মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতা এবং দেশটিতে চলমান গৃহযুদ্ধ সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। জান্তা বাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষের তীব্রতা ইতিমধ্যেই এই অঞ্চলটিকে একটি বিপজ্জনক অঞ্চলে পরিণত করেছে যার বৃহত্তর প্রভাব চীন এবং ভারতের মতো বৃহত্তর দেশগুলোর উপরেও পড়ছে।
‘অপারেশন ১০২৭’-এর অধীনে গত বছরের অক্টোবরের শুরু থেকে আরাকান আর্মি এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলো বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী মায়ানমারের শহরগুলো একের পর এক দখল করে নিয়েছে। এটি চলমান গৃহযুদ্ধের একটি নতুন মাত্রা, যা ২০২১ সালে জান্তাবিরোধী বিদ্রোহের একটি অংশ হিসেবে শুরু হয়েছিল। মিয়ানমারে সংঘাতের প্রাণঘাতী মর্টারশেল এখন বাংলাদেশের ভূখণ্ডেও পড়েছে এবং বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছে। এতে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর প্রত্যাবাসন নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ঢাকা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে দুইজন বাংলাদেশি নাগরিক নিহতের তীব্র নিন্দা করে পরিস্থিতিটিকে ‘সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং ক্রমবর্ধমান সীমান্ত সহিংসতার প্রতিবাদে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে মিয়ানমার-সীমান্তবর্তী এলাকায় নজরদারি ও নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দ্রুত পদক্ষেপের জন্য যদিও এখন পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের কোনো খবর পাওয়া যায়নি, তবে মিয়ানমারের সীমান্ত ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় ৩২৭ সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশের খবরে সীমান্ত এলাকায় একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করেছে। বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় ও চিকিৎসা দিয়ে আবারও ভাল প্রতিবেশীসূলভ আচরণ (Good
Neighborhood Attitude) প্রদর্শন করলেও রাখাইন সহিংসতার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে। বিজিবি পালিয়ে আসা জান্তা নিরাপত্তা কর্মীদের নিরস্ত্র করেছে এবং মিয়ানমারে তাদের দ্রুত প্রত্যাবর্তনের জন্য যোগাযোগের চ্যানেল স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সীমান্ত ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সতর্কতার সাথে এগিয়েছে, কারণ ঢাকা মিয়ানমারের সংঘাতে কোনো পক্ষ নিতে চায় না। এটি নিঃসন্দেহে একটি যথাযথ পদক্ষেপ।
মায়ানমার সীমান্তে যে কোনো সংঘাত বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং ভূ-রাজনীতিতে বহুমুখী প্রভাব ফেলবে। সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য মায়ানমার জান্তার উপর প্রভাব বিস্তারকারী, চীনের সহযোগিতা চেয়ে বাংলাদেশ সঠিক কাজটি করেছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যাতে বাংলাদেশে প্রভাব না ফেলে তা নিশ্চিত করতে ঢাকা প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ভারত সফরে সেদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠকে মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এসময় উভয় দেশ আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে একযোগে কাজ করতে রাজি হয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রথম দিকে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় প্রদানে বাংলাদেশকে জোরালো সমর্থন করেছিল। তবে তাদের ভরণপোষণের জন্য বিগত কয়েক বছর ধরে দাতা দেশগুলোর প্রতিশ্রুত অর্থ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা বাংলাদেশের উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে। এটি স্পষ্ট যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা সঙ্কটকে এখন আর তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাই, বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। মিয়ানমার সীমান্তে কয়েকশত চাকমা এবং রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য জড়ো হয়েছে-এমন খবরের প্রেক্ষাপটে ঢাকা আর কোনো শরণার্থী গ্রহণ না করার সঠিক নীতি গ্রহণ করেছে।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে এবং তাদের নাগরিকত্ব প্রদানে দেশটির সামরিক বাহিনী (যাকে স্থানীয় ভাষায় তাতমাডও বলা হয়) বার বার অনীহা বিবেচনায় নিয়ে কেউ কেউ বলেন যে আরাকান আর্মি রাখাইনের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কিছুটা সহজ হতে পারে। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের মুসলিম বাসিন্দাদের (রোহিঙ্গা) নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনের অংশ হিসেবে রাখাইনে থাকা সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনেকেই এই ঘোষণায় আস্থা রাখতে পারছে না। তাদের দাবি, রাখাইনে আরাকানি জাতিগত সংখ্যালঘুরা রোহিঙ্গাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাবাসনকে আরও জটিল করে তুলবে। রাখাইনে একটি স্থিতিশীল প্রশাসনের অনুপস্থিতির কারণে বাংলাদেশের সাথে প্রতিশ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তিটি সম্পন্ন করা নেইপিদোর পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠবে। এছাড়া গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত এলাকায় শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার পথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাধা সৃষ্টি করবে বলেও বড় আশঙ্কা রয়েছে। এসব ফ্যাক্টর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে।
ভারতও রাখাইন সংঘাতকে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যুদ্ধ তীব্র হওয়ায় সদ্য আরাকান-অধিকৃত শহরগুলো থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীর সংখ্যাও গত কয়েক মাসে বেড়েছে। নতুন শরণার্থীদের মধ্যে সীমান্তবর্তী শহরের স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি ৪১৬ জন পরাজিত বার্মিজ সৈন্যও ছিলো। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যদিও কূটনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে সব জান্তা সৈন্যকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে, তবে নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা চিন্তা করে কেন্দ্রীয় সরকার মিয়ানমার সীমান্তে দেওয়াল তৈরি এবং মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য সীমান্তে ভিসা-মুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা প্রত্যাহার করার কথা বিবেচনা করছে। একটি স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আরাকান আর্মিতে বর্তমানে ৩০ হাজারেও বেশি সৈন্য রয়েছে। কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ) আরাকান আর্মিকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিল। শুধু তাই নয়, ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে, ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সশস্ত্র সংগঠনগুলোর একটি বড় অংশকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল কেআইএ। অতীতে ভারত ও মিয়ানমার জান্তা সরকার এই ধরনের জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যৌথ সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এ কারণেই মিয়ানমারের রাখাইন ও চিন প্রদেশে আরাকান আর্মি এবং তার মিত্রদের সাম্প্রতিক সামরিক সাফল্য সীমান্তবর্তী এলাকায় সশস্ত্র বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে, যা স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
তাছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করতে ভারত রাখাইনে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। আরাকান আর্মির বিজয় ভারতীয় বিনিয়োগকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতিতে পালেতওয়া এবং সিটওয়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে শক্তিশালী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্কের ভিত্তিতে ভারত এই শহর দুটিকে কেন্দ্র করে ৩,২০০ কোটি রুপি দিয়ে কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (KMTTP) বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটি শিলিগুড়ি করিডোরের উপর ভারতের নির্ভরতা কমাবে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিকে বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করবে। সুতরাং, আরাকান আর্মি চিন রাজ্যের পালেতোয়া এবং সিত্তওয়ের কাছে পাউকতাওয়ে দখল করার খবর ভারতের এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাখাইনের কার্যকর সরকারী কাঠামো এবং বেসামরিক শৃঙ্খলার অভাব এই অঞ্চলের মানবিক, নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইস্যুতে উদ্বেগের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস হয়ে থাকবে। রাখাইনে একটি অস্থিতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতি শুধু নতুন অভিবাসন উদ্বেগই বাড়ায় না, বরং ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি করে। এই প্রেক্ষাপট থেকেই আন্তঃসীমান্ত নিরাপত্তায় ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার প্রয়োজন। উভয় দেশের উচিত পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক জোরদার করা।
চীনও রাখাইনে তার বিনিয়োগ নিয়ে একই ধরনের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। তাই, রাখাইনে উত্তেজনা কমানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় আলোচনার আয়োজন করতে পারে। নিরাপত্তা সমস্যা নিয়ে কথা বলার এবং আগামী দিনের জন্য কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার এখনই একটি ভাল মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণ না করে ক্রমবর্ধমান হতে দিলে, নিঃসন্দেহে এটি ভবিষ্যতে মিয়ানমারের সমস্ত প্রতিবেশীদের জন্য অস্থিতিশীলতা এবং গুরুতর জাতীয় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের কারণ হবে।
লেখক : কৌশলগত নিরাপত্তা বিশ্লেষক