৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মাঝে একধরনের টানাটানি আমি লক্ষ করেছি। ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এসব রাষ্ট্রের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই কোনো কোনো রাষ্ট্রের সরকার নিজেদের প্রভাব এবং বলয় সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নানা হিসাবনিকাশে জড়িয়ে পড়েছিল।
দেশের অভ্যন্তরেও সরকারবিরোধীদের ধারণা ছিল মার্কিনবলয়ের সমর্থনে তারা নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হবে, ক্ষমতায় আসতে পারবে। কিন্তু সরকারের ভারসাম্যমূলক নীতি ও কৌশল কাউকে সেই সুযোগ দেয়নি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে বিরোধীরা যেভাবে প্রতিহত করতে চেয়েছিল তার সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অনড় অবস্থানের সুযোগ ছিল না। এ বিষয়টি বিরোধীরা বুঝতে পারেনি। ফলে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলে সব দেশই নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করে। বছরটি অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতে নির্বাচনের। ফলে এই দুই সরকারের কারও পক্ষেই শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানোর সুযোগ নেই। তবে চীনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সবার আগে চীন সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী চীন সফরের বিষয়টি গ্রহণ করলেও এই মুহূর্তে চীনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কৌশলগত কারণে নেননি। তিনি অবশ্য সম্প্রতি দেশ থাইল্যান্ডে ছয় দিনের সফর করেছেন। এতে কারও বিরূপভাজন হওয়ার সুযোগ ছিল না। থাইল্যান্ডের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি পূর্বাঞ্চলে রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার সমস্যার বিষয়টিও তিনি এ অঞ্চলের নেতাদের দৃষ্টিতে আনার সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করেছেন। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে এ অঞ্চলের ছোট-বড় দেশগুলোর সম্পর্কের উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
ভারতে এই মুহূর্তে লোকসভা নির্বাচন চলছে। এর মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্তা গত ৮ ও ৯ মে বাংলাদেশে দুই দিনের সফর করে গেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিরোধীরা ভারতকে জড়িয়ে দেশের অভ্যন্তরে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে আসছিল। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের আগে যে ধরনের ভূমিকা নিয়েছিল তা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের মধ্যেই তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময় ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিল। বিষয়টি সরকারবিরোধীদের মোটেও পছন্দ হয়নি।
বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ছিল তাদের একটি রাজনৈতিক কৌশল। ভারতকে এর সঙ্গে জড়িয়ে দেশের অভ্যন্তরে ভারতবিরোধী জিগির তোলার লক্ষ থেকেই ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাকও দেওয়া হয়। কিন্তু সেটিও খুব একটা কাজে না লাগলেও বাংলাদেশে ভারতবিরোধী প্রচারণা থেমে নেই। ১৮ মে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ভারতবিরোধী ‘কঠোর অবস্থান’ থেকে সরতে চায় বিএনপি।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব চলে যাওয়ার পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোলান্ড লু ভারত, শ্রীলঙ্কা সফর শেষে মঙ্গলবার ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তার সফর ছিল দুই দিনের। ডোলান্ড লু ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে তিনবার এসেছিলেন। তখন তার সফর নিয়ে বিরোধীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল।
সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে লুর ঢাকা সফর শেষে বিরোধীরা যোগদান করেছিল। তাদের সঙ্গে তখন লুর সমাঝোতা কী হয়েছিল তা জানা না গেলেও বাজারে নানা গুঞ্জন তখন ডালপালা ছড়িয়েছিল। এই ডোলান্ড লু-ই নির্বাচনের পাঁচ মাস পর আবার ঢাকায় আসেন।
ঢাকায় আসার আগে বিরোধীদের মধ্যে তাকে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল। তখন গণমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়েছিল লু এসে দেশের মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন। ধারণা করা হয়েছিল লু-র সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতাদেরও দেখা সাক্ষাৎ হবে। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সফরসূচিতে তেমন কোনো আলোচনা, বৈঠকের প্রসঙ্গ স্থান পায়নি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘ডোলান্ড লু আমাদের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ নন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমাদের কাছে ডোলান্ড লুর চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি-চিনের আচরণ গুরুত্বপূর্ণ।’ হঠাৎ বিএনপির কাছে কুকি-চিন এত গুরুত্বপূর্ণ হলো কেন বোঝা গেল না। কুকি-চিন জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যে নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ওই অঞ্চলে তাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ জঙ্গিদের সশস্ত্রভাবে তৈরি করার কাজে যুক্ত থাকলে সেটি সেই জাতিগোষ্ঠীরই স্বার্থবিরোধী হয়ে পড়ে। কুকি-চিনরা নিশ্চয়ই সেটি সমর্থন করে না।
