ হোসেন, জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ (নাসিব)-এর সভাপতি মির্জা নূরুল গণী শোভন, এসএমই ফাউন্ডেশনের জেনারেল ম্যানেজার মোঃ নাজিম হাসান সাত্তার, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ কায়েস হামিদ, ঢাকা ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ মাহবুবুর রহমান পলাশ এবং লংকাবাংলা ফাইন্যান্স-এর এভিপি খন্দকার মোস্তাক হোসেন প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ সলিম উল্লাহ জানান, আন্তর্জাতিক মানের একটি এসএমই নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে এবং আশা প্রকাশ করেন, এখাতের সাবির্ক বিকাশের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে একটি কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে।
ইপিবি-এর ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, এসএমইদের উন্নয়নে নীতিমালা থাকলেও, সেটি বাস্তবায়নে ইপিবি-এর মত অন্যান্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরগুলোর অংশগ্রহণ একান্ত অপরিহার্য, কারণ মন্ত্রণালয় নীতি প্রণয়ন করলেও মূলত অধিদপ্তরসমূহ পাঠ পর্যায়ে সেগুলোর বাস্তবায়ন করে থাকে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে ইপিবি কাজ করছে এবং এক্ষেত্রে এসএমইদের আরো বেশি হারে সম্পৃক্ত করতে হবে।
তিনি জানান, ইপিবি-এর পক্ষ হতে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন (সিও)’ সার্টিফিকেশন অনলাইনে দেওয়ার লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে, আমদানি-রপ্তানি সহ অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য আমাদের সামগ্রিক রাজস্ব কাঠমো বেশ জটিল বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন এবং ইপিবি-এর পক্ষ থেকে এ প্রক্রিয়া সহজীকরণে উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।
বিসিকের পরিচালক কাজী মাহবুবুর রশিদ, দেশে উদ্যোক্তা উন্নয়নে সরকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয় একান্ত অপরিহার্য। এসএমইদের উন্নয়নে এসএমই ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি বিসিককে আরো শক্তিশালী করার উপর তিনি জোরারোপ করেন।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি’র নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াকুব হোসেন জানান, ‘মাইক্রোক্রেডিট ফাইন্যান্সিং ইন্সটিটিউট’ গুলোর মাধ্যমে দেশের মোট এসএমই’র ৭০ শতাংশই ঋণ পেয়ে থাকে, যার ৯০ভাগই নারী উদ্যোক্তা। ঋণ প্রদান প্রক্রিয়ার সহজীকরণের পাশাপাশি দূর্নীতি হ্রাসে তিনি অটোমেশন কার্যক্রম বাস্তবায়নের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (এসএমই এন্ড স্পেশাল পোগ্রাম্স ডিপার্টমেন্ট) নওশাদ মোস্তফা বলেন, এসএমই নীতিমালা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থাসমূহের কার্যপরিধি সুনিদিষ্ট করা আবশ্যক। সেই সাথে কুটির ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিকাশের লক্ষ্যে একটি ‘কমন প্ল্যাটফর্ম সেন্টার’ স্থাপনেরও তিনি প্রস্তাব করেন পাশাপাশি দেশে পরিচালিত ‘টেকন্যিাল’ এবং ‘ভোকেশনাল’ শিক্ষা কার্যক্রমের আধুনিকায়ন করা একান্ত আবশ্যক বলে মত প্রকাশ করেন।
বিআইবিএম-এর সহকারী অধ্যাপক ড. মোঃ মোশাররফ হোসেন এখাতের উদ্যোক্তাদের সার্বিক উন্নয়নে ‘এসএমই ইনোভেশন ল্যাব’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন, যার মাধ্যমে নতুন পণ্য উদ্ভাবন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও উদ্ভাবিত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ সহজতর হবে। এছাড়াও তিনি সরকারি ব্যবস্থাপনায় ‘সীড ফান্ড’, ‘স্টার্ট-আপ ফান্ড’ এবং ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটাল’ কার্যক্রম প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন।
নাসিব-এর সভাপতি মির্জা নূরুল গণী শোভন বলেন, শুধুমাত্র নীতিমালা প্রণয়ন করলেই হবে না, এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে হবে। সেই সাথে তিনি আসন্ন এসএমই নীতিমালায় ‘আরবিট্রেশন’ ব্যবস্থা অন্তভূক্ত করার প্রস্তাব করেন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের জেনারেল ম্যানেজার মোঃ নাজিম হাসান সাত্তার বলেন, আমাদের এসএমই নীতিমালা থাকলেও সেটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা আশানুরূপ ভাবে পাওয়া যায়নি, ফলে পাঠ পর্যায়ে কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি। সেই সাথে এ নীতি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যকার সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে বলে, তিনি মত প্রকাশ করেন।
এ খাতের উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতকল্পে সার্বিক ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত সংষ্কারের উপর তিনি জোরারোপ করেন। এছাড়াও তিনি রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের সম্ভাবনাময় কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, হালকা-প্রকৌশল, পাট এবং চমড়া শিল্পে সম্পৃক্ত উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নের সরকারকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ কায়েস হামিদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রদত্ত ‘ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কীম’-এর কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন, যার মাধ্যমে এখতের উদ্যোক্তাদের আর্থায়ন আরো সহজতর হবে। পাশাপাশি ঋণ প্রদান প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল কার্যক্রমের গ্রহণযোগ্যতা সম্প্রসারণেরও তিনি প্রস্তাব করেন।
ঢাকা ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মোঃ মাহবুবুর রহমান পলাশ বলেন, এসএমইদের অর্থায়নে প্রয়োজনীয় ফান্ড থাকলেও সংজ্ঞায় এবং প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাগজপত্রের অভাবে ঋণ প্রদান করা যাচ্ছে না। দেশের রপ্তানিতে এসএমইদের অবদান বাড়াতে এখাতের উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
লংকাবাংলা ফাইন্যান্স-এর এভিপি খন্দকার মোস্তাক হোসেন ঋণ প্রদানে সম্পৃক্ত সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে এসএমই উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্তকরণ বাড়ানো প্রয়োজন, সেই সাথে এখাতে খেলাপী ঋণ হ্রাস করা গেলেও অন্যান্য এসএমইদের জন্য ঋণ সহায়তা আরো সহজতর হবে।
মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী অংশগ্রহণ করেন।
ডিসিসিআই সহ-সভাপতি মোঃ জুনায়েদ ইবনে আলী সহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।