ঈদ আমাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব। আর এজন্য রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আমরা ঈদ উদযাপনে বন্ধুদের নিয়ে পুরানো দিনে ফিরে যাই বারবার। বন্ধু মহলে ঈদ নানাভাবে প্রভাবিত করে। ঈদের আগে রোজায় আমরা সবাই মিলে একদিন ইফতারের আয়োজন করি। যদিও সেই দিনটি রোজার শেষ দিনগুলোতে হয়। কারণ ঐ সময় সকলের অফিস বন্ধ হয়। তখন থেকে আমাদের মাঝে ঈদের আমেজ শুরু হয়।
আসলে বন্ধু মহলে ঈদ আমাদের অতীত স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ঈদের আনন্দ তখনই পরিপূর্ণ হয়,যখন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। ঈদ উপলক্ষ্য করে দেয় দেশের বিভিন্ন জেলায় কর্মক্ষেত্রে থাকা বন্ধুদের একত্রিত হওয়া এবং কৈশোরকালের আড্ডায় ফিরে যাওয়ার। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের নিকট থেকে সেলামি নিতাম,কিন্তু এখন তার বিপরীত। কারণ এখন আমরা সবাই চাকরি বা ব্যবসা করি, তাই আমাদের ছেলে-মেয়ে বা ছোট ভাইবোনকে সেলামি দিতে হয়। যা ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরিতে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।
এবার ঈদে ২৭ রোজায় নিজের কর্মস্থল ময়মনসিংহ থেকে নিজ জেলা পটুয়াখালী যাই। যাত্রাপথে ঝামেলামুক্ত হতে বিমানযোগে বরিশাল হয়ে পটুয়াখালী যাই। তারপর যতদিন পটুয়াখালী ছিলাম, সবদিন বন্ধুদের সাথে দেখা হত, একসাথে আড্ডা দিতাম। গল্প করতাম। এখানে শুধু ইসলাম ধর্মের অনুসারী বন্ধুই ছিল না,অন্য ধর্মের বন্ধুরা ছিল। অর্থাৎ আমরা সবাই মিলেমিশে গল্প করছি।
কে কোন ধর্মের এটা মুখ্য বিষয় ছিল না। তাই ঈদ আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়,বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনা আমাদের মধ্যে অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়। ঈদের পরে বন্ধুরা কুয়াকাটা ঘুরতে যায়,যদিও আমি যায়নি। ওখানে মজা করে সব বন্ধুরা নিরাপদে আবার বাসায় চলে আসে। এবার ঈদে আমরা প্রায় চল্লিশ জন পটুয়াখালীতে কালামের চটপটি দোকানে যাই। এই কালামের চটপটির ভালই নামদাম আছে,সবাই এখানে আসে। ঐদিন ভাগ্যক্রমে একজন ব্যক্তি আসেন, যিনি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচন করবেন। তাকেও নিয়ে ভালই আলোচনা হল, তিনি আমাদের নিকট দোয়া প্রত্যাশা করলেন। ঈদের মধ্যে ভোটের প্রচারণা অনেকেই করেছেন।
ছোটবেলায় ৩০ রোজায় দিন নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে সোজা পশ্চিম আকাশের দিকে খুঁজতাম ঈদের বাঁকা চাঁদ। মনে হত দেখে ফেলছি, কিন্তু আসলে দেখনি। যেন এই দেখি,এই নেই! সবাই মিলে মজা করতাম, অনেক পড়ে দেখা যেত আকাশে ঐ যে তাল গাছের ওপর দিয়ে চাঁদ দেখা যেত। যখন নিশ্চিত হতাম আমরা সবাই মিলে খুবই আনন্দ করতাম। প্রকৃতপক্ষে ঈদ এই বার্তা দেয় আমাদের সকলের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হোক, হিংসা বিদ্বেষ দুর হোক।
ইসলাম সমর্থন করে না এমন সব সংস্কৃতিতে আমরা মাঝেমধ্যে নিমজ্জিত হই। যা ঠিক না। অর্থাৎ এসব সংস্কৃতি থেকে অপসংস্কৃতি যেন সৃষ্টি না হয় সেবিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। যেসব আনুষ্ঠানিক উৎসব মুসলমানদের অস্তিত্বের জানান দেয় ঈদ তার মধ্যে অন্যতম। ঈদ শব্দটি আরবি। যা আওদ্ থেকে এসেছে। এর শাব্দিক অর্থ ঘুরে ঘুরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। প্রচলিত অর্থে ঈদ মানে আনন্দ বা খুশি। আর সেটি যদি হয় ঈদ উল ফিতর তাহলে খুশির মাত্রা বহুগুন বেড়ে যায়। দীর্ঘ এক মাসের সংযম, ত্যাগ আর সিয়াম সাধনার পর আসে খুশির ঈদ। ধর্মপ্রাণ মুসলমানগন এই দিনটি অত্যন্ত ধর্মীয় ভাব গম্ভীর্য ও আনন্দের সাথে পালন করে থাকেন।
কালক্রমে অঞ্চল ভেদে এই উৎসবে ভিন্ন ভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত হয়। মুসলমানদের জন্য ঈদ উদযাপন অবশ্য পালনীয়। ঈদ উল ফিতরে যেমন আছে আনন্দ তেমনি আছে সুসংঘবদ্ধতার মহান শিক্ষা। ঈদ রুচিশীল ও মননশীল সংস্কৃতির শিক্ষা দেয়। ঈদ উৎসব সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতা শেখায়। চাঁদ দেখে রোজা শুরু করা ও শেষ করার মধ্য দিয়ে যেমন সময়ানুবির্ততা শেখায় তেমনি ইফতার, সেহরি ঈদগাহের নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়েও সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা পাওয়া যায়। এভাবে মানুষের জীবনে ঈদুল ফিতর এক উজ্জ্বল ও সুন্দর শৃঙ্খলাবোধের সম্মিলন ঘটায়। এই শিক্ষা যেন আমরা সব সময় রক্ষা করতে পারি।
ঈদের দিন মানে সকল বৈষম্য বা ভেদাভেদ ভুলে মানবতার জয়গান গাওয়ার দিন। ঈদ ধর্মীয় উৎসব হলেও শত শত বছরের ইতিহাস নিয়ে জড়িয়ে গেছে বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে। যেখানে সকল ধর্মের মানুষ একসঙ্গে ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ করে। যা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতানার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এভাবেই ধর্ম-বর্ণ বিভেদ ভুলে গিয়ে এক বন্ধুত্বের এবং একে অপরের মধ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ তৈরি হয়। যা আসলেই প্রশংসনীয়।
এই সর্বব্যাপী রূপের কারণে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে ঈদ। তেমনি ঈদ আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যেমন, ছোট দোকানের কথা বলি, পটুয়াখালীর সদর লঞ্চঘাটে আলামিনের দোকান। এই দোকানে আমরা প্রতিদিন ইফতার করে সন্ধ্যায় যেতাম। রাত ১০ টা পর্যন্ত গল্প করতাম,সেখানে ডিম-রুটি, চা, দই খাওয়া হত। কেউ কেউ পাঁচটা পর্যন্ত ডিম-রুটি খেত। একেকদিন একেকজন বিল দিত। এখানে পরোক্ষভাবে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আলামিনকে সহযোগিতা করা। যাতে ওর ব্যবস্যার উন্নতি হয়। ছোট দোকান দিয়ে তার পরিবার চলে। এভাবে ঈদের সময় ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে গতি আসে। তাই আমরা ঈদের আনন্দ বা মজার মধ্যে দিয়ে একটি পরিবারকে বা একটি ব্যবস্যাকে তরান্বিত করতে পারি। যা দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিপুল শহরবাসী গ্রামে ছুটে যায় নাড়ির টানে,গ্রামের বাড়িতে সবাইকে নিয়ে ঈদ উদযাপনের জন্য। তাদের আগমনে প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে গ্রামের হাটবাজার দোকানগুলো। অনেক গ্রামের দোকানে দেখা যায় সারা বছর যা বিক্রি হয়,তার সমপরিমাণ ঈদের আগে বা পরে কয়েকদিনে হয়। এভাবে আমাদের সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। নতুন রক্ত সঞ্চারিত হয় গ্রামীণ অর্থনীতিতে। যদিও পবিত্র ঈদুল ফিতর মুসলিম সমাজের প্রধান উৎসব তবুও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মধ্যে ঈদ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। ধনী থেকে দরিদ্র সমাজের সর্বস্তরের লোক সারা বছরের দুঃখ-কষ্ট ভুলে এই দিনটিতে যে যার সাধ্যমত খুশিতে মেতে ওঠে। সমাজের বিত্তমান মানুষের দায়িত্ব একটু বেশি যেন তাঁরা গরীব মানুষের জন্য কিছু করে যাতে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে।
ঈদের সময় প্রতিবেশীর হক আদায়ের সুযোগ তৈরি হয়। আমরা সকলে চেষ্টা করছি যাতে প্রতিবেশীর হোক আদায় হয়। তাই আমাদের ঈদ উদযাপনে বন্ধুদের মধ্যে এই বিষয়টি গুরুত্ব পায়। আমরা সবাই একে অপরের সুখ-দুখে এগিয়ে আসি, কোন ধরণের অহংকারবোধ আমাদের মধ্যে কাজ করে না। তাই আমাদের সমাজের সকল পর্যায়ের বন্ধুদের মধ্যে এবিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সর্বদা দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে যাতে সমাজের উন্নতি হয়।
ঈদের ছুটিতে বেশিরভাগ মানুষ প্রিয়জনের কাছে যায়। প্রিয়জন বলতে আমরা যাদের জানি বন্ধু তাদের মধ্যে অন্যতম। কোনো কারণে হয়তো সেই প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। এরপর আর যোগাযোগ নেই। হয়তো কোনো যোগাযোগ রাখারই চেষ্টা করি না। তাই ঈদে অভিমান ভুলে সম্প্রীতির হাত বাড়িয়ে দেয় সেটাই আমাদের পরবর্তী ঈদের উদ্দেশ্য।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