ভয়াবহ রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার হিমালয় কন্যা নেপাল। টানা দুই দিনের ব্যাপক অস্থিরতায় মঙ্গলবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
সরকার একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মে নিষেধাজ্ঞা জারি করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর জেন-জি প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা রাস্তায় নেমে গতকাল সকাল থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন। বিক্ষোভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ২০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সামাজিক যোগাযোগামাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা দেশজুড়ে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রের অতিরিক্ত ক্ষমতার বিরুদ্ধে এক আন্দোলনের জন্ম দেয়; যা শেষ পর্যন্ত অলি সরকারের পতন ডেকে এনেছে।
দেশটির ক্ষমতাসীন জোট সরকারকে ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে এই সঙ্কট। কয়েকজন মন্ত্রী ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন এবং বড় রাজনৈতিক দলগুলোও সমর্থন প্রত্যাহারের কথা ভাবছে। গত ৪৮ ঘণ্টার বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ তরুণ নেপালিদের মনে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে আবারও এই হিমালয় রাষ্ট্রে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
যেভাবে ‘জেন জি’ আন্দোলনের সূত্রপাত
নেপালের ক্ষমতাসীন জোট সরকার গত সপ্তাহে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব কোম্পানি সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধন করেনি এবং ভুয়া তথ্য প্রচার ও অনলাইন প্রতারণার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছিল।
সমালোচকরা বলেছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। দেশটির সুশীল সমাজ ও বিরোধী নেতারা অভিযোগ করে বলেছেন, সরকারের এ পদক্ষেপ দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অভিজাতদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের সমালোচনা ঠেকাতে নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ভিন্নমত দমনের কৌশল হিসেবে সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ দেখা গেছে তরুণ নেপালিদের মধ্যে। তাদের কাছে রাজনৈতিক অসন্তোষ প্রকাশ, আন্দোলন সংগঠিত করা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার প্রকাশের প্রধান মাধ্যম ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। দেশটির অনেক তরুণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের পরিবার ও সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের চিত্র তুলে ধরছিলেন।
তারা এমন এক সময়ে সরকারের আমলা ও রাজনীতিকদের মুখোশ উন্মোচন করছিলেন, যখন দেশটিতে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী; যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী এবং তরুণ পেশাজীবী কাঠমান্ডুতে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাদের এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় জেন-জি আন্দোলন। যা পরে মুহূর্তের মধ্যে দাবানলের মতো দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
বিক্ষোভকারীদের হাতে ‘দুর্নীতি বন্ধ করো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়’, ‘তরুণরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে’সহ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। এতে তরুণদের এই আন্দোলন যে নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষোভকে যুক্ত করেছে, তা পরিষ্কার।
বিক্ষোভ যেভাবে সহিংসতায় রূপ নেয়
কাঠমান্ডুর বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও পরবর্তীতে দ্রুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবন ঘিরে ফেলেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান। সংঘর্ষের মাঝে কিছু বিক্ষোভকারী সোমবার দেশটির সংসদ ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন।
এ সময় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা কাঁদানে গ্যাস, জলকামান এবং পরে সরাসরি গুলি চালান। গতকাল রাত পর্যন্ত দেশটিতে সহিংতায় অন্তত ২০ জন নিহত এবং ২৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন বলে সরকারি পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে। মঙ্গলবার বিক্ষোভের সময় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে আরও একজন নিহত হয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, সংসদ ভবন এলাকায় ভয়াবহ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল এবং পুলিশ ওই এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হিমশিম খাচ্ছিল। দিনভর এই সহিংসতা কেবল রাজধানীতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পোখারা, বুটওয়াল, ভৈরাহাওয়া, ভরতপুর, ইতাহারি এবং দামাকের মতো বিভিন্ন শহরে।
বিক্ষোভকারীরা কাঠমান্ডুর আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও সরকারে সংস্কারের আহ্বান জানান। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৩০ মিনিট থেকে কাঠমান্ডুতে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারির ঘোষণা দেন। পরে ললিতপুর এবং ভক্তপুর জেলাতেও একই ধরনের বিধিনিষেধ জারি করা হয়।
সুনির্দিষ্ট স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ
বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবনের কিছু অংশে আগুন ধরিয়ে দেন এবং শীর্ষ নেতাদের বাড়িঘরে একযোগে হামলা চালান। হামলার নিশানায় ছিল প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাউডেল, নেপালি কংগ্রেস নেতা শের বাহাদুর দেউবা ও মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দহলের বাসভবন। এছাড়া দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরজু দেউবা রানার মালিকানাধীন একটি বেসরকারি স্কুলে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা।
অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, স্কুলটি জ্বলছে এবং বিক্ষোভকারীরা উল্লাস করছেন। মঙ্গলবার সকাল থেকেই দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছিলেন।
পরিস্থিতির ভয়াবহতায় নেপালের সামরিক বাহিনীর ১২টি উড়োজাহাজে করে মন্ত্রীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৫টি উড়োজাহাজ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের সরিয়ে নেওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিল।
প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগ
পরিস্থিতি শান্ত করতে শেষ চেষ্টা হিসেবে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি। তিনি বিক্ষোভকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, যেকোনও ধরনের সহিংসতা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। আমাদের অবশ্যই শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে। তিনি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সর্বদলীয় বৈঠকের ডাক দেন, কিন্তু পর্দার আড়ালে ক্রমবর্ধমান চাপের মাঝে পড়ে যান অলি।
নেপাল সেনাবাহিনীর একাধিক সূত্র বলেছে, মঙ্গলবার সকালের দিকে অলি সেনাপ্রধান আশোক রাজ সিগদেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামরিক সহায়তা চান তিনি। সিগদেল বলেন, তিনি (অলি) যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন, তখনই সামরিক বাহিনী কেবল পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে পারে।
কেপি শর্মা অলি শেষ পর্যন্ত পদত্যাগে রাজি হন এবং প্রেসিডেন্ট পাউডেলের কাছে আনুষ্ঠানিক পদত্যাগপত্র জমা দেন। এর মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে নেপালে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর কেপি শর্মা অলির চতুর্থ মেয়াদের অবসান ঘটে।