শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫ ৬ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫
ইরানের অগ্রযাত্রা একইভাবে অব্যাহত থাকবে
গাজীউল হাসান খান
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৪ মে, ২০২৪, ৩:১১ PM
ইরান ও আজারবাইজান সীমান্তে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করে ফিরে আসার পথেই ঘটে ইতিহাসের সেই বিপর্যয়কর ঘটনা। এক দুর্গম পার্বত্য এলাকায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী হেলিকপ্টারটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়। মৃত্যু হয় ইরানের প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ ইব্রাহিম রাইসি ও তাঁর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ ৯ জন উচ্চপদস্থ ইরানি ও আজারবাইজানি কর্মকর্তার। ইরানে পাঁচ দিনব্যাপী জাতীয় শোক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রিয় নেতার মৃত্যুতে ইরানবাসী শোকে মুহ্যমান হলেও সবার মনে এখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, আর সেটি হলো : প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যদের বহনকারী হেলিকপ্টারটি ভেঙে পড়ার বিষয়টি কি শুধুই একটি দুর্ঘটনা, নাকি এটি পরিকল্পিত কোনো নাশকতা? হেলিকপ্টার বহরের তিনটির মধ্যে দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে ফিরে এলেও প্রেসিডেন্ট রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল তাদের কেবিনটি। সে ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ কিংবা তদন্ত চালু থাকলেও এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তাতে শুধু ইরান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, বিশ্বজুড়েই শুরু হয়েছে নানাবিধ আলাপ-আলোচনা।

তুরস্ক, রাশিয়া ও চীন সরকারও এই ঘটনার তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। ইরানের গোয়েন্দা দপ্তরও গভীরভাবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ ও অভ্যন্তরীণ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে ইসরায়েল কিংবা অন্য কোনো পক্ষের কোনোভাবে সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না সেটি খুঁজে বের করা যেমন জরুরি, তেমন কিছু ঘটে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও ইরানের জন্য জরুরি। কারণ বিগত বছরগুলোতে ইসরায়েলের বিভিন্ন গুপ্তঘাতকরা ইরানের প্রচুর বৈজ্ঞানিক, সামাজিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং এমনকি সিরিয়া ও ইরাকে ইরানের কনস্যুলেট ও বিভিন্ন স্থাপনার ওপর হামলা চালিয়েছে এবং হত্যা করেছে জেনারেল কাশেম সুলেইমানি ও ইসলামী রেভল্যুশনারিগার্ড বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজা জাহেরিসহ অনেককে।

ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহিয়ানসহ উচ্চপদস্থ বিভিন্ন কর্মকর্তার মৃত্যুর কারণে শোক পালনের মধ্যেও ইরান সরকারের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড কিংবা সাংবিধানিক বিষয়াদি থেমে নেই। এরই মধ্যে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি প্রেসিডেন্ট রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহিয়ানের শূন্যপদে অন্তর্র্বতীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে আলী বাখেরি কানিকে নিয়োগ দিয়েছেন।

সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের শূন্যপদে ৫০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় আগামী ২৮ জুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট রাইসির হেলিকপ্টার বিপর্যয়ের পর ঘটনার আকস্মিকতায় ইরান হঠাৎ থমকে গেলেও দেশটি তার সার্বিক কর্মসূচি, জাতীয় নীতি ও ধারাবাহিকতা থেকে কোথাও একচুলও বিচ্যুৎ হয়নি। ইরান তার অনুসৃত নীতি ও কার্যক্রম শুধু ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, রাশিয়া ও চীনসহ সর্বত্র একইভাবে চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। বর্তমান সরকার ১৯৭৭-৭৯ এ ইসলামিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর থেকে তার অনুসৃত রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিতে অটল ও অবিচল রয়েছে। প্রায় পাঁচ দশক ধরে শত প্রতিকূল অবস্থা কিংবা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে ইরান।

একটা সময় অর্থনীতি, কূটনীতি ও সামরিক দিক থেকে ইরান খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তখনো ইরান সরকার ভেঙে পড়েনি। খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, প্রয়োজনীয় ওষুধ উৎপাদন এবং বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে এগিয়েছে। প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে জোরদার করার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। ইরান তার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে। তারা আজ পরমাণু বোমা তৈরির প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।

শত বাধা-বিপত্তির মুখেও তার জ্বালানি সম্পদ বাজারজাত করার ক্ষেত্রে নতজানু নীতি অবলম্বন করেনি। ফলে দিনে দিনে ইরান রাশিয়া ও চীনের মতো বৃহৎ শক্তির সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বে ক্ষমতার একাধিক ভরকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও ডলারের বিকল্প মুদ্রাব্যবস্থা চালু করা এবং এমনকি বাজার ও যোগাযোগব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রেও ইরানের প্রচেষ্টা ছিল অব্যাহত। সে কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের বাজার, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে ইরানের নীরব প্রচেষ্টা সবার নজর কেড়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও অর্থনীতি কিংবা বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় রাশিয়া ও চীনকে অংশীদার হিসেবে সাদরে গ্রহণ করেছে ইরান। পাশাপাশি সহযোগিতা করে যাচ্ছে লেবাননের হিজবুল্লাহ গেরিলা বাহিনী, ফিলিস্তিনের গাজায় হামাস প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং ইয়েমেনে হুতি-আনসারাল্লাহ বাহিনীকে। 

মূলত সে কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্ট সামরিক শক্তি ইসরায়েল এখনো ফিলিস্তিনকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব, মিসর কিংবা জর্দান দোদুল্যমান নীতি নিলেও ইরান তা করেনি। ইরান তার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন অপশক্তির বিরুদ্ধে বহুমুখী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তুরস্ক থেকে শুরু করে সৌদি আরব, মিসর ও জর্দান যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত জঙ্গিবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক প্রযুক্তি পেতে ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তলে তলে ইসরায়েলের সঙ্গে বিভিন্ন গোপন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে একমাত্র বর্তমান ইরান সরকারই ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরান ও লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের স্বার্থ সংরক্ষণে ত্রাতার ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। গাজায় ইহুদিবাদীদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে অস্ত্র ধরা কিংবা বিশ্বে সৌদি আরব, আমিরাত, কুয়েত ও মিসর তাদের জ্বালানি সম্পদ সরবরাহ বন্ধ করার হুমকিটাও দিতে পারছে না। ফলে গাজায় ইহুদিবাদীদের আগ্রাসন কিংবা গণহত্যা বন্ধ হচ্ছে না।

আরব রাষ্ট্রসমূহ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের এমন একটি সম্মিলিত উদ্যোগের অভাবে ফিলিস্তিনে যখন গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে এবং গাজাবাসী নিশ্চিহ্ন হচ্ছে, ঠিক তখনই ঘটল ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসির হেলিকপ্টার বিপর্যয়। কিন্তু তাতেও হতোদ্যম হয়নি ইরান। আবার নতুন উদ্যোগে, নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার নতুন প্রত্যয়ে এবং মধ্যপ্রাচ্যে সব সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে যাওয়ার শপথ ব্যক্ত করেছে ইরান। এক ইব্রাহিম রাইসি ও এক হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানের পরিবর্তে ইরান, ফিলিস্তিন কিংবা আরব ভূমিতে জন্ম হবে শত শত আপসহীন ও মৃত্যুঞ্জয়ী যোদ্ধার। ইরান সে শপথ নিয়েই এগিয়ে যাবে, কোনো অবস্থায়ই পিছু হটবে না।

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত