বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫ ২৬ আষাঢ় ১৪৩২
বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা
মাহবুবা নাসরীন
প্রকাশ: সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪, ৩:৪২ PM
জেন্ডার সংবেদী ও আন্তঃশ্রেণিবৈষম্য সম্পর্কিত নীতি ও চর্চা সহনশীলতার লক্ষ্যে যোগাযোগ ও অংশীদারিত্ব ‘জেন্ডার রেসপন্সিভ রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড ইন্টারসেকশনালিটি ইন পলিসি অ্যান্ড প্র্যাকটিস : নেটওয়ার্কিং প্লাস পার্টনারিং ফর রেজিলিয়েন্স’ বা ‘গ্রিপ’ শীর্ষক প্রকল্পের দক্ষিণ এশিয়ায় চার বছর শেষ হতে চলল।

এ পর্যায়ে এসে প্রকল্পটিতে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার অংশগ্রহণকারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের বার্তা ও কর্মপ্রচেষ্টার বিবরণ একটি কৌশলগত কাঠামোর মাধ্যমে তুলে ধরা প্রয়োজন। বাংলাদেশে জেন্ডারবৈষম্য রোধ, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও আন্তঃশ্রেণি বৈষম্যবিষয়ক একটি কৌশলগত কাঠামো তৈরির লক্ষ্যে দুর্যোগ ঝুঁকির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিভিন্ন লৈঙ্গিক গোষ্ঠী এবং পরস্পর সম্পর্কিত শ্রেণিগুলোর দুর্বলতা ও সক্ষমতা চিহ্নিতকরণের ধারণাগুলো সংযুক্ত করাও প্রয়োজন।

ইউকে আরআই গ্লোবাল চ্যালেঞ্জেস রিসার্চ ফান্ডের (জিসিআরএফ) অর্থায়নে ও ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের (ইউসিএল) ব্যবস্থাপনাধীন গ্রিপের উদ্যোগে ক্যারিবিয়ান ও দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অঞ্চলগুলোতে প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মূল লক্ষ্য ছিল সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জেন্ডার সংবেদী দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়; গ্রিপ দক্ষিণ এশিয়ার সহায়তায় পরিচালিত গবেষণা প্রকল্পগুলোর ফল হিসেবে পাওয়া নানা প্রতিবেদন, বিভিন্ন দেশের অংশীদারদের পরামর্শ, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে আয়োজিত সেমিনার, গোলটেবিল আলোচনা, কর্মশালা এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘গ্রিপ দক্ষিণ এশিয়া সেমিনার-২০২৩’ শীর্ষক সেমিনারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হাতে তুলে দেওয়া সম্পর্কিত খসড়া কৌশলপত্র প্রণয়ন।


যাবতীয় আলোচনার সারবস্তু হচ্ছে, গ্রিপের মাধ্যমে যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পরস্পরের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে, তাদের একটি প্ল্যাটফর্মের আওতায় এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের (আইডিএমভিএস) উদ্যোগে একটি সাংগঠনিক রূপ দেওয়া। 

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে প্রকল্পটির নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বাস্তবায়ন করতে পারায় আমি ও দক্ষিণ এশিয়ার গবেষক দল কৃতজ্ঞ। এই কৌশলপত্র সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালায় নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত ও শ্রীলঙ্কার গবেষকদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

দক্ষিণ এশিয়ার জেন্ডার সমতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ইন্টারসেকশনাল নীতিমালায় প্রকল্পের প্রথম ধাপে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, মানবিক সহায়তা কার্যক্রম এবং ইন্টারসেকশনালিটির ওপর মাস্টার্স শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি একটি সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম চালু করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে বাংলাদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক উচ্চশিক্ষার পাঠক্রমে জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং ইন্টারসেকশনালিটির ওপর জোর দেওয়া হয়। জাতীয় পর্যায়ে একটি ও স্থানীয় পর্যায়ে (বিশ্ববিদ্যালয়ে) চারটি কর্মশালার মাধ্যমে এগুলো সম্পন্ন করা হয়।

বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিগরি ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষাক্রমে জেন্ডারবিষয়ক নীতি সংযোজন করার উদ্দেশ্যে একটি মডিউল প্রণয়ন করা হয়। এ ছাড়া নেপালে কৌশলের কার্যকারিতা প্রমাণ করার পাশাপাশি জ্ঞানের পারস্পরিক বিনিময় নিশ্চিত করার জন্য একটি কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছে। এ কর্মশালার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পাঠক্রমে জেন্ডার ইন্টারসেকশনালিটি, সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ দৃষ্টিভঙ্গিবিষয়ক জটিল আলোচনাকে সহজতর করতে সক্ষম হয়।

এ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য নারী অধিকার ও তাদের সামগ্রিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। নারী ও শিশুর অধিকার সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ বিষয়ে প্রকল্পভুক্ত এলাকার বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সচেতনতামূলক বার্তাসহ চিত্রসংবলিত রঙিন বিলবোর্ড স্থাপন ও এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অধিকার লঙ্ঘন নিরসন। এটি মূলত প্রকল্প এলাকায় নারী ও পুরুষের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, একই সঙ্গে নারী ও শিশুদের জন্য নির্ধারিত আইনি অধিকার এবং তাদের প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা প্রতিরোধের ওপর দৃষ্টিপাত করে; যা তিন দিনব্যাপী দীর্ঘ প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়।

এ ছাড়া প্রকল্পের কার্যক্রমগুলোর অন্যতম লক্ষ্য ছিল শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে নির্যাতনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অভিভাবকদের অবহিত এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এ লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে গ্রাম্য নেতাদের সম্পৃক্ততায় ‘নির্যাতন ও সহিংসতার ক্ষেত্রে নারী ও শিশুর অধিকার’বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি প্রকল্প দল ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে বৈঠকের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত যাবতীয় শিক্ষা উপকরণ স্থানীয় শিক্ষকদের মধ্যে সরবরাহের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও আয়োজন করা হয়। পরিশেষে প্রকল্পভুক্ত এলাকায় অবস্থিত উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লিফলেট, পোস্টার ও বিলবোর্ড ব্যবহার করে তাদের মানবাধিকার এবং এর লঙ্ঘন সম্পর্কে অবহিত করার প্রচেষ্টা করা হয়।

স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় প্রতিবন্ধী নারী, পুরুষ, বালিকা ও বালকদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ, অন্তর্ভুক্তি এবং নেতৃত্ব নিশ্চিত করার জন্য ‘ঢাকা ঘোষণা ২০১৫+’-এ সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছিল। সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে সরকার, উন্নয়ন সংস্থা, জাতিসংঘ, এনজিও সংস্থা, সিবিও, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন, পেশাদার, সক্রিয় নাগরিক, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি খাত এবং অন্যান্য মূল স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ উদ্দেশ্য অর্জন করতে হবে। যাতে তারা একসঙ্গে কাজ ও অন্তর্ভুক্তির কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারে। প্রায়োগিক স্তরে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যুক্ত থাকা এবং অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ নামক একটি তাত্ত্বিক মডেল প্রস্তুত করার জন্য এ কর্মপ্রকল্পের নকশা তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল, একটি জনকেন্দ্রিক পন্থা নিশ্চিত করে যে কোনো ধরনের ভবিষ্যৎ কর্মসূচিতে জেন্ডার সহনশীলতা নীতি ও ইন্টারসেকশনালিটিকে একীভূত করা।

এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের পটভূমি বিশ্লেষণ করা এবং বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে বিভিন্ন নীতিকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, তা পর্যালোচনা করা। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার ও কমিউনিটি এবং দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে তাদের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ছিল প্রকল্পটির অন্যতম লক্ষ্য।

এ ছাড়া গবেষণাটিতে কভিড-১৯ অতিমারি চলাকালীন বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘন দুর্যোগ মোকাবিলার পাশাপাশি অতিমারির বিস্তার ঠেকাতে কীভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা বিশ্লেষণ করেছে। গবেষণাটি কভিড-১৯ মহামারি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সাফল্য ও সীমাবদ্ধতাও নির্ণয় করেছে।

কভিড-১৯ অতিমারি বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলার পাশাপাশি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ, যার জনসংখ্যা ১৬৫ মিলিয়নের বেশি। ইন্টারসেকশনালিটি দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে এই গবেষণার লক্ষ্য ছিল কভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন বাংলাদেশে মাতৃস্বাস্থ্য পরিষেবার স্থিতিস্থাপকতা মূল্যায়ন করা। গবেষণাটি অতিমারি চলাকালীন দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোয় মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবায় পর্যাপ্ত অভিগম্যতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর কৌশলগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। গবেষণাটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে গবেষকরা মিশ্র পদ্ধতি ব্যবহার করে সাতক্ষীরা জেলার দুটি দুর্যোগপ্রবণ উপজেলার (আশাশুনি ও শ্যামনগর) প্রতিক্রিয়াদাতাদের কাছ থেকে পরিমাণগত এবং গুণগত তথ্য সংগ্রহ করেছেন।

গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, মাতৃস্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সীমিত অভিগম্যতার কারণ হলো, বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো, মাতৃস্বাস্থ্য বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্যসেবাকর্মী ও সেবাদাতাদের জেন্ডারভিত্তিক ঝুঁকি শনাক্ত না করা। গবেষণাটিতে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বাস্তবায়নযোগ্য ও প্রয়োজনীয় কৌশল এবং কার্যকর নীতিও চিহ্নিত করা হয়েছে।

লেখক : প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (শিক্ষা), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়; সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত