রবিবার ৬ জুলাই ২০২৫ ২২ আষাঢ় ১৪৩২
রবিবার ৬ জুলাই ২০২৫
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধিতে করণীয়
ড. এ কে এম মাহমুদুল হক
প্রকাশ: শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৪:১৩ PM
প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি নিরাপত্তার মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্বেগের পাশাপাশি ইদানীং জনসাধারণের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিদ্যুতের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

ফলে, শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুদিবভ্রাটে জনজীবন অনেকটাই অস্বস্তি ও বিপর্যয়কর অবস্থার সম্মুখীন। বর্তমানে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১ হাজার ১৯৪ দশমিক ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, যা মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের মাত্র ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্যমতে, গরমকালে সাধারণত ১৬ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও এবার সেটি সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে চলে যেতে পারে। বিপুল পরিমাণ এই বিদ্যুতের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রগুলো থেকে।

শঙ্কার কথা হলো যে, আমরা এখনো বিদ্যুৎ উৎপাদনে ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানিতেই বেশির ভাগ নির্ভর করছি। কিন্তু জলবায়ু ও সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে হলে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি নয়, বরং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিতে হবে। অবকাঠামোগত দিক থেকে বাংলাদেশের ক্রমোন্নতি ও অর্থনীতির অগ্রসরমাণতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের অবকাশ না থাকলেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের জলবায়ু সংকট আছে। আর তার সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক ব্যবস্থায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে আমাদের প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে, যার অনিবার্য পরিণাম হিসেবে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আশা জাগানিয়া বিষয় হলো যে, সম্প্রতি নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা এগোচ্ছে। বাংলাদেশের কক্সবাজার, মোংলা ও গাইবান্ধাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব আমাদের দেশেও পড়েছেÑ এটি অস্বীকার করা হবে সত্যের অপলাপ। এখন আমরা যদি বাইরের দেশের ওপর নির্ভর না করে জ্বালানি সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হই, সে দৃষ্টিকোণ থেকেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি একটা ভালো উপায়। প্রসঙ্গত, জলবায়ু সংকটের বিষয়টিও এখন কমবেশি সবাই টের পাচ্ছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামে দুই বার বিশ্বনেতা হিসেবে কাজ করেছেন। আর বাংলাদেশের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুসারে কার্বন নিঃসারণ কমানোরও লক্ষ্য রয়েছে। বাংলাদেশ যদি সোলার এনার্জিতে বিনিয়োগ করে, তাহলে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় সম্ভব। আমাদের বর্তমান সরকারও বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে এবং মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনাতে ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রস্তাব পাশ হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবেই বর্তমান সরকারের ‘ঘরে ঘরে শতভাগ বিদ্যুৎ’ কর্মসূচির কথা চলে আসে। এ ব্যাপারে বলা যায় যে, আমরা যখন বিদ্যুতের চাহিদা ও ঘাটতি পূরণে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেব এবং নিজেদের উৎস তথা নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারব, তখনই বাস্তবিক অর্থে শতভাগ বিদ্যুৎ কিংবা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হব।

ভূতাপ, সৌরশক্তি, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, সমুদ্রের ঢেউ, সমুদ্রতাপ, জোয়ারভাটা, বায়োগ্যাস, বায়ু ফুয়েল প্রভৃতি জ্বালানির উৎস হিসেবে পরিচিত। এসব উৎসকে কাজে লাগিয়ে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি অনায়াসেই। সচরাচর যে শক্তির উৎস নিঃশেষ হয়ে যায় না এবং অল্প সময়ের মধ্যেই পুনরায় ব্যবহার করা যায়, সেটিই নবায়নযোগ্য জ্বালানি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। আর এতে করে খনিজ জ্বালানির ওপরে চাপ কমে আসছে উল্লেখযোগ্য হারে। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকার দৈর্ঘ্য প্রায় ৭২৪ কিলোমিটার যেখানে সব সময় বায়ুপ্রবাহ থাকে। আর এই বায়ুপ্রবাহকে ব্যবহার করে ২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতিসংঘ-ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন কর্মসূচির ৭ম অভীষ্টে সবার জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য, টেকসই ও আধুনিক জ্বালানি সহজলভ্য করার কথা বলা হয়েছে। উক্ত অভীষ্টের ৭.খ লক্ষ্যমাত্রায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশ, উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রও স্থলবেষ্টিত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের নিজস্ব সহায়ক কর্মসূচি অনুযায়ী সবার জন্য আধুনিক ও টেকসই জ্বালানি সেবা সরবরাহকল্পে জ্বালানি অবকাঠামোর বিস্তারসহ প্রযুক্তির উন্নতি সাধনের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন ‘কপ ২৮’-এ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করার ব্যাপারেও আহ্বান জানানো হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ রাজা চার্লস বলেন, ‘পৃথিবী আমাদের নয়, আমরা পৃথিবীর অন্তর্গত। আমাদের নিজেদের বেঁচে থাকার সামর্থ্য বিপন্ন হবে, যদি না আমরা প্রকৃতির অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করি।’

প্রকৃতপক্ষে আমরা সবাই প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানির সুরক্ষিত ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হতে চাই। ১৯৯৬ সালে সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচি। এ পর্যন্ত প্রায় ৬ মিলিয়ন সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (ইডকল)-এর মাধ্যমে সরকার কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত কর্মসূচির কারণে এর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বছর ২০ লাখের মতো তরুণ চাকরির বাজারে ঢুকছেন। এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে গুরুত্ব দেওয়া হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক একটি শিল্প গড়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে তরুণদের এ শিল্পের বিভিন্ন শাখায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আবার যারা কারিগরি বোর্ড থেকে পাশ করেছেন, তাদের জন্যও চাকরির সুযোগ হবে।

এছাড়াও এনার্জি ট্রানজিশনে চাকরিরতদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা একটি কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগসমূহের মধ্যেও পারস্পরিক সমন্বয় হওয়া দরকার। লক্ষণীয় যে, আমাদের দেশে পলিসির আধিক্য রয়েছে আর এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় জটিলতার কথা বিবেচনাপূর্বক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে। পারিপার্শ্বিক অন্যান্য সমস্যাসমূহের সমাধানকল্পে প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় বাড়ানো, সুশাসন নিশ্চিতকরণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপরও জোর দিতে হবে। বাংলাদেশ শুধু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নয়, বরং সোলার সিস্টেমেও রোল মডেল এবং আমাদের প্রচুর অকৃষিজমিও রয়েছে সোলার বিদ্যুতের জন্য। শুধু সোলার নয়, বায়ু এবং পানি-বিদ্যুতের মাধ্যমেও বাংলাদেশে এনার্জি ট্রানজিশনের বা জ্বালানিব্যবস্থা রূপান্তরের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে জ্বালানিব্যবস্থা রূপান্তরের বিষয়টিকে ‘ন্যায্যতার ভিত্তিতে’ বাস্তবায়নেরও চিন্তা করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়




« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত