দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রেশ কাটতে না কাটতেই উপজেলা নির্বাচন এখন চায়ের কাপে ঝড় তুলছে। গুরুত্বে না হলেও সংখ্যায় সংসদ নির্বাচনের চেয়েও বড় উপজেলা নির্বাচন। তাই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক এবং বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। সংসদ নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্বাচনের কৌশল নির্ধারণে আলাপ আলোচনা করছে।
বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকেই এই নির্বাচনকে ঘিরে নতুন কৌশলের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তাই এখন চারদিকে একটি প্রশ্নÑ সবার অংশগ্রহণে উপজেলা নির্বাচনে ভোট উৎসবের রঙটা কতটুকু গাঢ় হবে?
দেশে ৪৯৫ টি উপজেলা পরিষদ রয়েছে। আগামী ৯ মার্চ সাধারণ ও উপনির্বাচন মিলিয়ে ২৩৩টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাকিগুলোতে পর্যায়ক্রমে হবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে প্রার্থীদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের স্বার্থে দলীয় প্রতীক না থাকাই ভালো। কারণ, দলীয় প্রতীক না থাকলে সবারই ভোটে অংশ নিয়ে যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগে ভোটে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। আগে উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন দলীয় প্রতীক ছিলো না। তবে স্থানীয় সরকার উপজেলা সংশোধন বিল-২০১৫ এ বলা হয়েছে, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও দুটি ভাইস চেয়ারম্যান পদের নির্বাচনের জন্য প্রার্থীকে রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হবে। ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আইন সংশোধনের পর ২০১৭ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ভোট হয়। তারপর থেকে সকল স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দলীয় প্রতীকেই হচ্ছে। তবে ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যদিও বিএনপি ওই আইনের বিরোধীতা করলেও রাজনৈতিক কৌশলের কারণে তার পক্ষে ছিল আওয়ামী লীগ।
এবার আবার নির্বাচনি কৌশল হিসেবে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে দলীয় প্রতীক নৌকা ছাড়াই অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। যার যার মতো করে স্বতন্ত্রভাবে দলের নেতারা নির্বাচন করতে পারবেন। যেকোনো প্রার্থীর পক্ষে ভোট করতে পারবেন। নতুন এই কৌশলের কারণ মূলত গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলের রাজনীতিতে বিভাজন ঠেকানো এবং দলের কর্মীদের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষা, ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো এবং জনপ্রিয় প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।
কোনো রাজনৈতিক দল দলীয় প্রতীক ছাড়া নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে সংশ্লিষ্ট উপজেলার ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনযুক্ত তালিকা জমা দিতে হবে। আর যদি কেউ এর আগে উপজেলা চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়ে থাকেন। তাহলে তাদের ভোটারের সমর্থনযুক্ত প্রমাণ জমা দিতে হবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে সাধারণত স্থানীয় জনগণ অংশগ্রহণ করে থাকেন। সেখানে দলীয় প্রতীক গৌণ। বিএনপিজোট যেহেতু বারবারই বলেছে, তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। তাই আওয়ামী লীগের কৌশল হচ্ছে নির্বাচন উন্মুক্ত করে অংশগ্রহণমূলক করা। অতীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেও বিএনপি বিভিন্ন সময় উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করেছিল। সাধারণত নির্বাচনবিমুখ দল রাজনীতিতে হারিয়ে যায়।তাই এবার উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি না গেলে যে ভুল করবে তা কাটিয়ে ওঠা তাদের জন্য কঠিন হবে। যদিও এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হঠাৎ পাল্টানো বিএনপির জন্য কঠিন। তবে এই ক্ষেত্রে বিএনপি হয়তো তাদের সমর্থকদের নিরুৎসাহিত করতে পারে, কিন্তু বাধা দিবে না কিংবা বহিষ্কার করবে না। মার্কা না থাকায় বিএনপির অনেকে প্রার্থী হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে সব কূল রক্ষা হয়। এ ক্ষেত্রে তারা দলীয়ভাবে না গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে প্রার্থীদেও অনানুষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতা করবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করে।
সাধারণ মানুষ চায় দেশের প্রতিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উৎসবমুখর পরিবেশে হোক। জনগণ সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট প্রদান করুক এবং ফলাফলে জনমতের যথার্থ প্রতিফলন ঘটুক। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যাত্রা শুরু হোক। বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক শক্তিকেই এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও বিএনপি নির্বাচন প্রক্রিয়ার ত্রুটি ও দুর্বলতা নিয়ে তাদের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে পারত। কিন্তু বিএনপি এখানো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘মৃতহস্তি’কে আবার জাগানোর দাবিতে মগ্ন হয়ে আছে। এ দাবিতে সাধারণ মানুষের জীবন যাবে, সম্পদ ধ্বংস হবে, অর্থনীতি পিছিয়ে পড়বে। কেউ চায় না আবার সেই তিমিরেই ফিরে যেতে। এ আশঙ্কার স্থায়ী অবসান হওয়া প্রয়োজন। বস্তুত বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা এবং সহযোগিতা ব্যতীত আগামী দিনগুলো কারো জন্যই স্বস্তির হবে না, সুখের তো নয়ই।
স্থানীয় সরকারের নির্দলীয় এই নির্বাচনকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ আছে। বিএনপির মতো নির্বাচনমুখী দলের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে পারলো না, এখন তারাই যদি আবার নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি বলে শোরগোল করে, তাহলে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? আপনি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশও নেবেন না আবার সাংবিধানিক পন্থায় নির্বাচন ঠেকানোর মত আন্দোলনও করতে পারবেন না; তাহলে নেতাকর্মীরা কিসের আশায় দিনের পর দিন রাজনীতি করবেন। অসাংবিধানিক পন্থায় দ্বাদশ নির্বাচনকে প্রতিরোধ করতে না পারার ব্যর্থতা বিএনপির সামর্থ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে যে ভুল করেছিল দলটি তা বর্তমান অবস্থানে প্রতীয়মান হচ্ছে। ফলে এর থেকে উত্তরণ এবং স্থানীয় নেতা-কর্মীদেরকে চাঙ্গা করতে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি নিঃসন্দেহে প্রজ্ঞার পরিচয় দিবে।
নির্বাচন একটা উৎসব। কিন্তু বড় দলগুলোর ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অনেকদিন ধরেই সে উৎসবটা হারিয়ে গেছে। জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে গুরুত্ব কম হলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে উৎসব-আগ্রহটা বেশি। সব প্রার্থী নিজ নিজ স্বার্থে ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে সচেষ্ট থাকেন। আর নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে ভোটাররা এমনিতেই উৎসাহী থাকেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হল স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়, প্রভাবশালী অরাজনৈতিক ব্যক্তিরাও নির্বাচনে অংশ নিবেন এবং তাদের অনেকে নির্বাচিতও হবেন। এভাবে শিক্ষক, আইনজীবী, সমাজকর্মীদের স্থানীয় সরকারে অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও ভোটারÑ সবার দায়িত্ব হলো নির্বাচনে উৎসবের রংটা ফিরিয়ে আনা। সকল দলের অংশগ্রহণে আগামী উপজেলা নির্বাচন দিয়েই আবারও দেশে নির্বাচনি উৎসবের রঙ লাগুক, ভোটাররা স্বতস্ফূর্তভাবে কেন্দ্রে এসে তাদের প্রতিনিধি বাছাই করার স্বাধীনতা উপভোগ করুক।
লেখক : সদস্য, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