ম্যাক্সিম গোর্কির প্রকৃত নাম আলেকসেই ম্যাকসিমোভিচ পেশকভ। গোর্কির জন্ম রাশিয়ার নিঝনি নভগোরদ শহরে ১৮৬৮ সালের ১৬ মার্চ তারিখে। গোর্কি একটি রুশ শব্দ। এর অর্থ হলো তিক্ত। এধরনের নামের পেছনে কারণ রয়েছে। গোর্কির বাস্তব জীবন সুখময় ছিল না। গোর্কির বাবার ডাকনাম ছিল ম্যাক্সিম।
গোর্কির বাবা ছিলেন রুশ দেশের একজন সাধারণ গরিব শ্রমিক। গোর্কি তার বাবাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। এর অল্পকাল পরেই তিনি মাকে হারিয়ে এতিম বালক হিসাবে মাতামহের বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এই পরিবারে তার দিদিমা ছিল তার প্রতি স্নেহময়ী। কিন্তু দাদা মশাইয়ের আচরণ ছিল চরম স্বেচ্ছাচারী।
আবার এই পরিবারটি ছিল ক্ষয়িষ্ণু কারিগর। রুশ সমাজে যে ভাঙ্গন ও পরিবর্তন চলছিল এই পরিবারটি তারই প্রভাবে সমৃদ্ধ স্বচ্চল অবস্থা থেকে সহায় সম্বলহীন জীবন যাপনে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত তার স্নেহময়ী দিদিমাকে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে চলতে হয়। পরিস্থিতির চাপে এই অনাথ এতিম গোর্কিকে নয় বছর বয়সে শ্রমিকের কাজে নামতে হয়।
অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে ভালভাবে লেখাপড়া করার সুযোগ তার জীবনে আসেনি। তিনি বার তের বছর বয়সে অক্ষর জ্ঞান লাভ করেন। গোর্কি লেখাপড়া শুরু করেন ১৪ বছর বয়সে। স্কুলে পড়ার উদ্দেশ্যে তিনি কাজান শহরে যান। অর্থনৈতিক কারণেই তার আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করা সম্ভব হয়ে উঠে নাই। জীবিকার সন্ধানে তাকে পথে পথে ঘুরতে হয়।
বিদ্যা শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজান শহরে আসলেও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে তাকে একটি রুটির কারখানায় শ্রমিকের কাজ নিতে হয়। এর আগে তাকে নিঝনি নভগোরদ শহরে বালক অবস্থাতেই জুতার দোকানে কাজ করতে হয়েছিল। কাজানে এসে তার পরিচয় ঘটে একদল বিপ্লবীর সঙ্গে। তখন রাশিয়াতে চলছিল পরিবর্তনের ঢেউ। ১৮৫৫ সালে রাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথা উচ্ছেদ হয়। এর ফলে কৃষক শর্ত সাপেক্ষে জমির মালিক হওয়ার সুযোগ পায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবশ্য কৃষককে অর্থ দিয়ে জমি কিনে নিতে হয়। আবার কৃষক জমির মালিক হয়েও জমির মালিকানা নিজের হাতে ধরে রাখতে পারে না। রাশিয়ায় মুদ্রা ও বাজার ব্যবস্থা ব্যাপক সম্প্রসারিত হয়। চাষের জন্য কৃষকের হাতে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও পুঁজি না থাকায় রাশিয়ার পুঁজিপতিদের কাছে জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। কৃষক জমিতে চাষ করে উৎপাদন খরচ তুলতে পারে না। কৃষক সমাজে ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়।
কৃষক জমি বিক্রি করে শহরে কাজের সন্ধানে গিয়ে মজুরের কাজ জীবিকা হিসাবে বেছে নেয়। এইভাবে গ্রামের ভূমিহীন কৃষক শহরে এসে শ্রমিকে পরিণত হতে থাকে। রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশের কারণে বুর্জোয়া শ্রেণী শহরে শিল্পের বিকাশ ঘটায়। সেই সময়ে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার বুর্জোয়া শ্রেণী রুশ দেশে পুঁজি লগ্নি করে শিল্প কারখানা গড়ে তোলে। এইভাবে রুশ দেশে শহরের বিস্তার শিল্প কারখানা গড়ে উঠা ও মজুর শ্রেণীর বৃদ্ধি ঘটতে থাকে।
এই সময়ে রুশ দেশ ক্ষমতায় ছিল স্বৈরতান্ত্রিক, রাজতান্ত্রিক জার সরকার। জার সরকার কুলাক ও পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করে চলতো। দেশের শ্রমিক কৃষক জনগণের উপর নির্মম নিষ্ঠুর শোষণ নিপীড়ন চালাতো। ফলে শ্রমিক কৃষক জনগণের স্তরে বিক্ষোভের আগুন ধূমায়িত হচ্ছিল। এই সময়েই রাশিয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠেছিল।
রাশিয়াতে সন্ত্রাসবাদী নৈরাজ্যবাদী বাকুনিনপন্থী মতবাদের বিস্তার ঘটছিল। সেই সাথে সোস্যাল ডেমোক্রাটিক, রেভ্যুলেশনারি ডেমোক্রাটিক, পপুলিস্ট ইত্যাদি নানা ধারায় সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন দ্রুত একটা পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। শ্রমিক শ্রেণীর চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে প্রকৃত বিপ্লবী ধারার রাজনৈতিক সংগঠনও গড়ে উঠছিল। গোর্কি নিজের শ্রেণীগত অবস্থানের কারণেই প্রথমত মার্কসবাদী বিপ্লবী সংঘের সাথে যোগ দেন। এই সময়ে তিনি মার্কস-এঙ্গেলসের লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হন।
বশ্য তারও আগে গোর্কির পরিচয় ঘটে উনিশ শতকের রুশ সাহিত্যের সঙ্গে। বিশেষ করে রুশ কথা সাহিত্যের তখন সৃষ্টির জোয়ার চলছিল। পুশকিন, গোগল, দস্তয়েভস্কি, ইভান তুর্গেনেভ, টলস্টয় প্রমুখের হাতে পৃথিবীর সেরা সাহিত্য রচিত হয়। সেই সময়ের রুশ কবি সাহিত্যিকদের অধিকাংশের মতো ম্যাক্সিম গোর্কির অভিজাত পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল না। একেবারে দীন হীন শ্রমিক পরিবারেই তার জন্ম হয়েছিল এবং তিনি নিজেও ছিলেন একজন শ্রমিক।
ব্যক্তিগত জীবনে ম্যাক্সিম গোর্কি একজন শ্রমিক হলেও দুনিয়া জোড়া খ্যাতির কারণ তার সৃষ্ট বিপ্লবী সাহিত্য কর্ম। লেখক হিসাবে ম্যাক্সিম গোর্কির আবির্ভাব উনিশ শতকে। তিনি রুশ সাহিত্যের মহান ঐতিহ্য আর উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতার অংশ। গল্প দিয়ে তার সাহিত্য জগতে প্রবেশ। তবে এর পেছনে সাহিত্যিক হিসাবে তার খ্যাতি পাওয়ার কোন লোভ ছিল না। এই কারণেই প্রথম গল্পটি তিনি বেনামে একটি পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন।
আর তিনি যা লিখেছিলেন তা শিল্পীর কল্পনাপ্রসূত কিছু ছিল না, ছিল নিজের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা। ম্যাক্সিম গোর্কির সাহিত্য জীবনের প্রথম পর্বে আছে তার গল্প। এরপর গোর্কি উপন্যাস ও নাটক রচনা করেছেন। সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা, সাংবাদিকতা ধর্মী অনেক লেখাও তিনি লিখেছেন। তবে তার রচিত ‘মা’ উপন্যাস তাকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করে দিয়েছে। ম্যাক্সিম গোর্কির জীবন দুঃখময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। জীবনের অধিকাংশ সময়ে তিনি নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যো দিয়ে অতিক্রম করেছেন।
জীবনের শেষ দিকে তিনি ক্ষয়রোগসহ শ্বাসযন্ত্রের নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন তারিখে তিনি চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান। তার এই মৃত্যু নিয়ে সেই সময়েই প্রশ্ন ছিল। এই সময়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়াতে রাষ্ট্র ও পার্টিতে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদের চরেরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসী অন্তর্ঘাতি তৎপরতায় লিপ্ত ছিল।
তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে এর প্রভাব ছিল। এই প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসী চক্রের নেতা ছিল ট্রটস্কি। এই চক্র চিকিৎসকদের দলে ভিড়িয়ে ভুল চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করিয়ে পার্টি ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা করতো। এই চক্র গুপ্তঘাতক দিয়ে হত্যাসহ নানাবিধ পদ্ধতি হত্যাকান্ড চালাতো।
এছাড়াও এরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে যুক্ত থেকে সেখানে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাতো। মস্কো ষড়যন্ত্র মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় এদের চক্রান্ত সম্পূর্ণরূপে উদঘাটিত হয়। ম্যাক্সিম গোর্কি এই প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসী চক্রের শিকারে পরিণত হন। গোর্কিকে এই পদ্ধতিতে হত্যার কারণ হচ্ছে সাহিত্যিক হিসাবে বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতি তার আনুগত্য।
রুশ কথা সাহিত্যের অন্যতম উত্তরাধিকার ম্যাক্সিম গোর্কি। গণমানুষের লেখক হিসাবে তার খ্যাতি গোটা পৃথিবী জুড়ে। মেহনতি মানুষের জীবনকে গোর্কি তার সাহিত্যের অন্যতম উপকরণ হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। উনবিংশ শতকের শেষ দিকে এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে রাশিয়ার রাজনৈতিক বাতাবরণে ম্যাক্সিম গোর্কির রচিত গল্প-উপন্যাস মুক্তিকামী শ্রমজীবী মানুষের কাছে প্রেরণাদায়ক ভূমিকা পালন করে।
বিশ্বের সকল দেশের সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, ঘৃণা-ভালোবাসা, স্বপ্ন-বাস্তবতা, যন্ত্রনা, সংগ্রাম সর্বোপরি জীবনের শাশ্বত কথা পাওয়া যায় ম্যাক্সিম গোর্কির লেখায়। বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে গোর্কির নাম এত বেশি পরিচিত যে তাকে রুশ ভাষার লেখক বলে মনে হয় না। গোর্কির মা উপন্যাসের কথা জানেন না এমন পাঠক পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। মা উপন্যাসের জন্য ম্যাক্সিম গোর্কি বাংলাভাষীদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। ম্যাক্সিম গোর্কির কোন উপন্যাসটি শ্রেষ্ঠ- তার বিচার করা আপেক্ষিক ব্যাপার। তিনি অসংখ্য উপন্যাস ও ছোট গল্প লিখেছেন।