রাজধানীর পুরান ঢাকার সদরঘাট এরিয়ায় বইপাড়া হিসেবে খ্যাত বাংলাবাজার ঢুকে কয়েক কদম পা সামনে ফেললেই শ্রীশদাস লেন। হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটির আঙিনায় প্রবেশ করার পর যে কোনো মানুষ বিমোহিত হয়ে যাবে এর সৌন্দর্যে।
গত শতকের ৫০-৬০ এর দশকে শিল্প-সাহিত্য জগতের মানুষদের বিশাল এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল বিউটি বোর্ডিং। তবে কালের বিবর্তনে আধুনিকতার উত্থানে বোডিংটি অনেক পিছিয়ে পড়ছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে নানামুখী সংকট।
শুরুটা হয়েছে পঞ্চাশের দশকে। দুই ভাই নলিনী মোহন সাহা ও প্রহ্লাদ সাহা মিলে তৈরি করেন বিউটি বোর্ডিং। বিউটি ছিল নলিনী বাবুর মেয়ের নাম। থাকার জন্য ২৫টি ঘর আর দুপুর, বিকেল ও রাতের খাবারের বন্দোবস্ত নিয়ে শুরু হয় এর পথচলা।
বিউটি বোর্ডিংয়ের একটি তালিকা থেকে দেখা যায়: শামসুর রাহমান, শহিদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক ছাড়াও এখানে নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতেন হাসান হাফিজুর রহমান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী, কবি আল মাহমুদ, রণেশ দাসগুপ্ত, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমদ ছফা, হায়াৎ মামুদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বেলাল চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সন্তোষ গুপ্ত, ফজল শাহাবুদ্দিন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শফিক রেহমান, আসাদ চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সাঁতারু ব্রজেন দাস, কিংবদন্তি কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ও লেখক জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, ভাস্কর নিতুন কুণ্ডু, নায়করাজ রাজ্জাক, টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানী, সঙ্গীতজ্ঞ সত্য সাহা, অভিনেতা প্রবীর মিত্র, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, কমরেড আব্দুল মতিন, অলি আহাদদের মতো রাজনীতির তরুণ প্রতিভাদেরও পদার্পণ ঘটেছে এখানে।
তখনকার সময়ে বইয়ের জগতটা ছিল বাংলাবাজারেই। শহরও ছিল এদিকেই। গুলিস্তান, ওয়ারী, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার আর পুরান ঢাকার এলাকাগুলো নিয়েই ছিল ঢাকা শহর।
বাংলাবাজারের একদম কাছে হওয়ায় শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয় বিউটি বোর্ডিং। নলিনী বাবুর আড্ডা তেমন পছন্দ না হলেও প্রহ্লাদ বাবুর সমর্থন ছিল আড্ডার প্রতি। ফলে বিউটি বোর্ডিং প্রতিদিন মুখরিত হতো কবি সাহিত্যিকদের পদচারণায়। সে সময় থেকেই তাদের সরিষা ইলিশ, বেগুন ভাজির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ঢাকায়। তবে খাবারের চেয়েও বড় ব্যাপার ছিল আড্ডাটাই।
খাবারের ধরন সম্পর্কে কথা হলে দেখভালের দায়িত্বে থাকা সমর সাহা জানান, প্রতিদিন ২৫ রকমের খাবার পাওয়া যায়। প্রতিদিন টাটকা বাজার করে রান্না এখানেই করা হয়। যে খাবার খাবেন, সেটার প্রকৃত স্বাদ পাবেন। আর এখনও প্রতি শুক্রবার আশপাশ ও দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন।
পুরোনো আড্ডার আমেজটা পাওয়া যায়। তবে এখন সবকিছুর দাম বাড়ায় তাদেরও দাম বাড়াতে হয়েছে। বছর দুয়েক আগেও সরিষা ইলিশ ছিল ২০০ টাকা পিস। এখন সেটি ৪০০ টাকা। রুই মাছের কালিয়া ১৫০ টাকা থেকে হয়েছে ৩০০ টাকা। দাম বাড়লেও মাছের টাটকা স্বাদ পাওয়া যাবে বলে জানান সমর সাহা।
তাছাড়া ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ, মুরগি, সবজি, মুড়িঘণ্ট, বেগুন ভাজি, আমড়ার চাটনি নিয়মিত থাকে। এর বাইরে শুক্তো, চইয়ের পায়েস, আইড় মাছ, খাসির মাংসও বিভিন্ন দিন রান্না হয়।
বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থা পরিচালক জানান, আমি প্রায় ৫০ বছর থেকে এখানে দায়িত্ব পালন করে আসছি। বিউটি বোর্ডিং রেস্টুরেন্ট ব্যবসার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি খুব ভালোভাবেই চলছিল। প্রতিনিয়ত ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। বর্তমানে ব্যাপক আর্থিক সংকট।
তিনি আরো জানান, পর্যাপ্ত পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করতে পারায় বর্তমান তরুণ প্রজন্মেরও নেই আগ্রহ। তাছাড়া ব্যবসায়িক লোকজন অর্থাৎ যারা এখানে এসে থাকতেন- তারা এখন ঘরে বসেই তাদের জিনিসপত্র পেয়ে যাচ্ছেন। তাদের ঢাকায় কষ্ট করে আসতে হয় না। তাছাড়া যানজটে কারণেও মানুষের ঢাকা যাত্রা অনেকটা কম। আগে তো এতকিছু ছিল না। মানুষ আসতো এখানে থাকতো। তখন ভালোই চলতো। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা বিউটি বোর্ডিং এতটা আধুনিক করতে পারিনি।
ঘুরতে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসদিক হাসান বলেন,পুরান ঢাকার একটি বড় ঐতিহ্য হচ্ছে এই বিউটি বোর্ডিং। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও সময়ের অভাবে আসা হয়নি। শুনেছি এখানের ইলিশের স্বাদ নাকি অনেক ভালো।
যেহেতু এখানকার ইলিশের স্বাদ নেওয়া হয়নি তাই সময় করে চলেই আসলাম। তাছাড়া মুরগি, ডাল, ভর্তা, বড়া পাঁচ তরকারি দিয়ে খেলাম। এদের রান্নাগুলোয় পাঁচফোড়নের ব্যবহার আছে। সবজি, ডালে এজন্য আলাদা একটা নিজস্ব স্বাদ তৈরি হয়েছে।