ওই অঞ্চলে মিয়ানমার এবং ভারতের অভ্যন্তরে কুকি-চিনদের যে সশস্ত্র গোষ্ঠী স্বতন্ত্র রাষ্ট্র চিন্তায় যুক্ত হয়েছে সেটির পেছনে বিদেশি কোনো না কোনো অপশক্তির মদদ রয়েছে যে তা নিয়ে খুব বেশি সন্দেহ করার অবকাশ নেই। সেটির সঙ্গে যদিও বাংলাদেশের নাথান বমের নেতৃত্বে কুকি-চিন সশস্ত্র গোষ্ঠী যুক্ত থাকে তাহলে সেটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক এই অঞ্চলের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ কারণে কুকি-চিনদের এই ক্ষুদ্র অংশটিকে জাতীয় জীবনের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা এবং তাদের আত্মসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো আমাদের রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য।
রোহিঙ্গা সংকট এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ একটি জটিল সময় অতিক্রম করছে। এই সময় তাদের নিজ দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, রাশিয়াসহ সব রাষ্ট্রের আন্তরিকতা আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন। কিন্তু সেটি বেশ জটিল এক ভূরাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমস্যা।
ডোলান্ড লুর দুই দিনের সফর সম্পর্কে মিডিয়ায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা হচ্ছে, মঙ্গলবার তিনি ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক এবং নৈশভোজে অংশ নিয়েছেন। তা ছাড়া তার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে। এ ছাড়া একটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেও তিনি বৈঠক করতে পারেন বলে জানা গেছে।
সফরের দ্বিতীয় দিনে লু প্রথমে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়কমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে ও পরে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করবেন। পরে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। লু বুধবার রাত ৩টায় এক ফ্লাইটে ঢাকা ছাড়বেন বলে জানা গেছে। ঢাকায় তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেবেন কি না, সেটি নিশ্চিত নয়। তবে তার এই সফর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে দুই দেশের সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উভয় দেশেরই আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছে।
লু বাংলাদেশে পা রাখার আগেই ১৪ দলীয় জোটভুক্ত তিনটি বাম দলের ৯ জন নেতা চীন সফরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। দল তিনটি হলোÑ জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও সাম্যবাদী দল। জানা গেছে, সফরকালে বাম নেতারা কুনমিংয়ে ইউনান একাডেমি অব অ্যাগ্রিকালচার সায়েন্স একাডেমি, কেপিসি ফার্মাসিউটিক্যালস পরিদর্শন করবেন। নেতারা রুট (ওয়েলিন কমিউনিটি) লেভেলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কার্যক্রম সম্পর্কে জানার কথা ছিল। এছাড়া প্রতিনিধিদলটি চীনা কমিউনিস্ট পার্টি, ইউনান প্রদেশের সরকারের বৈদেশিক শাখার প্রধানসহ অন্যদের সঙ্গে পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন। সফর শেষে আগামী ১৮ মে দেশে ফিরেছে প্রতিনিধিদলটি।
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সৌহার্দ্যের সম্পর্ক এই সফরের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবে চীন সফরে যাবেন এর জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এরই মধ্যে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ উভয় দিক থেকেই দেখা যাচ্ছে। কাতার, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান সুস্পষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারাবিশ্ব ফিলিস্তিনের পক্ষে ইসরায়েলের বিপক্ষে ছাত্র আন্দোলন চলছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই আন্দোলন নিয়ে এখন ভীত। কারণ সামনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেই নির্বাচনে কে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসবেন সেটি এখনও নিশ্চিত নয়। বিশ্বের অন্য আরও কয়েকটি দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়েছে। টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বিশ্ব যখন চলছে তখনও বাংলাদেশ ভারসাম্যমূলক নীতি-কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে এই মুহূর্তে উপজেলা নির্বাচন চলছে। বিরোধীরা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাও বর্জন করছে। তৃণমূলে আওয়ামী লীগের নেতারা এবং কোনো কোনো সংসদ সদস্য দলের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত কিংবা নির্দেশ অনুসরণ না করায় নির্বাচন, দল এবং রাজনীতিতে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে শেখ হাসিনাকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতাগুলোর মুখোমুখি হতে হচ্ছে এবং কৌশলে তিনি এসব মোকাবিলা করছেন এবং কৌশলে তিনি এসব মোকাবিলা করেছেন।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি-বিশ্লেষক