রবিবার ১৩ জুলাই ২০২৫ ২৯ আষাঢ় ১৪৩২
রবিবার ১৩ জুলাই ২০২৫
কেএনএফের অপকর্মই শান্তিচুক্তির অন্তরায়
খন্দকার আপন হোসাইন
প্রকাশ: বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, ৪:৩৪ PM
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সময়ে সময়ে গড়ে উঠেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে প্রকাশ করেছে আকাঙ্ক্ষার বাণী। তাদের সক্রিয় কার্যক্রম প্রদর্শিত হয়েছে নানাবিধ কর্মকাণ্ডে। বিচ্ছিন্নতাবাদ কী? প্রথমেই বিচ্ছিন্নতাবাদের বৈশিষ্ট্য ও ধরন সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। বিচ্ছিন্নতাবাদ হলো ধর্মীয়, জাতিগত, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতির ভিন্নতাকে বিবেচনায় এনে কোন বৃহত্তর গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা ভূখণ্ডের ভৌগোলিক সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা। 

বিশ্বব্যাপী বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন গেরিলা সংগঠনের মধ্যে নিকারাগুয়ার কন্ট্রা, জাপানের রেড আর্মি, ভারতের ব্ল্যাক ক্যাট, মিয়ানমারের কেএনইউ ও কারেন জনগোষ্ঠীর গডস আর্মি, শ্রীলঙ্কার এলটিটিই, পেরুর টুপাক আমারু এবং আয়ারল্যান্ডের আইআরএ উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশেও সময়ে সময়ে জঙ্গি সংগঠনের পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের তৎপরতা দেখা গেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি পার্বত্য অঞ্চলে আলাদা জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির অভিলাষে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন সংগঠনের উত্থানপতন ঘটেছে। জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার শান্তিবাহিনী থেকে শুরু করে জেএসএস, ইউপিডিএফ, এমএল, জেএল, এনএলএফটিসহ সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একইরকমভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের কার্যক্রম আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে খুব একটা আসতে পারি নি। কিন্তু গত ২ এপ্রিল ২০২৪ তারিখ থেকে একটি সংগঠনের নাম ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার ব্যানার শিরোনামে প্রতিনিয়ত দৃশ্যমান হচ্ছে। ২ এপ্রিল রাতে এবং ৩ এপ্রিল দুপুরে বান্দরবানের রুমা এবং থানচি উপজেলার কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা চালায় একঝাঁক সশস্ত্র সন্ত্রাসী। ব্যাংকের টাকা লুট, ব্যাংক কর্মকর্তাদের মারধর ও একজন ব্যবস্থাপককে অপহরণের মাধ্যমে দেশব্যাপী সর্বাধিক আলোচ্য ইস্যুতে পরিণত হয় 'কেএনএফ' নামক পার্বত্য বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি সংগঠন। পাহাড়ি জনপদে এটি অপেক্ষাকৃত নতুন সংগঠন।

কেএনএফ-এর পূর্ণরূপ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। এর আরেক নাম বম পার্টি। ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব দাবি করা এ সংগঠনটি মুলত বম জাতিগোষ্ঠীর একটি অংশের উদ্যোগে গঠিত। সাবেক ঢাবি শিক্ষার্থী নাথান লনচেও বম ২০১৭ সালে কেএনএফ প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনটির বিরুদ্ধে হত্যা, লুটপাট, মুক্তিপণ আদায়সহ নানাবিধ সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ উঠেছে। তাদের কার্যক্রম একইসাথে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িজুড়ে বিস্তৃত। কেএনএফ মূলত রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি এবং বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, আলিকদম,লামা মোট নয়টি উপজেলায় বমরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অবশ্য কেএনএফ তাদের ফেইসবুক পেইজের এক পোস্টে এই নয় উপজেলার স্বাধীনতা নয় বরং স্বায়ত্তশাসন দাবির মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিচয় পাল্টাতেও চেষ্টা করে চলেছে। কেএনএফের সশস্ত্র শাখার নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। ধারণা করা হয় সংগঠনটি মিয়ানমারের কাচিন রাজ্য থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে এবং কারেন বিদ্রোহীর সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। 

প্রিন্ট মিডিয়ার সূত্রমতে কুকি চিন জাতীয় ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামক একটি এনজিওতে কাজ করতো নাথান বম। এনজিওটির মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা সংগ্রহ করেছে নাথান বম। আর অস্ত্র সংগ্রহ করত ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমার থেকে। সেই অস্ত্র চড়া দামে পাহাড়ে অবস্থানরত নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়তুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের কাছে বিক্রি করত। এই জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ এবং থাকা-খাওয়া বাবদ প্রতি মাসে চার লাখ টাকা করে সম্মানী পেত নাথান বমের কেএনএফ। 

গ্রেপ্তারকৃত কেএনএফ সদস্যদের বক্তব্য ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেএনএফ সদস্যরা মিয়ানমারের পালেতুয়া ও ভারতের মিজোরাম থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের মেয়াদ তিন মাস। প্রথম এক মাস ভারতের মিজোরামে তাত্ত্বিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। বাকি দুই মাস মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মিয়ানমার আর্মির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। এসব বাস্তব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কেএনএফের প্রতিটি সদস্য উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন সামরিক জ্ঞান অর্জন করে থাকে। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান অঞ্চলের স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যমতে ভয়ানক ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত এমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেএনএফ সদস্য সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। 

কেএনএফের যাবতীয় বিষয় বিবেচনায় নিয়ে শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই কেএনএফ শান্তিচুক্তির পথে মসৃণ কাঁটা ফেলে দিল। ধারণা করা হয় কেএনএফের সঙ্গে হয়তো পাহাড়ের বড় কোন সশস্ত্র গোষ্ঠীর যোগাযোগ হয়েছে। তারা এখনই শান্তি আলোচনায় যেতে কেএনএফকে নিরুৎসাহিত করছে। কেননা এতে তাদের প্রভাববলয় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসূত্রে জানা যায় কেএনএফ এর আরো কয়েকটি গোপন গ্রুপ রয়েছে। এরা সবসময়ই সীমান্ত এলাকায় একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রয়াস চালায়। ২০২৩ সাল থেকে অভিযান চালিয়ে ৯৯ জন কেএনএফ সদস্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শান্তি আলোচনার কারণে কেএনএফের বিরুদ্ধে অভিযান স্থগিত রাখা হয়েছিল।

কেএনএফের সঙ্গে শান্তিচুক্তি প্রতিষ্ঠায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’ গঠন করা হয়েছিল। শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী ২২ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে  নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু কেএনএফের সাম্প্রতিক অপকর্ম শান্তি আলোচনার দরজায় খিল এঁটে দিয়েছে। সরকার পুরো বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে কেএনএফ-এর সাথে সব ধরনের শান্তি আলোচনা বাতিল করা হয়েছে। কম্বাইন অপারেশনের মধ্য দিয়ে কেএনএফকে নির্মূল করার পরিকল্পনাও সামনে এসেছে। শান্তিচুক্তি হবে নাকি কেএনএফের অপকর্মের সমুচিত জবাব দিতে সেনা তৎপরতা বাড়ানো হবে? বিষয়টি উদ্বেগের। 

একসময় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ভালোই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ২০০৫ সালে জেএমবি ৬১টি জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। এরপরে সারা দেশে ছোট-বড় আরও অনেক সশস্ত্র জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। হলি আর্টিজানে জঙ্গিগোষ্ঠীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাঙালি হৃদয়ে বড়সড় ভীতি সৃষ্টি করেছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার জঙ্গি দমনে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছে। একইভাবে সরকার চাইলেই বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রশ্নে পাহাড়ি জনপদে সেনা হামলা করতে পারে। জাতিগত নিধন শুরু করে আদিবাসী সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি যথেষ্ট সহনশীল। শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্দেশ্যে শান্তিচুক্তিকেই গ্রহণযোগ্য মনে করে বাংলাদেশ সরকার। হয়তো এই উদারতাকে কেএনএফ কর্তৃপক্ষ দুর্বলতা ভেবেছে। তাই চলমান শান্তি প্রক্রিয়ার শর্ত ভঙ্গ করে সশস্ত্র ব্যাংক ডাকাতির মত ঘৃণ্য অপরাধ করতে কেএনএফের একটুও দ্বিধাবোধ হয়নি।

পার্বত্যাঞ্চলে বিরাজমান পরিস্থিতি সামাল দিতে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জিরো টলারেন্সনীতি অনুসরণ করতে হবে। অপতৎপরতা বন্ধে পুলিশি টহল বাড়াতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। স্থানে স্থানে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে। আনসার-ব্যাটালিয়ন বাহিনীকে আরও সক্রিয় করতে হবে। প্রশিক্ষিত কমান্ডোবাহিনী সদা প্রস্তুত রাখতে হবে। 

বস্তুত বিচ্ছিন্নতাবাদী অপকর্ম নির্মূলকরণে শক্তি প্রয়োগই একমাত্র সমাধান নয়। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোলা রাখতে হবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মনের ভাষা বুঝতে হবে। দেশটা যে শুধু বাঙালির না বরং সকল উপজাতির এ বিশ্বাস আদিবাসী জনমনে স্থাপন করতে পারলে তারা দেশকে নিজের মনে করবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠী যখন সত্যি-সত্যিই বাংলাদেশকে তাদের নিজের দেশ মনে করতে শুরু করবে তখন তারা নিজেরাই কেএনএফকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসবে। উপজাতিদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় গুরুত্বারোপ করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতি ও বাঙালির মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধির পথ সুগম করতে হবে। পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে অধিবাসীদের দেশের মূল স্রোতধারার সঙ্গে যুক্ত করা গেলে তারা জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রাখতে অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত