মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫ ৩ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫
মোদি ম্যাজিক কতদূর এগোতে পারবে
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ: বুধবার, ২৯ মে, ২০২৪, ১২:৪৯ PM
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাধু নন, পাকা অসাধু; কিন্তু দেশটির বিরোধী নেতারা এমন সাক্ষ্য উপস্থিত করতে পারেননি যে ক্ষমতায় গেলে তারা চুরি করবেন না, বা অতীতে ওই কাজ করেননি। তারা চাইছেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা যেমন আছে তেমনই থাকবে, মোদির জায়গায় তারা আসবেন।

মোদির আওয়াজটা হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদের। অর্থনীতির উন্নতি চাই, ভারতীয় পণ্যের বিক্রি চাই এসব কথা তিনি বলেছেন; এবার ওসব বাহুল্য নেই, অর্থনীতি নেই, এবার শুধু হিন্দু জাতীয়তাবাদ। এবার বলেছেন ভারতের গৌরবের কথা; তার বক্তব্যে ভারত অর্থ দাঁড়িয়েছে হিন্দু ভারত; ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ। ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রই বানিয়ে ছাড়বেন; পৃথিবীর ভেতর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র, ইসরায়েল যেমন একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র।

মোদি ম্যাজিকের কথা শোনা গেছে। তা মোদি নানা রকমের জাদু দেখিয়েছেন বইকি, এমনকি ধ্যানেও বসেছেন। কিন্তু তার আসল শক্তি দুই জায়গায়। একটি হচ্ছে ওই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ-প্রচার, অন্যটি হচ্ছে পুঁজিপতি ও পুঁজিবাদীদের অকুণ্ঠ সমর্থন। 

ভারতীয় জাতীয়তাবাদ জিনিসটা সব সময়ই একটা রহস্যাবৃত জিনিস ছিল। কেননা ভারত তো কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, এটি বহুজাতির দেশ, এবং সবাই জানেন যে জাতীয়তাবাদের প্রধান উপাদান ধর্ম নয়, প্রধান উপাদান ভাষা। সে হিসেবে সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় ভারতে কমপক্ষে ১৭টি জাতি ছিল।

ভাষাগত বৈচিত্র্যের দিক থেকে এ উপমহাদেশ ইউরোপ মহাদেশের তুলনায় মোটেই ছোট নয়। বাইরে থেকে সাম্রাজ্যবাদীরা এসেছে, এসে ভারতকে নিজেদের শাসন ও শোষণের অধীনে নিয়ে প্রশাসনিক প্রয়োজনে রাজনৈতিকভাবে ভারতকে এক করে দিয়েছে।

সব শেষে আগমন ব্রিটিশের, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের একটা ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের উপযোগিতা ছিল; কিন্তু সে সময়ও ভারতের বহুজাতিক পরিচয়টা অবলুপ্ত হয়ে গেছে, তা নয়। ওদিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দাবি করেছিল যে, ভারতে একটি মাত্র জাতি আছে সেটি ভারতীয় জাতি, কিন্তু ওই জাতীয়তার ভিত্তিটা যে কী তা তারা বলতে পারেনি।

ভারতের মুসলমানরা ভাবল কংগ্রেস ধর্মীয় অর্থাৎ হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলছে; ভয় পেয়ে তারা তাই আওয়াজ তুলেছিল যে, ভারতে একটি জাতি নয়, রয়েছে দুটি জাতি। একটি হিন্দু, অন্যটি মুসলমান। সম্প্রদায়কে জাতি বলে চালিয়ে দেওয়ার ওই পথেই দেশভাগ হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোনো প্রকার সমাধান হয়নি। 

ভারতীয় জনতা পার্টি সরাসরি কোনো প্রকার লুকোছাপা না করে হিন্দুধর্মকেই জাতীয়তাবাদের প্রধান উপকরণ বলে চালাবার অটল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। ভারতীয় কংগ্রেস যা করতে পারেনি ভারতীয় জনতা পার্টি তা সম্ভব করবে, এমন সংকল্প।

তবে তাদের ওপরের ওই হিন্দু গেরুয়া আচ্ছাদনের ভেতরে যা আছে সে বস্তুটি মোটেই আধ্যাত্মিক নয়, সেটি পুরোপুরি ইহজাগতিক। সেটি হলো পুঁজিবাদ। সমগ্র বিশ্বে পুঁজিবাদ এখন পতনের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে এবং টিকে থাকার জন্য আগে যেসব ছাড় দিয়েছে ও উদারনৈতিকতার যে ধরনের ভান করেছে, সেসব ছুড়ে ফেলে দিয়ে চরম ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করেছে। এখন সে যেমন নৃশংস তেমন লজ্জাহীন; নৃশংসদের অবশ্য লজ্জা বা শঙ্কা কিছুই থাকবার কথা নয়। এ ফ্যাসিবাদীরা ধর্ম, উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবিদ্বেষ, আঞ্চলিকতা, পিতৃতান্ত্রিকতা-এসব নোংরা ও বিষাক্ত আবর্জনা দুই হাতে ব্যবহার করে; মানুষকে তারা উত্তেজিত করে, ঠেলে দেয় আদিমতার দিকে।

উত্তেজিত মানুষ নিজেদের অর্থনৈতিক-সামাজিক সমস্যাগুলো ভুলে পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে; পুঁজিবাদ ভাবে আপাতত বাঁচা গেল। এবারের ভারতীয় নির্বাচনেও ওই ফ্যাসিবাদী তৎপরতার প্রকাশটাই দেখা যাচ্ছে। টাকা ও পেশিশক্তির যদৃচ্ছা ব্যবহার তো ঘটেছেই, ব্যবহার করা হয়েছে হিন্দু জাতীয়তাবাদকেও; পাশাপাশি গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে।

মূল বিরোধীরা ‘মোদি হটাও, মোদি হটাও’ বলে পাড়া মাতাচ্ছেন, কিন্তু মোদির জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি। মোদির দলের শপথ ছিল বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে রামমন্দির তৈরি করবে, করেছেও। প্রধান বিরোধী এবং বিরোধীদের ভেতর একমাত্র সর্বভারতীয় দল কংগ্রেস কিন্তু বলেনি যে তারা ওইসব কাজের বিরোধী; বরং গত নির্বাচনের অল্প দিন আগে তাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেই দিয়েছিলেন যে, রামমন্দির বানানো নিয়ে বিজেপি যা করছে তা ছলনামাত্র; রামমন্দির বানাব আমরা। দলের পক্ষ থেকে তার এ বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি। 

মোদি বলেছেন, তিনি রামের অনুসারী; তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞায় সবচেয়ে যিনি মুখর সেই মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, রামের চেয়ে দুর্গা বড়, এবং তারা, পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা মা দুর্গার পূজারি, বাংলায় এলে রাম দুর্গাকে প্রণাম করবে। হাজার হোক রাম তো মানুষই, দুর্গা হচ্ছেন দেবী।

মমতা দিদি পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের স্বার্থের রক্ষকের ভূমিকা নিয়েছিলেন, কিন্তু তার আসল লড়াইটা দেখা গেল দুর্গার পক্ষে দাঁড়িয়ে রামের বিরোধিতার। রাম বড় না দুর্গা বড়-এ ধর্মীয় বাহাসে জনগণের ইহজাগতিক স্বার্থের স্থানটা কোথায়? কোনখানে? কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষ বলে বড়াই করত, ভারতের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতি এনেছিল, কিন্তু রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করতে পারেনি, আসলে তারা চেয়েছিল সব ধর্মের সমান মর্যাদা, যেটা মোটেই ধর্মনিরপেক্ষতা নয়।গান্ধীজির প্রসঙ্গ এখানে আসে। তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন, কিন্তু তাই বলে ধর্মনিরপেক্ষ যে ছিলেন তা মোটেই নয়। তিনিও চাইতেন রাষ্ট্রীয়ভাবে সব ধর্মের সমান মর্যাদা। ওই পর্যন্তই, তার বেশি নয়। 

সর্বোপরি তিনি রামরাজ্যের কথা বলতেন। রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের লালনটা ছিল সমাজবিপ্লবের সম্ভাবনা ঠেকিয়ে রাখবার অপ্রত্যক্ষ চেষ্টা। ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন না করার যে নীতি তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন, রাজনীতির সে ধারারই চরমপন্থি পথিক হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)।

দেশভাগের সময় গান্ধীজি বিপদগ্রস্ত মুসলমানদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন দেখতে পেয়ে আরএসএস ক্ষিপ্ত হয়েছে এবং গান্ধীজিকে হত্যা করতে তাদের হাত কাঁপেনি। গান্ধী হত্যার নায়ক ওই আরএসএস এখন বিজেপির অন্তরঙ্গ সঙ্গী। গান্ধীজিকে বলা হতো জাতির পিতা। জাতির পিতা দুবার পরাজিত হয়েছেন। 

একবার সাতচল্লিশে, দেশভাগের সময়। পরাজিত হয়ে সেবার তিনি প্রাণ দিলেন। তারপর স্বাধীন ভারতে বিজেপির শাসনে তার দ্বিতীয় পরাজয় ঘটল, আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী আদর্শের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। উল্টো দিকের যে পথটি চলে গেছে সমাজবিপ্লবের দিকে, সে পথে তিনি যাননি, কংগ্রেসকেও যেতে সাহায্য করেননি। বরং ঠেকিয়ে রেখেছেন।

কেবল তিনি নন, সাময়িকভাবে হলেও পরাজিত হয়েছেন ভারতের উদারনীতিকরাও। তারা যতই যা বলুন, বিবৃতি দিন, বই লিখুন, সভাসমিতি করুন, রাষ্ট্রক্ষমতা আপাতত চলে গেছে চরম দক্ষিণপন্থিদের হাতে। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করা সহজ নয়। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সেটা করা যাবে সে আশা দুরাশা।

নির্বাচন হয় টাকার জোরে, পেশির জোরে, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহারে, সর্বোপরি উগ্র ভাবাবেগের জোরে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এখন বিশ্বজুড়ে এটাই ঘটছে। আমেরিকা, রাশিয়া, ভারত-বড় বড় সব দেশেই দেখা যাচ্ছে অতিশয় নিম্নমানের মানুষই নির্বাচিত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ফেলছে। এরা চরমপন্থি। এ চরমপন্থিদের হটাতে হলে কথায় কুলাবে না, আন্দোলনের দরকার পড়বে; আর আন্দোলনের জন্য চাই রাজনৈতিক দল, যে দলের অবিচলিত লক্ষ্য থাকবে পুঁজিবাদ বিদায় করা।

কিন্তু কেবল পুঁজিবাদ বিদায় করলেই তো চলবে না; পুঁজিবাদের জায়গায় নৈরাজ্য তৈরি করাটা মোটেই কাজের কাজ নয়; প্রতিষ্ঠা চাই নতুন ব্যবস্থার, যে ব্যবস্থা পুঁজিবাদের কেন্দ্রে যে ব্যক্তিমালিকানা রয়েছে তাকে উৎপাটিত করে তার জায়গায় প্রতিষ্ঠা ঘটাতে হবে সামাজিক মালিকানার। উদারনীতিকরা কিন্তু এ সামাজিক মালিকানার বিরোধী; ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তারা যা চান তা হলো সংস্কারের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমালিকানার ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রাখা। এক কথায় মহাত্মা গান্ধীর মতোই তারাও সামাজিক বিপ্লবের বিরোধী। অথচ ওই বিপ্লব না ঘটলে পৃথিবীজুড়ে মানুষের অবস্থা যে আরও খারাপ হবে ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচন সে খবরটিই বিশ্বময় ছড়িয়ে দিচ্ছে। মহাদুর্যোগের পূর্বভাস বইকি।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত