বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫ ২৬ আষাঢ় ১৪৩২
বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫
বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভাবনা
ড. মো. নাছিম আখতার
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০২৪, ১১:২৯ AM
বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হওয়ার পূর্বশর্ত হলো- শিক্ষানুরাগী হওয়া। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ছিলেন মন ও মননে একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। শৈশব ও কৈশোরে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে হাজারও চড়াই-উতরাই, বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। বাস্তবিক অর্থে চিন্তার গভীরতা, স্বচ্ছতা যার আছে তিনি পৃথিবীটাকে দেখেন তার দীপ্ত মানসচক্ষে।

কালো অক্ষরের জাদুতে লিপিবদ্ধ করেন তার চিন্তার পৃথিবীটাকে। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা তার একটি প্রবন্ধে লিখেছেন ‘মাঝে মধ্যে আমার মনে হয়, আমার বাবা যদি রাজনীতি না করে শুধু লেখালেখি করতেন, তাহলে হয়তো সেরা লেখকদের সারিতে স্থান করে নিতেন। এত সুন্দর, সহজ-সরল, সাবলীল তাঁর ভাষা, যার তুলনা হয় না’।

দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পায় মুক্তির স্বাদ। কিন্তু বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক মুক্তিই শেষ কথা ছিল না। নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত জাতিকে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য দরকার ছিল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তিসহ আরও অনেককিছু। বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাজগুলোর সূচনা করে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার চিন্তা ছিল সুনিপুণ। তিনি সবসময় শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে ভেবেছেন। তার ভাবনার মধ্যে ছিল মৌলিকত্ব, ছিল নতুনত্ব, ছিল বিচক্ষণতা, ছিল সৃষ্টিশীলতা, ছিল দেশের মেধাচর্চাকে এগিয়ে নেওয়ার ব্রত, ছিল দেশের মানুষকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রকৃত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে শিক্ষিত করার কৌশল।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ নামক ছোট্ট ভূখণ্ডে ৭ কোটি মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, কর্ম নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা- বিশেষ করে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পৃথিবীতে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশের উন্নতির কারণ হলো বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই তারা অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। বঙ্গবন্ধু বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন অনেক আগেই। তাই স্বাধীনতার পর তিনি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেন। সে লক্ষ্যে তিনি ১৯৭২ সালে ২৬ জুলাই একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। যার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদা।

বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানমুখী করতে হলে এমন একজন ব্যক্তিকে কমিশন প্রধান করতে হবে, যিনি হবেন প্রথিতযশা বিজ্ঞানী, শিক্ষানুরাগী এবং একই সঙ্গে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কাজে দক্ষ। ড. কুদরত-ই-খুদাকে বেছে নেওয়ার পেছনে বঙ্গবন্ধুর মনে বিজ্ঞানের ভাবনাটি যে প্রবল ছিল তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। তৎকালীন সময়ে বিশ্বে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্যোগী করতে জাতির পিতার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভ করে। শুধু তাই নয়- ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে টেলিকমিউনিকেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপন সহজ হয়।

বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করেছিলেন কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তিকে প্রাধান্য না দিলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর খাবার জোগান কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তখন থেকেই তিনি কৃষি গবেষণার উন্নয়নে জোর দেন। ধান গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতির পিতা ১৯৭৩ সালে আইন পাসের মাধ্যমে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। বঙ্গবন্ধুর সরকারের গবেষণাবান্ধব পরিবেশে গবেষকরা ১৯৭৫ সালে বিনাশাইল, ইরাটম ২৪ এবং ইরাটম ৩৮সহ নতুন জাতের ধানের উদ্ভাবন করেন। এর আগে ১৯৭৪ সালে গমের উচ্চফলনশীল জাতের নতুন নতুন গম উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা সফল হন। এর মধ্যে সোনালিকা জাতটি এ দেশে গম উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। এ ছাড়া কৃষি গবেষণার মাধ্যমে দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনসহ অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেন। যেখানে বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণার ফল আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি। দেশ স্বাধীনের পরে সাত কোটি জনগোষ্ঠীর খাবার জোগান কঠিন হলেও এখন আঠারো কোটি মানুষের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।

আমাদের দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৬১ সালে পাবনা জেলার রূপপুরে। কিন্তু প্রকল্পটি অনিবার্য কারণে স্থগিত হয়ে যায়। ‘স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থগিত হয়ে যাওয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান। এগুলোর মধ্যে ৩০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই নির্মাণ করা হবে পরমাণু বিশ্বের নবাগত দেশগুলোতে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন গঠন করেন।

স্বাধীনতার পর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)’ প্রতিষ্ঠা করেন। সব লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দেশের বহুমুখী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিসিএসআইআরসহ অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান সুনামের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। দেশে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের চর্চা ও বিকাশের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ রসায়ন সমিতির সম্মেলন উপলক্ষে এক বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো দরকার। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে উপযুক্ত ভূমিকা পালন করবেন।’ বিজ্ঞানীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, যিনি একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ১৯৭৪ সালের ০৪ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুতে বঙ্গবন্ধু এক শোকবাণীতে বলেন, ‘বাংলার কৃতী সন্তান ও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক বসুর মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত। বিজ্ঞান ও মানবতার প্রতি তার অবদান মানুষ চিরকাল স্মরণ রাখবে। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।’ শোকবাণীর এই কথাগুলোর মধ্যেই বিজ্ঞানীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ফুটে উঠেছে।

বঙ্গবন্ধু প্রকৃতপক্ষে একজন বাস্তববাদী ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি বিজ্ঞান-প্রযুক্তিনির্ভর ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রত্যেকটি সেক্টরে উন্নয়নের গোড়াপত্তন করেছিলেন। আধুনিক বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যেটুকু অগ্রগতি, তার বেশির ভাগেরই যাত্রা শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই।

লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত