শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। আর জাতিকে শিক্ষিত করে তুলতে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই প্রাথমিক শিক্ষার ভিত মজবুত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। কারণ, প্রাথমিক শিক্ষা মূলত দেশের সার্বিক শিক্ষার ভিতকেই মজবুত করে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ন্যায় একই যোগ্যতা (স্নাতক), একই কারিকুলাম, একই সিলেবাস ও একই শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করা পিটিআই- সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড দশম (দ্বিতীয় শ্রেণি) আর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১৩তম (তৃতীয় শ্রেণি)। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের প্রতি কেন এ বিমাতাসুলভ আচরণ? কেন অন্য ডিপার্টমেন্ট ও প্রাথমিকের সহকারীদের মধ্যে গ্রেডের পার্থক্য থাকবে? সূর্যের আলোয় সবার যেমন সমান অধিকার, তেমনি বেতন গ্রেডের অধিকারও সবার জন্য সমান হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। এটা অত্যন্ত লজ্জার কথা। তাদের গ্রেড-১৩। আর প্রধান শিক্ষকদের গ্রেড-১১। সেক্ষেত্রে একজন মাধ্যমিকের প্রধান শিক্ষকের গ্রেডের সঙ্গে প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের গ্রেডে বিস্তর ব্যবধান এমনকি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকদের থেকেও! এসব শিক্ষক অনার্স-মাস্টার্স যোগ্যতাসম্পন্ন এবং একই পেশায় যদি কেউ সরকারি মাধ্যমিকে চাকরি করেন তাহলে তার থেকেও মূল্যায়ন অনেক কম করা হয় প্রাথমিকের শিক্ষককে। কারণ সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। নির্বাচনের সময় যখন দায়িত্ব প্রদান করা হয় তখন একজন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক দুই যুগ অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ হওয়া সত্ত্বেও পোলিং অফিসার এবং একজন মাধ্যমিকের শিক্ষক কয়েক বছর চাকরি করে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। এখানেও বৈষম্য! শিক্ষা বিভাগে চাকরি করে এবং একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় কেন বেতন গ্রেড আলাদা হবে সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন হতে পারে বা উন্নত কোনো দেশে প্রাথমিকের শিক্ষকদের এই গ্রেডে বেতন দেওয়া হয় কি না, সেটাও বিবেচনা করা দরকার। সুতরাং সবার আগে বেতন গ্রেড বৈষম্য দূর করতে হবে। প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যন্ত শিক্ষকতা পেশায় যারাই সেবা দিতে আসবেন, তারা যেন একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় একই বেতন পান সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। গ্রেড বৈষম্য দূর না হওয়ায় চরম অসন্তুষ্ট শিক্ষকরা।
শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, এ অবস্থা চললে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে না। সত্যি কথা হলো- গত কয়েক বছরে প্রাথমিকে বহু মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষক হিসেবে এসেছেন। কিন্তু তাদের অনেককেই ধরে রাখা যায়নি। এর কারণ মেধাবীদের ধরে রাখার মতো একটি বেতন কাঠামো, পদোন্নতির সম্ভাবনা এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় তারা অন্য চাকরিতে চলে গেছেন। পদোন্নতি একটি চাকরিতে কাঙ্ক্ষিত বিষয়। প্রত্যেকেই চায় তার যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় পর পদোন্নতি পেতে। অথচ প্রাথমিকে যেন পদোন্নতি একটি দুরাশামাত্র। চাকরিকাল শেষের দিকেও পদোন্নতি বঞ্চিত প্রাথমিকের অসংখ্য শিক্ষক।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্র অনুযায়ী, ১৫ বছরেও পদোন্নতি পাননি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষক। সত্যি কথা হলো- গত কয়েক বছরে প্রাথমিকে বহু মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষক হিসেবে এসেছেন। কিন্তু তাদের অনেককেই ধরে রাখা যায়নি। এর কারণ মেধাবীদের ধরে রাখার মতো একটি বেতন কাঠামো, পদোন্নতির সম্ভাবনা এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় তারা অন্য চাকরিতে চলে গেছেন। অথচ মেধাবীদেরও এই খাতে সবচেয়ে বেশি দরকার। একজন শিক্ষক সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তার যোগ্যতা অনুযায়ী এবং ডিপার্টমেন্টের নিয়ম মেনে তার ওপরের পদে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। এটা যদি সফট হয় তাহলেই মেধাবীরা আশান্বিত হন। কিন্তু বাস্তব ভিন্ন। সুতরাং একজন সহকারী শিক্ষক যেন সহকারী শিক্ষা অফিসার এবং ন্যূনতম শিক্ষা অফিসার পর্যন্তও যেতে পারে সেই পথটুকু সফট করা প্রয়োজন। অতীতে এ ধরনের উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও বহু বছর এ থেকে বঞ্চিত রয়েছেন শিক্ষকরা। ফলে দিন দিন হতাশা বাড়ছে, যা শিক্ষার মান কমার পেছনে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ।প্রাথমিক শিক্ষকদের রয়েছে চূড়ান্ত রকমের বেতন বৈষম্য। একজন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ষষ্ঠ গ্রেড পেলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মর্যাদার দিক দিয়ে এবং বেতন কাঠামোর দিক দিয়ে অনেক বৈষম্যের শিকার। অথচ এক একজন প্রাথমিক শিক্ষক প্রতিদিন ৭-৮ টি ক্লাস নিয়ে থাকেন। বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা কম তাদের। বেতন স্কেলেও রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। মেধাবীদের প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে পেতে হলে ১০ম গ্রেডের বিকল্প নাই। আমরা আশাবাদী প্রাথমিকে গ্রেড বৈষম্য দূর হবে এবং আলো আসবেই। জয় হোক মানবতার, জয় হোক মানুষ গড়ার কারিগরদের। বৈষম্য দূরীকরণে প্রত্যয় নিয়ে কাজ করছেন অন্তবর্তীকালীন সরকার। শিক্ষকদের চাওয়া যৌক্তিক। তাদের যৌক্তিক প্রত্যাশা পূরণসহ প্রাথমিক শিক্ষার দীর্ঘ সময়ের বিরাজমান বৈষম্য দূর করার প্রত্যাশা রইল।
লেখক : সোহাইল মিয়া
সাবেক সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।