ইতিহাস বলে মানবসভ্যতার উত্থান, বিকাশ, পতন ও নবউত্থানের বলয়ে আবর্তিত হয়। একটি আবর্তিত ঘটনা ফিরে আসতে বহু বছর বা বহু যুগ লেগে যায়। আমাদের দেশে মধ্যযুগের সুলতানি ও মোগল পর্বের সুশাসন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অসাম্প্রদায়িক সমাজ চার-পাঁচশ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো ফিরে আসেনি।
দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে লক্ষণীয় মাত্রায়। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে- হচ্ছে চোখে পড়ার মতো। বিশাল অংকের জাতীয় বাজেট ঘোষিত হচ্ছে। যাপিত জীবন শ্রেণি বিশেষে অনেক উজ্জ্বল হয়েছে। কিন্তু এ দেশের মানুষের সামাজিক জীবনে কি স্বস্তি বিরাজ করছে! ঘুষ-দুর্নীতি, খুন-সন্ত্রাস, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন বড় হচ্ছে। হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে খেলাপির তকমা গলায় ঝুলিয়ে যারা বহু কোটি টাকার সম্পদশালী হচ্ছে, রাষ্ট্র তাদেরই পাশে ছায়াবৃক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন সব নেতিবাচক বাস্তবতা বহাল রেখে দেশের প্রকৃত অগ্রগতির সূচক কি ঊর্ধ্বমুখী হবে?
একদিকে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত অগ্রগতির পরিসংখ্যান যেমন বড় হচ্ছে, তেমনি দুদিন আগের দুঃসংবাদ বা দুঃসহ জীবন আজকে ভয়ঙ্কর দাঁত বের করে আবার ফিরে আসছে। এ কথার মর্মার্থ ভুক্তভোগী সবাই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। কথাটি বললাম বহু বছর আগে- ২০০০ সালের স্মৃতি চারণ করে। আমার প্রকাশিত পুরনো কলাম ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম ২০০০ সালের ২৩ নভেম্বর জাতীয় দৈনিকে একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল ‘খুনে শহরের জিম্মাদার!’ আমার মনে হয় অতি সামান্য সংস্কার করে এই লেখাটি কোনো কাগজে পাঠালে সম্পাদক টাটকা বিষয় বলে সানন্দে ছাপবেন।
লেখার শুরুটা একটু উদ্ধৃত করছি, “রাজধানীতে ক্রমাগত ঘটে যাওয়া খুন-সন্ত্রাস নিয়ে পত্রিকার সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় ও নানা নিবন্ধ-রিপোর্ট কম লেখা হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের কঠোর হুশিয়ারি আর পুলিশ কর্মকর্তাদের সাজ সাজ রব ও নানা পরিকল্পনার আয়োজন বরাবরের মতোই ফুটো বেলুন হয়ে চুপসে যাচ্ছে। তাবৎ রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রকদের চোখের সামনে বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে খুনি আর সন্ত্রাসীরা। বাস্তব অবস্থা এখন এমন যে, খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশের পেটি অফিসারও যদি সন্ত্রাস দমনের পরিকল্পনা ও কঠোর অবস্থানের ঘোষণা দেন তো মানুষের চোখে অবিশ্বাসের ছায়া পড়ে। করুণার হাসি ফুটে ওঠে এদের উদ্দেশ্যে।” এখন যদিও খুন-সন্ত্রাসের পরিসংখ্যান কিছুটা নিম্নমুখী। এর জায়গা দখল করেছে সড়ক দুর্ঘটনাসহ নানা অপমৃত্যু।
২০০০ সালের লেখাটি ছিল রাজধানী ঢাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে। প্রায় দুই যুগ পর তা পল্লবিত হয়েছে দেশজুড়ে। বিষয়টি এমন নয় যে, কেবল আওয়ামী লীগের শাসন আমলেই এমন অবনতি চোখে পড়ে। স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশে কোনো আমলেই যে মানুষ স্বস্তিতে ছিল না তা ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে। আসলে ক্ষমতা, দলতন্ত্র আর সুবিধাবাদের রাজনৈতিক কাঠামো অভিন্ন থাকায় পরিস্থিতির কোনো রূপান্তর নেই। দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা তত বাড়ছে।
সাধারণ ডাকাতি, ছিনতাই, শত্রুতা সাধন, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মধ্য দিয়ে খুনোখুনিতো ছিলই, এর সঙ্গে যুক্ত হতো রাষ্ট্রীয় প্রযোজনায় খুন-খারাবি। অপারেশন ক্লিনহার্ট, র্যাব, পুলিশের আয়োজনে প্রথমে ক্রসফায়ার পরে এনকাউন্টার নামে হত্যার ঘটনা একটি নিষ্ঠুর নিয়তি হিসেবেই যেন আমাদের মানতে হয়েছিল। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর কিছুটা রাশ টানা হয়েছে।
সবকিছু ছাপিয়ে দেশজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ক্রমে বড় হচ্ছে। একে কোনোভাবেই যেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে দায়িত্ববানদের কোনো কোনো আচরণ আমাদের কাছে অমানবিক ও দুর্বোধ্য মনে হয়। প্রতিবার ঈদের পর দেখি সরকারি কর্তৃপক্ষ স্বস্তি প্রকাশ করে পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, গতবারের চেয়ে এবার সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে। অর্থাৎ যেন বলতে চাচ্ছেন গতবার পাঁচশজন মারা গিয়েছিল এবার তা কমে চারশ আটানব্বই জন হয়েছে। এ যেন এক বিরাট সাফল্য।
ছন্নছাড়া রাজনীতি আমাদের এভাবে ক্রমে যেন অমানবিক করে তুলেছে। রাস্তাঘাটের উন্নতি হওয়ায় এবং দায়িত্বশীলদের সতর্কতায় ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা অনেকটা কমেছে এই সত্য মানতে হচ্ছে। তবে সাধারণভাবে সড়ক দুর্ঘটনার খবর প্রতিদিনই শুনতে হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, যুক্তি যতই থাক, ভালো-মন্দের দায়ভার সরকারকেই নিতে হয়। এ সত্যটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের দেশের রাজনীতিবিদগণ গণতন্ত্রের চর্চা যত না করেন, ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির উচ্চারণ তার চেয়ে বহুগুণ বেশি করেন। বিরোধী দলগুলোর অবস্থানই থাকে সরকার বিরোধিতায় অষ্টপ্রহর ব্যস্ত থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার নানা চতুর পথ আবিষ্কারে ঘর্মাক্ত হওয়া। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতিশীল হতে দেখলে তাদের চোখ যেন আনন্দে চকচক করে।
সরকারের ব্যর্থতার কথা সরবে প্রচার করার মওকাটি জিইয়ে রাখতে পারলে তাদের স্বস্তি বাড়ে। সরকার পক্ষ মাঝে মাঝে অভিযোগ করে, তাদের নাজেহাল করার জন্য বিরোধী দল সন্ত্রাস আর খুন-খারাবিকে উসকে দিচ্ছে। সময়ের বাস্তবতায় সাধারণ মানুষ এসব অভিযোগ একেবারে উড়িয়েও দিতে পারে না। অন্তত মানুষের কল্যাণ চিন্তায় বিরোধী শিবির যে সন্ত্রাস প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছে তেমন নজির নেই। বরঞ্চ কোনো না কোনো নামাবরণে রাজনীতির ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসীদের অভয় বিচরণক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।
আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাফল্য কম নয়। যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে তারা জঙ্গি উত্থানকে অনেকটা দুর্বল করে দিতে পেরেছে। সংবাদ মাধ্যম সক্রিয় হওয়ায় এবং জনমত তৈরি হওয়ার পর কোনো কোনো হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন ও দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে পুলিশ দ্রুত সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয়েছে। আবার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব সক্রিয় থাকায় অনেক স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ডের তেমন সুরাহা করা যায়নি। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে পুলিশ অনেক বেশি দক্ষতা দেখাতে পারত।
এই সড়ক পথের এবং যানবাহনের বিশৃঙ্খলা প্রতিদিন দেশজুড়ে অব্যাহতভাবে প্রাণসংহার করছে এর কোনো প্রতিবিধান তো করা যাচ্ছে না। কোনো সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিশেষ তাৎপর্যের কারণে রাজধানী বা দেশজুড়ে যখন প্রতিবাদ প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে তখন সাময়িক সময়ের জন্য নড়েচড়ে বসেন সংশ্লিষ্টজনরা। নানা রকম আদেশ-নির্দেশ জারি হতে থাকে।
