বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষক হিসেবে আমি কেন বিব্রত ও লজ্জিত, সেটা বলতে গেলে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। টানা চার মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে সব শ্রেণির নাগরিকের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশের প্রবীণ নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা ও বেসরকারি খাতের কর্মচারীদের জন্য পেনশন স্কিম প্রবর্তনের পরিকল্পনা হাতে নেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ঘোষণা আসে।
২০২২ সালের ৯ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালের ১ জুলাই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর ঘোষণা দেন। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি ‘সর্বজনীন পেনশন আইন ২০২৩’ অনুমোদন লাভ করে। আইনটি হওয়ার পর ২০২৩ সালের ৬ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে সরকার। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার কাঠামো আরও শক্তিশালী করতে ১৩ আগস্ট ২০২৩ সালে সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালাও প্রণীত হয়।
দেখুন, এ পর্যন্ত কোথাও কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা রয়েছে? পরবর্তী পদক্ষেপগুলো দেখা যাক। স্কিমটি ২০২৩ সালের ১ জুলাই চালু করার কথা থাকলেও ১৭ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশনের আওতায় প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা নামে চারটি স্কিমের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। প্রবাস হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য; প্রগতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জনবলের জন্য; সুরক্ষা হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি যেমন- কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতির জন্য; আর সমতা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী স্বল্প আয়ের ব্যক্তিদের জন্য।
লক্ষণীয়, স্কিমটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করার সময়ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রসঙ্গ নেই। কিন্তু কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে গত ১ জুলাই স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন প্রায় ৪০০ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘প্রত্যয়’ স্কিম চালু করে সরকার। এখন পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যাচ্ছে, সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘সেবক’ নামে আরেকটি স্কিম ২০২৫ সালের ১ জুলাই প্রবর্তন করা হবে। এর জন্য আরেক দফা সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা হয়তো সংশোধন করতে হবে।
প্রবাসী, বেসরকারি ও অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থায় বিদ্যমান একটি প্রতিষ্ঠিত পেনশন ব্যবস্থাকে দুর্বল করার কী যুক্তি থাকতে পারে?
গত ১৩ মার্চ প্রত্যয় পেনশন স্কিমের প্রজ্ঞাপন জারির পর শিক্ষক সমিতি একে বৈষম্যমূলক বলে আসছে। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য কী ধরনের স্কিম হবে, তা অজানা। অন্যদিকে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত নতুন শিক্ষকদের চাকরি শেষে পেনশনের টাকা কমে যাবে, বেতন কম পাবেন এবং বোনাস পাবেন না। ফলে জীবনের অর্থনৈতিক সুরক্ষা হ্রাস পাবে এবং মেধাবী প্রজন্ম শিক্ষকতা পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত বোধ করবেন। ভবিষ্যতে জাতি মেধা সংকটে পড়বে।
গত ১ জুলাই প্রত্যয় পেনশন স্কিম চালুর দিন থেকে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে দেশের ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মবিরতিতে অচলাবস্থা বিরাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে যাওয়ার আগে শিক্ষক নেতারা প্রত্যয় পেনশন স্কিমের অসংগতি বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে লিখিত চিঠি দিয়েছেন এবং শিক্ষামন্ত্রীকে এ বিষয়ে অবহিত করেছেন। কর্তৃপক্ষ থেকে কোনো প্রকার আশ্বাস না পাওয়ায় তারা কর্মবিরতিতে গেছেন। অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে শিক্ষক নেতাদের আলোচনার কোনো দিনক্ষণ ঠিক হয়নি।
আমি শিক্ষক হিসেবে এ আন্দোলনকে অত্যন্ত দুঃখজনক মনে করছি। কারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বিঘ্নিত করে শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। নিজেদের বেতন-ভাতার জন্য এ ধরনের আন্দোলন পৃথিবীতে আর কোথাও শিক্ষকদের করতে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। করোনার ধকলে শিক্ষার্থীদের সেশনজট এখনও আমরা পুরোপুরি বিদায় দিতে পারিনি। আবার এই অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন আরও পিছিয়ে দেবে। এর দায়ভার তাদেরই নিতে হবে, যারা শিক্ষকদের আন্দোলনে যেতে বাধ্য করেছেন।
প্রত্যয় পেনশন স্কিম নিয়ে উদ্ভূত শিক্ষক আন্দোলনের এখন তিনটি দাবি- প্রত্যয় পেনশন স্কিম বাতিল, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন এবং জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের জন্য সিনিয়র সচিবদের সমতুল্য যৌক্তিক পদ সৃজন। আমি মনে করি, এই তিনটি দাবি অযৌক্তিক ও অমূলক নয়। পরের দুটি দাবি অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন শিক্ষক নেতারা। প্রত্যয় পেনশন স্কিমে শিক্ষকদের ঢুকিয়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া প্রদেয় সুবিধাদি কর্তন করায় আরেকটি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন শিক্ষক পেশাজীবী। দেশ যত উন্নত হয়, সুবিধাদি তত বৃদ্ধি পায়Ñ এটাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিমের কার্যক্রম উদ্বোধনকালে বলেছিলেন, ‘এটি সরকারি চাকরিজীবী, যারা পেনশন পায় তাদের জন্য নয়; এটা এর বাইরের জনগোষ্ঠীর জন্য।’ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য রয়েছে স্বতন্ত্র বেতন স্কেল এবং সরকারি চাকরিজীবীদের তুলনায় শিক্ষদের বেতন প্রায় দেড় গুণ।
আমরা কোনো শিক্ষককে সর্বাত্মক আন্দোলনে দেখতে চাই না। শিক্ষকদের ক্লাস, পরীক্ষা ও গবেষণা কর্মকাণ্ড বন্ধ করে কর্মবিরতি পালন এবং প্রশাসক ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে বারবার ধরনা দিয়ে দাবি আদায় অত্যন্ত বিব্রতকর ও লজ্জার।
লেখক : অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়