সব থিতিয়ে গেলে আবার উন্মত্ত নেশায় দাপিয়ে বেড়ায় পরিবহন সেক্টরের নিয়ন্ত্রক-পরিচালকরা। সড়ক নিয়ন্ত্রণে বেশ কতগুলো আদেশ জারি হয়েছে সম্প্রতি। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ করা, গাড়ির গতিসীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া। এসবের বাস্তবায়ন করানো যে সহজ নয় তা সড়কে বেরুলে বোঝা যায়। লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারের সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। ট্রাফিক আইন না মেনে রেষারেষি করে গাড়ি চালনা আর পথ আটকে যাত্রী তোলার বিড়ম্বনা ভুক্তভোগী নগরবাসী নিত্যদিন দেখছে। প্রতি রাতে টিভির স্ক্রলে তাকালে দেখা যাবে দেশজুড়ে বিচিত্র সড়ক দুর্ঘটনায় কত মানুষ অকাতর জীবন দিচ্ছে। কিন্তু এর প্রতিবিধান দেখছি না।
এই ছোট্ট দেশের চারপাশটা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে নয়। তারা বিশ্বাস করেন বেশিরভাগ পাবলিক পরিবহনের মালিকানার সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ফলে হাজার অপরাধ থাকলেও পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয় যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। একইভাবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাবানদের প্রভাবে ও দাপটে নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমিয়ে আনাও কঠিন। আর এমন বাস্তবতায় দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কীভাবে সম্ভব হবে! সুশাসনের সংকটের কারণে সামাজিক জীবনে অস্থিরতাও বাড়ছে প্রতিদিন।
দলীয় রাজনীতি নীতিহীন হয়ে উঠছে। রাজনীতি-সংশ্লিষ্টরা দলকে ভালোবাসছেন বিবেককে বলি দিয়ে। এর পেছনে বোধহয় কিছুটা লাভ-লোভ, কিছুটা দলের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা আর কিছুটা বিরোধী পক্ষকে শত্রু জ্ঞান করার সংস্কৃতি কাজ করে। তাই নিজ দলের অন্যায়ের সমালোচনা দল-সংশ্লিষ্ট মানুষ করতে শেখেননি। ফলে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে দলের পরিশুদ্ধি হওয়ার যে সুযোগ ছিল তা তিরোহিত হয়েছে বার বার।
সঙ্গতভাবেই আশা করার কারণ থাকে যে, দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সুশীল সমাজের বুদ্ধিজীবীগণ অন্তত বিবেকের শাসনে চলবেন। তারা লাইনচ্যুত দলকে লাইনে তুলে দেবেন। সঠিক পথ দেখিয়ে দলের কল্যাণ সাধন করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, নেতা-নেত্রীর সুনজর পাওয়ার জন্য তারাও ব্যতিব্যস্ত থাকেন। এসব কারণে রাজনীতির প্রতি জনআস্থা তৈরি হচ্ছে না।
আইনের শাসনের সংকট এবং সুশাসনের অভাব রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানেই মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা, দুর্নীতি এসব রোধ করার বা রাশ টানার লাগাম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যতটাই হোক, সামাজিক সুস্থিরতা না ফিরলে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন কি সম্ভব হবে? নানা অস্বস্তি থেকে জনবিক্ষোভ তৈরি হয়। প্রথমে ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত হয়। একে আমলে নিয়ে যৌক্তিক সংস্কার না করতে পারলে মাটি ফুঁড়ে যখন প্রস্রবণের সৃষ্টি করবে তখন তা প্রশমন করা কঠিন হয়ে পড়বে। প্রবল জলপ্রপাতের সৃষ্টি করলে একে থামানো অসম্ভব। অসহায়ভাবে ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনাই থাকে বেশি। আমাদের রাজনীতি আত্মচৈতন্যে ফিরে আসুক এই প্রার্থনা করি।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়